প্রবল গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির বহু সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য (এমপি) গ্রেপ্তার হয়ে ঠাঁই পেয়েছেন কারাগারে। কয়েক মাস আগেও যারা ছিলেন তুমুল ব্যস্ত, সেই সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা এখন অলস সময় পার করছেন কারাগারে শুয়ে-বসে। তাদেরই একজন সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রয়েছেন তিনি।
যে কারাগারে প্রতিটি আসামির জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা সেল। তবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সাধারণ বন্দিদের চেয়ে বাড়তি কিছু সুবিধা (ডিভিশন সুবিধা) পাচ্ছেন পলক। ডিভিশন অনুযায়ী কারা আইনে যা যা পাওয়ার কথা সেগুলোই ভোগ করছেন তিনি। এক সেলে থাকছেন একাই, রয়েছে সেবার জন্য একজন বন্দিও। এ ছাড়া খাট, চেয়ার-টেবিল, পত্রিকা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কারা সুবিধা পেয়ে থাকেন তিনি।
যদিও সম্প্রতি সাবেক এ প্রতিমন্ত্রী এবং তার আইনজীবী আদালতে শুনানিকালে ডিভিশন অনুযায়ী কারাগারে সংশ্লিষ্ট সব সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ তোলেন। এ ছাড়া কারাগারে পলককে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া কয়েদিদের সঙ্গে রাখা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়। তবে পলক ও তার আইনজীবীর অভিযোগ নাকচ করে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, ডিভিশন অনুযায়ী একজন বন্দির যে-সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, তার সবই পাচ্ছেন পলক।
গত ২ ডিসেম্বর আদালতে শুনানিকালে পলক বলেছিলেন, তিনি কোনো ডিভিশন সুবিধা পাচ্ছেন না। দুই হাজার আসামির সঙ্গে কারাগারে রাখা হয়েছে তাকে। যার মধ্যে দেড় হাজারজনই ফাঁসির আসামি। তবে পলকের এসব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে কারা কর্তৃপক্ষ দেশ রূপান্তরকে বলেছে, সাবেক এ প্রতিমন্ত্রী হাইসিকিউরিটি কারাগারে রয়েছেন, সেখানে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে তিনি ডিভিশন পেয়েছেন। তাই যে কারাগারেই থাকেন না কেন, ডিভিশন অনুযায়ী প্রাপ্য সব সুবিধা পাবেন। কারা আইন অনুযায়ী যে যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তাকে তার সবই দেওয়া হচ্ছে।
কারা কর্মকর্তারা বলেন, কারাবিধি অনুযায়ী কারাগারে শ্রেণি (ডিভিশন) সুবিধা পেয়ে থাকেন সাবেক এমপি, মন্ত্রী, সিআইপি ও সরকারি কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ডিভিশন সুবিধার জন্য যেকোনো বন্দি নিজের সামাজিক অবস্থান তুলে ধরে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতের কাছে আবেদন করতে পারেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আদালত যদি কোনো বন্দির ডিভিশন সুবিধার আবেদন মঞ্জুর করে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় তখন সেই বন্দি ডিভিশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। যারা ডিভিশন পেয়ে থাকেন তাদের আলাদা কক্ষ বা সেলে রাখা হয়। সেখানে খাট, ভালো বিছানা, টেবিল, চেয়ারসহ বাড়তি কিছু সুবিধা দেওয়া হয়। তাদের খাবারের পদেও রয়েছে সাধারণ বন্দির চেয়ে কিছুটা ভিন্নতা। ডিভিশন পাওয়া বন্দিদের জন্য একজন করে সহকারী (বন্দিদের মধ্যে থেকে) দেওয়া হয়। তারা সংশ্লিষ্ট বন্দির প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে দেন। এ ছাড়া কারাগারের বাইরে থেকে স্বজনদের দেওয়া খাবার যাচাই-বাছাই করে তাদের দিয়ে থাকে কারা কর্তৃপক্ষ।
