পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করেন সাধারণ আনসার বা অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে ঢাকায় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় ঘিরে সহিংস বিক্ষোভ করার পর অনেক আনসার সদস্যকে পুলিশ থেকে ধাপে ধাপে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সহিংসতায় জড়িত সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা, সাময়িক বহিষ্কার, কালো তালিকাভুক্ত করা এবং ইস্যু করা অস্ত্র প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আনসার সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তাকারী এ বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সূত্র : আজকের পত্রিকা
মামলাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা
বিশ্রাম পদ্ধতি বাতিল করে চাকরি জাতীয়করণসহ বিভিন্ন দাবিতে গত ২৫ আগস্ট রাজধানীর সচিবালয় এবং বিভিন্ন জেলা শহরে বিক্ষোভ করেন অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা। ওই দিন সচিবালয়সহ কয়েকটি স্থানে ছাত্রদের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষও হয়। যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে রাতে আনসারদের সচিবালয়ের সামনে থেকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ঢাকার সহিংস বিক্ষোভের ঘটনায় ডিএমপির শাহবাগ, পল্টন, রমনা ও বিমানবন্দর থানায় একাধিক মামলা করা হয়। এতে হাজারের বেশি সদস্যকে আসামি করা হয়। এসব মামলায় অন্তত ৪০২ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা কারাগারে রয়েছেন। তদন্ত করে অভিযুক্ত ৮ হাজার ৯১৪ জন আনসার সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
আনসার সদর দপ্তরের সূত্র জানিয়েছে, সচিবালয়, আনসার ক্যাম্প ও জেলা অফিসগুলোতে বিক্ষোভ এবং ভাঙচুর করা আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সবগুলো ঘটনা তদন্ত করেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তথা সচিবালয়ে হামলায় অংশ নেওয়া অভিযুক্ত ১৫ জনকে কালো-তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাঁরা কখনোই আর চাকরিতে ফিরতে পারবেন না।
তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও করা হয়েছে, পাশাপাশি আনসার সদর দপ্তরও ব্যবস্থা নিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, সাময়িক বহিষ্কার করা আনসার সদস্যরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন। উত্থাপিত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করতে পারলে তাঁদের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হবে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতিসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২৫ আগস্ট বিক্ষোভের দিনই বিকেলে আনসার সদস্যদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বিশ্রামের যে প্রথা তা থাকবে না। তাঁরা নিয়মিত চাকরি করে যেতে পারবেন। আনসারদের দাবি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সাত সদস্যের কমিটিও গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে আনসাররা জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে অনড় থেকে সচিবালয় এলাকায় রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ চালিয়ে যান।
৫ আগস্টের আগে সারা দেশে পুলিশ বাহিনীসহ ৫৭০১টি সংস্থায় ৫৪৬৫১ জন প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ সাধারণ আনসার সদস্য অঙ্গীভূত হয়ে বিমানবন্দর, রেলস্টেশনসহ গণপরিবহন, শিল্প-কারখানা, হাসপাতাল, ব্যাংক, গ্যাস ও বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিপণিবিতান, গার্মেন্টস শিল্প, লঞ্চঘাট, সমুদ্রবন্দর এবং ইপিজেডসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনায় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতেন।
সারা দেশে অঙ্গীভূত আনসারের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার সদস্য সব সময় দায়িত্ব পালন করতেন। বাকি ১৫ হাজার বিশ্রামে থাকতেন। তিন বছর পরপর তাঁদের বিশ্রামে পাঠানো হয়। এ সময় তাঁরা কোনো ভাতা পান না।
‘মৌলিক প্রশিক্ষণ’ গ্রহণকারী সাধারণ আনসার সদস্যদেরকে নিরাপত্তাব্যস্থাসহ সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অঙ্গীভূত করা হলে তাঁদের অঙ্গীভূত আনসার বলা হয়।
পুলিশ থেকে প্রত্যাহার
পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের কখনো কখনো মেট্রোপলিটন ও জেলা পুলিশসহ বিভিন্ন ইউনিটে পদায়ন করা হতো। তবে সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর স্থানে হামলার পর তাঁদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ফের তাঁদের পুলিশের সঙ্গে দেওয়া হবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। আনসার বাহিনীতে সংস্কারের পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে এর সদর দপ্তর। আনসার সদস্যরা না থাকায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা, থানা-পুলিশের টহল চালানো এবং তল্লাশিচৌকি বসাতে জনবল-সংকটে পড়েছে ডিএমপি।
ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁর বাহিনীতে কর্মরত আড়াই হাজার আনসারকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ডিএমপিতে বর্তমানে ৫৯ আনসার জন রয়েছেন, তাঁদেরও ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) মো. ইসরাইল হাওলাদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একটি পরিস্থিতির কারণে আনসাররা ফেরত গেছেন। তবে এতে আমাদের কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
আনসারদের শিগগির পুলিশে ফেরার দৃশ্যত কোনো সম্ভাবনা নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী সদর দপ্তরের মুখপাত্র মো. আশিকউজ্জামান বলেন, প্রত্যাহার করার পর পুলিশের পক্ষ থেকে আনসার সদস্য চাওয়া হয়নি। তাই নতুন করে দেওয়াও হয়নি। তাঁরা চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবার দেওয়া হবে।
কেপিআইভুক্ত স্থাপনায় কিছু আনসার
আগস্টের সংকটের পর অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের অস্ত্র প্রত্যাহার করা হলে কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা জটিলতায় পড়ে। মনে করা হয়, আনসাররা অস্ত্র ছাড়া দায়িত্ব পালন করলে প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপত্তাঝুঁকিতে থাকতে পারে। পরে অক্টোবরের শেষের দিকে যাচাই-বাছাই করে আবার কিছুসংখ্যক আনসার সদস্যকে নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজনদের কোনো অস্ত্র দেওয়া হচ্ছে না।
অতীতেও অসন্তোষের নজির
চাকরি ও সুযোগ-সুবিধাবিষয়ক দাবিদাওয়া নিয়ে আনসার বাহিনীর মধ্যে অতীতেও অসন্তোষ, এমনকি বিদ্রোহের ঘটনাও ঘটেছে।
১৯৯৪ সালের ১ ডিসেম্বর সফিপুর আনসার একাডেমিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আনসার সদস্যের বাগ্বিতণ্ডার জেরে বিদ্রোহ শুরু হয়। সে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার খিলগাঁওয়ের আনসার সদর দপ্তরেও। প্রথমে সাত দফা দাবি তুললেও পরে আনসার সদস্যরা চাকরি স্থায়ী করার এক দফা দাবি জানান। বিদ্রোহের চতুর্থ দিনে সেনাবাহিনী, বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) ও পুলিশ কঠোর যৌথ অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বিদ্রোহের শাস্তি হিসেবে প্রায় ২৫০০ আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তার ও চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে কেউ কেউ আদালতে গিয়ে খালাস পান ও চাকরি ফিরে পান।
আনসারে সংস্কারের উদ্যোগ
সংকট মোকাবিলায় ইতিমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তরের মুখপাত্র মো. আশিকউজ্জামান। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, আনসার রিফর্মের (সংস্কারের) কাজ চলছে। কমিটি সংস্কারের জন্য কাজ শেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেবে।
আনসার সদর দপ্তর সূত্র জানায়, অঙ্গীভূত আনসারদের ঢেলে সাজাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য একাধিক কমিটি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এসব কমিটি কাজ শুরু করেছে। তাঁদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া, বেতন-ভাতা ও চাকরি স্থায়ীকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তন আনা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :