আমার দেশ’র প্রতিবেদন।। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের আয়নাঘরে বন্দি সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান বীরপ্রতীক বলেছেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’, তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ ও স্বৈরাচারী আমলে গুমের প্রধান কারিগর মেজর জেনারেল জিয়াউলের নির্দেশনায় তাকে কুখ্যাত আয়নাঘরে বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে। তিনি আমার দেশকে আয়নাঘরের বন্দিত্বের কথা তুলে ধরতে গিয়ে এ কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, সার্ভিসে থাকা অবস্থায় আমাকে টানা ৪৫ দিন জিজ্ঞাসাবাদের নামে চরম নির্যাতন করা হয়েছে। আমি মনে হয় দেশে একমাত্র অফিসার চাকরিরত অবস্থায় গুম হয়েছিলাম। আয়নাঘরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছে অনেক মিনতি করেছি আমাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা আমার কাকুতি-মিনতি শোনেনি। একপর্যায়ে তাদের কাছে মুক্তি চাওয়ার আবেদন করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কারণ, তাদের কাছে আবেদন করা ছিল মানেই অরণ্যে রোদন।
আয়নাঘর বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন ডিটেনশন ক্যাম্প। এটি কচুক্ষেতে অবস্থিত।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গুম কমিশন সেই আয়নাঘরের সত্যতা পেয়েছে। যেখানে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের বন্দি রাখা হতো। তাদের বন্দিত্বের কথা তাদের পরিবারকেও জানানো হতো না। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে ৪০২ জন মানুষ নিখোঁজ হয়। এদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
হাসিনুর বলেন, ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট মিরপুরের বাসার সামনে থেকে আমাকে অপহরণ করা হয়। এরপর একটি কক্ষে নিয়ে পরিহিত কাপড় খুলে আমাকে একটা লুঙ্গি ও ছেঁড়া গেঞ্জি পরিয়ে দেয়। তার আগে আমাকে অনেক মারধর করে। তারা ১০ বাই ৮ ফুট একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দেয়। আমি ওই কক্ষে একা ছিলাম। জানালা ও ফ্যান ছাড়া ভ্যাপসা একটি কক্ষ। আশপাশের রুম থেকে আসছে টর্চারের কান্নার শব্দ। মাথার ওপর উচ্চ পাওয়ারের বাতি জ্বালানো। ভীতিকর পরিবেশ।
যারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে তারা বিএমএতে (বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। বাসা থেকে সেখানে যেতে মাত্র ৩০ মিনিট লেগেছে। ধারণা করেছিলাম যে, আমাকে ডিজিএফআইয়ের অফিসে নিয়ে আসা হয়েছে।
তিনি বলেন, গুমের প্রথম দিন তারা আমাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা জিজ্ঞাসা করে কেন আমি জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে পোস্ট দিয়েছি। আমি তাদের বলেছি, আমি কোনো পোস্ট দিইনি। আমার দেশ অনলাইন সেটি পোস্ট দিয়েছে সেটি মাত্র পোস্ট দিয়েছি।
এতে তারা আমাকে ধমক মেরে থামিয়ে দেয়। আয়নাঘরের প্রথম রাতে আমার মেজো মেয়ের কথা মনে পড়ল। তখন আমি কাঁদতে থাকি। আমার মেয়ের এ লেভেল পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার কথা। শখ ছিল মেয়েকে নিয়ে কোরবানির গরু কিনব। সবাই মিলে আনন্দ করব। মনে পড়ল আরো আমার দুই মেয়ের কথা।
হাসিনুর রহমান জানান, কোনো কোনো বন্দিকে বিভিন্ন প্রস্তাব দেওয়া হতো। যারা কথা শুনত না তাদের ওপর নেমে আসত নির্যাতনের খড়গ। আমাকেও একাধিকবার নির্যাতন করা হয়েছে। আমি সার্ভিসে থাকা অবস্থায় বলা হয়েছিল ভারতের ‘র’-এর সঙ্গে কাজ করতে। আমি রাজি হইনি। তখনো আমাকে গুম করা হয়। পরে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখালেখির জন্য আয়নাঘরে রাখা হয়। আমি এক বছর ৬ মাস ১৪ দিন আয়নাঘরে ছিলাম। এ সময় আমার পরিবার কেমন আছেন, মারা গেছে না জীবিত আছে, আমার বৃদ্ধ মা কেমন আছে কিছুই জানতাম না। পরিবার আমার অবস্থান জানত না।
