মহসিন কবির: ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশবিরোধী অপতথ্য প্রচার করছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। এমন ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমের নাম উঠে এসেছে। মাইক্রোসফটের জরিপ অনুযায়ী, ৬০ শতাংশেরও বেশি অনলাইনে ভুয়া খবরের মুখোমুখি হয়েছেন; যেখানে এ হারের বৈশ্বিক গড় ৫৭ শতাংশ।
তবে মিথ্যা খবর ছাড়ালে ভারতে আইনও আছে, কিন্তু তার কার্যকর নেই। ভুয়া খবর ও শিশু পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ অ্যাপ ও ওয়েবসাইটগুলোর বিরুদ্ধে সাজা বাড়িয়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। প্রস্তাবিত আইনে বিধি লঙ্ঘন করলে অ্যাপ ও ওয়েবসাইটগুলোকে সরিয়ে দেওয়ার কঠোর সাজার ব্যবস্থা রাখা হবে। ২০১৯ সালে জানুয়ারি মাসে টাইমস অব ইন্ডিয়া অনলাইন এ খবর প্রকাশ করেছে।
আইনে সংশোধন আনার পর তা হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, গুগল, টুইটার ও টেলিগ্রামের মতো জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যমের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে। ভুয়া খবরের উৎস শনাক্ত করা, এনক্রিপশনের সুযোগ পাওয়া (এনক্রিপশন প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছাড়া আর কেউ তথ্যে প্রবেশ করতে পারে না), রাজনীতি ও নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে এমন বিষয়, শিশু হয়রানি ও প্রতিশোধমূলক পর্নো চিত্র ছড়ানোর ব্যাপারে এসব যোগযোগমাধ্যমের সঙ্গে সরকারের মতবিরোধ ছিল।
এক সরকারি কর্মকর্তা জানান, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এখন যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। এটা সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক আয় রয়েছে, সেই তুলনায় সাজা অনেক কম। ডেটা সুরক্ষা বিলে সাজা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে।
পুনিত ভাসিন নামের ভারতের একজন সাইবার আইন বিশেষজ্ঞের মতে, ভুয়া খবর ঠেকানোর প্রবণতা রোধে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনে খুব কমই ব্যবস্থা রয়েছে। ভারতের এমন কোনো আইন নেই, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই ইস্যুতে কাজ করতে বলা যায়। একমাত্র ভারতের দণ্ডবিধি অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
ভুল তথ্য-ভুয়া খবর প্রকাশে জেলের বিধান রেখে তুরস্কে নতুন একটি বিল পাস হয়েছে। দেশটির পার্লামেন্ট ১৪ অক্টোবর নতুন এ মিডিয়া আইন অনুমোদন করে।
আইন অনুসারে, গুজব, বিভ্রান্তিকর তথ্য বা ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করলে সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী ব্যক্তির তিন বছরের জেল হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বিল দেশে বাক-স্বাধীনতার বিষয়ে উদ্বেগ বাড়ায়।
নতুন আইনটিকে ‘সেন্সরশিপ বিল’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। বিলটি তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের অনুমোদনের জন্য গেছে। তিনি অনুমোদন করলেই এটি আইনে পরিণত হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তুরস্কের সরকার অনলাইন মাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোয় নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রেখেছে। যদিও বিরোধীরা মিডিয়া আউটলেটে সরকারি বিজ্ঞাপন ও ঘোষণাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
পাকিস্তানে কোনো ব্যক্তি যদি ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ৫ বছরের জেল অথবা ১০ লাখ রুপি জরিমানা করা হবে। প্রিভেনশন অব ইলেকট্রনিক ক্রাইম অ্যাক্ট, ২০১৬ (পিইসিএ) সংশোধনের কাজ শুরু করেছে পাকিস্তান সরকার। প্রাথমিকভাবে এতে প্রস্তাব করা হয়েছে। ৩ ডিসেম্বর এ তথ্য জানিয়ে অনলাইন জিও নিউজ বলেছে, খসড়া প্রস্তাবে পিইসিএ আইনের বড় রকমের পরিবর্তন প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর মধ্যে ডিজিটাল রাইটস প্রোটেকশন অথরিটি (ডিআরপিএ) নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি অনলাইনে কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা স্বার্থের বিরুদ্ধে ভুয়া তথ্য প্রচার করেন, তাহলে ডিআরপিএ’কে সেই পোস্ট ব্লক করে দেয়া বা সরিয়ে ফেলার কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
ভুয়া সংবাদের বিস্তার ঠেকাতে কঠোর আইন প্রণয়নের ঘোষণা দিয়েছেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ। পার্লামেন্ট অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় এ তথ্য জানিয়েছেন তিনি। স্পেনের পার্লামেন্ট এ সংক্রান্ত বিলটি উপস্থাপন করার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য সংবাদমাধ্যম অপরিহার্য, তবে সেই সংবাদমাধ্যমকে অবশ্যই মানসম্পন্ন হতে হবে। সংবাদমাধ্যম যদি বৈচিত্রময় ও নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ না করে, তাহলে জনগণ একপ্রকার অন্ধ হয়ে যায়।
নতুন এই বিল প্রসঙ্গে পেদ্রো সানচেজ আরও বলেন, গত মার্চ মাসে ইউরোপিয়ান মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্ট নামের যে আইনটি চালু করেছে ইউরোপের দেশগুলোর জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), তার আলোকে গঠন করা হয়েছে এই আইন। ইউরোপিয়ান মিডিয়া ফ্রিডম অ্যাক্টে একদিকে যেমন সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও মুক্ত সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংবাদিকদের গুপ্তচরবৃত্তি এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ইস্যুগুলো যেন সংবাদকর্মীদের নাগালের বাইরে থাকে সে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের তৎকালীন আইনমন্ত্রী বলেছেন, অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য রেজিস্ট্রেশনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অনলাইন নীতিমালা প্রণয়নে সরকার কাজ করছে। তিনি বলেন, সাইবার আদালত গঠন, গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ সেল গঠনের পাশাপাশি অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য রেজিস্ট্রেশনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আইনমন্ত্রী আরও বলেছেন, আমাদের দেশে পাঁচটি উদ্দেশে ভুয়া খবর প্রকাশ করা হয়। উদ্দেশ্যগুলো হলো সাম্প্রদায়িক গুজব ছড়ানো, উগ্র রাজনৈতিক ধর্মীয় মিথ্যাচার প্রচার, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং অবৈজ্ঞানিক জল্পনাকল্পনা প্রচার। ভুয়া খবরের প্রচার ও প্রকাশ বন্ধে বিটিআরসি, আইসিটি বিভাগ, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে।
আপনার মতামত লিখুন :