স্ক্যানার ভিউ প্রতিবেদন: গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ২৬৮টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার। ক্যাটাগরিভিত্তিক ভুল তথ্য শনাক্ত ছাড়াও গেল মাসে একটি ফ্যাক্ট স্টোরিও প্রকাশ করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফ্যাক্ট চেক থেকে গণনাকৃত এই সংখ্যার মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ১২৭ টি ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা মোট ভুল তথ্যের ৪৭ শতাংশ। এ ছাড়া জাতীয় বিষয়ে ৭৩টি, আন্তর্জাতিক বিষয়ে ১০টি, ধর্মীয় বিষয়ে ১৮টি, বিনোদন ও সাহিত্য বিষয়ে ৮টি, শিক্ষা বিষয়ে ৫টি, প্রতারণা বিষয়ে ১৬টি, খেলাধুলা বিষয়ে ৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে।
এসব ঘটনায় তথ্যভিত্তিক ভুলই ছিল সবচেয়ে বেশি, ১০৮টি। এ ছাড়া ছবিকেন্দ্রিক ভুল ছিল ৬৪টি এবং ভিডিওকেন্দ্রিক ভুল ছিল ৯৬টি। শনাক্ত হওয়া ভুল তথ্যগুলোর মধ্যে মিথ্যা হিসেবে ১৬৪টি, বিভ্রান্তিকর হিসেবে ৬৪টি এবং বিকৃত হিসেবে ৪০টি ঘটনাকে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
প্ল্যাটফরম হিসেবে গত মাসে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে, সংখ্যার হিসাবে যা ২৫০টি। এ ছাড়া এক্সে ৪৪টি, টিকটকে ১৬টি, ইউটিউবে ৩৮টি, ইন্সটাগ্রামে ২১টি, থ্রেডসে অন্তত তিনটি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। ভুল তথ্য প্রচারের তালিকা থেকে বাদ যায়নি দেশের গণমাধ্যমও। ১০টি ঘটনায় দেশের একাধিক গণমাধ্যমে ভুল তথ্য প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
গত বছর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যম এবং ভারত থেকে পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ভুয়া তথ্য প্রচারের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
গেল ফেব্রুয়ারিতেও এই ধারাবাহিকতা দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। গত মাসে ভারতীয় গণমাধ্যমে ৯টি ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়িয়ে অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩টি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে ভুয়া তথ্যের প্রচার করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি গেল কিছু মাস ধরেই আলোচনায় রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে এমন ২০টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
এর মধ্যে অর্ধেক ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গেল মাসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে ১৬টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। ভুল তথ্যগুলোর ধরন বুঝতে এগুলোকে রিউমর স্ক্যানার দুটি আলাদা ভাগে ভাগ করেছে। সরকারের পক্ষে যায়, এমন ভুল তথ্যের প্রচারকে ইতিবাচক এবং বিপক্ষে যায়, এমন অপতথ্যের প্রচারকে নেতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়ে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, সাড়ে ৮৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই এসব অপতথ্য সরকারের বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ রেখেছে।
ফেব্রুয়ারিতে ১৬টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়েও। এর মধ্যে মাত্র ১৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই এসব অপতথ্য তার পক্ষে যাওয়ার সুযোগ রেখেছে। অন্যদিকে ৮১ শতাংশ ক্ষেত্রে ভুল তথ্যগুলো তার বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ রেখেছে।
সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে নিয়ে চারটি (সবগুলোই বিপক্ষে), নাহিদ ইসলামকে জড়িয়ে দুটি (সবগুলোই বিপক্ষে), আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে জড়িয়ে তিনটি (সবগুলোই বিপক্ষে) এবং আ ফ ম খালিদ হোসন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ড. আসিফ নজরুলকে জড়িয়ে একটি করে (সবগুলোই বিপক্ষে) এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলমকে জড়িয়ে তিনটি (সবগুলোই বিপক্ষে) ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার গেল মাসের ফ্যাক্ট চেকগুলো বিশ্লেষণে দেখেছে, এই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে (১৬) নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এসব ভুল তথ্যের সবগুলোই দলটির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করার সুযোগ রেখেছে। এই সময়ে দলটির ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগকে জড়িয়ে প্রচার হওয়া ৯টি ভুল (৭৮ শতাংশই পক্ষে) তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে এই সময়ে ১২টি ভুল তথ্য (৫৮ শতাংশই পক্ষে) প্রচারের প্রমাণ মিলেছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) জড়িয়ে গত মাসে একটি (বিপক্ষে) ভুল তথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। এই সময়ে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একটি (বিপক্ষে), ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে একটি (পক্ষে) এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে চারটি (সবগুলোই বিপক্ষে) ভুল তথ্যের প্রচার করা হয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে জড়িয়ে গত মাসে ১৩টি অপতথ্য (বিপক্ষে) শনাক্ত করা হয়েছে। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমানকে জড়িয়ে এই সময়ে তিনটি অপতথ্য (সবগুলোই বিপক্ষে) প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে এই সময়ে ১৬টি (সাড়ে ৮৭ শতাংশ বিপক্ষে) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। এই দলের শীর্ষ পদ অর্থাৎ আহ্বায়ক পদে রয়েছেন সদ্যই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদ থেকে সরে দাঁড়ানো নাহিদ ইসলাম। তাকে জড়িয়ে একটি অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে গত মাসে। এ ছাড়া বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ নামে নতুন একটি ছাত্রসংগঠনও গঠিত হয়েছে গত মাসে। এই সংগঠনকে নিয়েও একটি ভুয়া তথ্যের প্রচার দেখা গেছে ফেব্রুয়ারিতে।
ভুল তথ্যের রোষানল থেকে রক্ষা পায়নি রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোও। গেল মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে জড়িয়ে দুইটিসহ এই বাহিনীকে জড়িয়ে ৭ টি ভুল তথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের বিষয়ে ছড়ানো ৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর বাইরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে জড়িয়ে দুটি ভুয়া তথ্যের প্রচার ছিল ফেব্রুয়ারিতে।
কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতনের সময়টায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ফেব্রুয়ারিতে ১০টি অপতথ্যের শিকার হয়েছে। একই সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নিয়ে ১১টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে হাসনাত আবদুল্লাহকে জড়িয়ে ৫টি, সারজিস আলমকে নিয়ে তিনটি এবং খান তালাত মাহমুদ রাফি, নুসরাত তাবাসসুম ও আব্দুল হান্নান মাসুদকে জড়িয়ে একটি করে অপতথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
গেল মাসের ভুল তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, বিভিন্ন অঙ্গনের সুপরিচিত ব্যক্তি এবং বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে গত মাসে ১৪টি মৃত্যুর গুজব প্রচার করা হয়েছে।