তিনি বলেন, আমাকে গুমের সঙ্গে জড়িত সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ, মেজর জেনারেল আবেদীন, সিটিআইবির মেজর জেনারেল শাকিল, ডিজিএফআইয়ের ঢাকা ডেট কমান্ডার বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল নাজমুল, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব) আজহার, ১৯তম লংকোর্সস কর্নেল (অব) মাকসুরুল, ১১তম লংকোর্স কর্নেল আকতার হামিদ খান, ১০ম লং কোর্সের কর্নেল জায়েদ আবদুল্লাহ ও এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক বরখাস্ত হওয়া বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান। সরকারের কাছে আমি তাদের বিচার দাবি করি।
হাসিনুর জানান, আমাকে বন্দি রাখার সময় আমার স্ত্রী, তিন মেয়ে সবার দ্বারে দ্বারে গেছে। আমার প্রিয় খাবার ছিল গরুর মাংস। তারা সেটি মনে করে গরুর মাংস খায়নি। এসিতে ঘুমায়নি। আমাকে খুঁজে বের করা হবে এমন কথার আশ্বাস দিয়ে অনেক কর্মকর্তা আমার পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
হাসিনুর জানান, আমাকে যাতে মুক্তি দেওয়া হয় এজন্য একবার সাত দিন অনশন করেছিলাম। শরীর দুর্বল হয়ে গেলে এক অফিসার বললেন, মুক্তি দেওয়া হতে পারে। মুক্তির আশায় তাদের খাবার খেয়েছিলাম। কিন্তু তারা মুক্তি দেয়নি বরং নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তারা মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য এটি করে থাকে।
আমাকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল সেই স্থানটি মিরপুরে ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরের দক্ষিণ দিকে। গুম ঘরে ছিল মেশিন্যাবল সিস্টেম। পিন কোড থাকত। পিন দিলে সেটি খুলত। গুম ঘর থেকে মাঝে মাঝে হেলিকপ্টারের শব্দ ও রেলের হুইসেল শোনা যেত। নতুন ও পুরোনো ব্লকে ২০ থেকে ২৫ জন বন্দি থাকত। কক্ষ ছিল অন্ধকার। ২৪ ঘণ্টা লাইট জ্বালানো থাকত। যদি কোনো বন্দিকে ছেড়ে দেওয়া হতো তাহলে রুমগুলো অন্ধকার থাকত। প্রতি রুমে বড় ফ্যান ছিল, যা খুব আওয়াজ করত। বাইরে থেকে নির্যাতনের বিষয় যাতে বুঝতে না পারে এজন্য ফ্যান লাগিয়েছিল। মাত্র দুটি বাথরুম। একজন ব্যবহার করার পর অন্যজনকে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে মশার উপদ্রব ছিল, কিন্তু মশারি দেওয়া হতো না। সিলভার কার্প, তেলাপিয়াসহ পচা মাছ দেওয়া হতো। আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য উচ্চৈঃস্বরের সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে বৃষ্টির শব্দ, স্কুলের ঘণ্টা ও ভীতিকর শব্দ শোনানো হতো।
২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আমাকে তারা আমার বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। এ সময় আমি আমার মেয়েকে ও স্ত্রীকে দেখতে পাই। ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তারা আগে থেকেই যোগাযোগ করেছিল আমার স্ত্রী ও মেয়েদের সঙ্গে। আমি যে মুক্তি পাচ্ছি সেটি তারা জানত।
কোন মনোবল নিয়ে তিনি আয়নাঘরে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা রেখেছি। সৃষ্টিকর্তা যদি কাউকে রক্ষা করেন তাহলে পৃথিবীর কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। আমি দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে রাজি আছি।
হাসিনুর রহমান বীরপ্রতীক ১৯৮২ সালে ১০ বিএমএ লং কোর্সের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি প্রেষণে র্যাবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৪ সালের জুনে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ১০ম দীর্ঘ কোর্সে কমিশন লাভ করেন। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশের সদস্যদের গ্রেপ্তারের জন্য পাহাড়তলী অপারেশনের নেতৃত্ব দেন। সেনাবাহিনী থেকে যখন তাকে বরখাস্ত করা হয় তখন তিনি আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডে নিযুক্ত ছিলেন। ২০২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করেন।
আপনার মতামত লিখুন :