কারা আইনের বিধি ৬১৭-তে বলা আছে, ‘যারা ভালো চরিত্রের অধিকারী ও অনভ্যাসগত অপরাধী; সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা এবং অভ্যাসের কারণে যাদের জীবনযাপনের ধরন উচ্চমানের এবং যারা নৃশংসতা, নৈতিক স্খলন এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসামূলক অপরাধ বা বিস্ফোরক, আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে রাখা, সম্পত্তিসংক্রান্ত মারাত্মক অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত নন বা অন্য কাউকে এসব অপরাধ করতে প্ররোচিত বা উত্তেজিত করেনি তারা ডিভিশন-১ প্রাপ্তির যোগ্য হবেন। এ ছাড়া বিধি ৬১৭ (২)-এ বলা আছে, নাগরিকত্ব নির্বিশেষে সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা এবং অভ্যাসের কারণে জীবনযাপনের ধরন উচ্চমানের বন্দিগণ ডিভিশন-২ প্রাপ্তির যোগ্য হবেন।’
কারাগারে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ডিভিশনের বিষয় জানতে চাইলে সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (এআইজি-উন্নয়ন) মো. জান্নাত-উল ফরহাদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যারা ডিভিশন পান তাদের আলাদা রুম বা সেলে রাখা হয়। সেখানে থাকে খাট, ভালো বিছানা, টেবিল, চেয়ার, তোশক, বালিশ, তেল, চিরুনি, আয়নাসহ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস। সাবেক এ প্রতিমন্ত্রীও যেহেতু ডিভিশন পেয়েছেন, তাই তিনিও সংশ্লিষ্ট সব সুবিধা পেয়ে থাকেন। ডিভিশন পাওয়া বন্দিদের জন্য একজন করে সহকারী দেওয়া হয়। তারা সংশ্লিষ্ট বন্দির প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে দেন। সেই সুবিধাও পাচ্ছেন পলক।’
এই কারা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘যেহেতু ওই কারাগারটি (কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার) হাইসিকিউরিটি তাই সেখানে সাজাপ্রাপ্ত আসামি থাকবে এটা স্বাভাবিক। তবে ওই কারাগারে সবার সেল আলাদা। পলক সাহেবও আলাদা সেলে থাকেন। ডিভিশন অনুযায়ী সুবিধা পাচ্ছেন। তারপরও আদালতে এসে বলছেন, তাকে ডিভিশনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। ফাঁসির আসামিদের সঙ্গে রাখা হয়েছে। মূলত তিনি চাচ্ছেন সব গ্রেপ্তারকৃত আসামি (এমপি-মন্ত্রী) একসঙ্গে থাকবেন। কারাগারে বসে পরিকল্পনা করবেন। কিন্তু এমন কিছু যাতে না হয় তাই তাকে হাইসিকিউরিটি কারাগারে রাখা হয়েছে।’
গত ২ ডিসেম্বর আদালতে শুনানিকালে পলক বলেছিলেন, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে তিনি ডিভিশন পাচ্ছেন না। ৫ হাত লম্বা ও ৪ হাত চওড়া সেলে তাকে রাখা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎসহ ফোনে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন না। কারাগারটিতে বেশিরভাগ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত। তাদের মধ্যে তাকে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পলকের আইনজীবী ফারজানা ইসলাম রাখির মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও কোনো সাড়া মেলেনি। তবে আদালতে শুনানি শেষে তিনি বলেছিলেন, জুনাইদ আহমেদ পলককে ডিভিশনে না রেখে নরমাল (সাধারণ) কয়েদিদের সঙ্গে সেলে রাখা হয়েছে। যে সেলে সব ফাঁসির আসামি রয়েছে। সেখানে দুই হাজার আসামির মধ্যে দেড় হাজারজন ফাঁসির আসামি। এমন ধরনের একটা জায়গায় তাকে রাখা হয়েছে। গত ২৭ অক্টোবর তিনি ডিভিশনপ্রাপ্ত হন। ডিসির কাছ থেকে অনুমোদনও পান। তিনি ডিভিশনেও ছিলেন। পরে কাশিমপুর নিয়ে যাওয়ার পর হাইসিকিউরিটির ৪ নম্বর সেলে তাকে রাখা হয়েছে। যেখানে কোনো ধরনের ডিভিশন নেই। শারীরিকভাবে তিনি অনেক অসুস্থ। ডিভিশনাল সেলের সুযোগ-সুবিধা না থাকার ফলে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে অনিরাপত্তার মাঝে জীবনযাপন করছেন।
এ আইনজীবী আরও বলেছিলেন, সেখানে সাজাপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামি যেহেতু রয়েছে, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড (অতীত কর্মকাণ্ড) অনেক ভয়ংকর হয়ে থাকে। অনেকে আছে এর মধ্যে জঙ্গি। এ ধরনের জঙ্গিদের সঙ্গে তাকে এক জায়গায় রাখা হয়েছে। তিনি অনিরাপত্তায় ভুগছেন। উৎস: দেশ রুপান্তর।
আপনার মতামত লিখুন :