শিরোনাম

প্রকাশিত : ২৮ মার্চ, ২০২৫, ১১:২১ দুপুর
আপডেট : ৩১ মার্চ, ২০২৫, ০৪:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আজ জুমাতুল বিদা এবং আলকুদস দিবস

আবছার তৈয়বী, (আবুধাবি থেকে): আজ মাহে রমজানের শেষ শুক্রবার। জুমাতুল বিদা। পবিত্র জুমাতুল বিদায় মসজিদে মসজিদে রোজাদার মুসল্লিদের উচ্ছাসমুখর সরব উপস্থিতি ঘটবে। আজকের খোতবার মাধ্যমে মসজিদের খতিব সাহেবান মাহে রমজানকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানাবেন। ‘আল বিদা আল বিদা আল বিদা ইয়া রামাদ্বান, আল বিদা আল বিদা শাহ্রাল খায়র ওয়াল গুফরান’  ধ্বনির মাধ্যমে মাহে রমজানের বিদায়ের করুণ সুর ধ্বনিত হবে প্রতিটি মসজিদে।

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজানের বিদায়ের সানাই খতিব সাহেবানের মুখে মুখে করুণ সুরে বেজে উঠবে। তখন গভীর শূন্যতা ও বেদনায় আবেগ আপ্লুত হয়ে ওঠবে আল্লাহর প্রিয় বান্দাসহ সর্বস্তরের মুসল্লীরা। মাহে রমজান যাদের জীবনে রহমত ও কল্যাণের পরশ নিয়ে এসেছিল, তা বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে বেদনা, শূন্যতা ও হাহাকার ধ্বনিত হওয়াই তো স্বাভাবিক। একটি বছরের জন্য মাহে রমজানের বিদায়ে মুমিন মুসলমানরা যেন কোনোভাবেই সান্তনা খুঁজে পায় না।

আল্লাহর করুণা, ক্ষমা ও মুক্তির সওগাত রমজানের দিনগুলো ফুরিয়ে যাওয়া তাদের কাছে বিষাদতুল্য এবং অপ্রত্যাশিত বলেই মনে হয়। সিয়াম সাধনা, ইবাদত-রিয়াজত-বন্দেগি, দান-সদকাহ, জাকাত ফিতরা আদায় ও গরিব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অশেষ পুণ্যের আবাহনে যারা সিক্ত ও সমৃদ্ধ হয়, সেই মুমিন মুসলমানরা ভাবেন যদি সারা বছর এমন সুযোগ পাওয়া যেতো কতোই না ভালো হতো! মাহে রমজানের বিদায়ে মুমিন মুসলমানদের অন্তর জুড়ে এবং অস্তিত্ব জুড়ে আজ রক্তক্ষরণ ঘটছে। মন যে প্রবোধ মানে না। বিদায় বেলায় তারা গভীর কৃতজ্ঞতায় মহান আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর মেহমান ‘মাহে রমজান’কে হৃদয়ের গভীর মমতা দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে- আবারো ফিরে এসো আমায় ধন্য করতে হে মাহে রমজান! আজ জুমাতুল বিদার দিনে মুসল্লিদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জুমার নামাজ শেষে তারা একে অপরের সাথে হাত মিলাবে, মুসাফাহা-মুয়ানাকা করবে। বিগত দিনের সমস্ত বেদনা ও রেষারেষি ভুলে তারা পরম আনন্দে জান্নাতি খুশির আমেজে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের আলোয় ঝলসে উঠবে। এভাবে জয় হবে মনুষ্যত্বের, বিশ্ব মানবতার।  

প্রিয় পাঠক/পাঠিকা! গুরুত্বের দিক দিয়ে জুমার দিন এমনিতেই অনন্য। হাদিস শরীফে জুমার দিনকে ‘সায়্যিদুল আইয়াম’ বা সপ্তাহের প্রধান দিবস বলা হয়েছে। মাহে রমজান ছাড়াও জুমার দিনের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। মাহে রমজানে এই জুমার দিন আরো বেশি ফজিলতমণ্ডিত হয়ে থাকে। আর মাহে রমজানের শেষ জুমার দিনের গুরুত্ব কতটুকু- তা বলে শেষ করা যাবে না।

আগামী বছর বেঁচে থাকলেই কেবল আমরা এই দিন পাবো। যাদের হায়াতের বাজেট এক বছরেরও কম, তাদের জন্য আজকের এই দিনটি অবশ্যই মাহে রমজানের শেষ জুমা। তাই হৃদয়ের সব আবেগ-অনুভূতি এবং আশা ও ভালোবাসা দিয়ে প্রিয়নবী হযরত রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পবিত্র আহলে বায়তের উসিলা নিয়ে কায়মনো বাক্যে মহান আল্লাহর দরবারে আমাদের সকলেরই ফরিয়াদ করা উচিত। যাতে করে এই মাহে রমজানে আমাদের সকল গুনাহ মাফ হয় এবং আমাদের যেন আগামী বছরের মাহে রমজানও নসিব হয়। আমাদের রিযিক যেন   পায় এবং রোগ-শোক, দুঃখ-বেদনা, বালা-মুসিবত যেন দূর হয়। আমরা যেন বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগীতে করতে পারি এবং পরকল্যণ ও পরোপকারে যেন আমাদের জীবন অতিবাহিত হয়। 

উল্লেখ্য যে, ‘জুমা’ শব্দটি আরবি, যার অর্থ হচ্ছে একত্রিত হওয়া, দলবদ্ধ হওয়া, সমবেত হওয়া ইত্যাদি। পবিত্র কোরআনে এই দিনকে ‘ইয়াওমুল জুমা’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। প্রাক ইসলামী যুগে এই দিনটির নাম ছিল ‘ইয়াউমুল আরুবা’। আমাদের প্রিয়নবী হযরত রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরতের পর এই দিনকে জুমার দিন নামকরণ করেছেন এবং মদিনায় যাওয়ার পথে কুবা নামক স্থানে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে জুমার নামাজ আদায়ের নির্দেশ প্রদান করে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন, “হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো।

এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি করো।” (সুরা আল জুমুআ: ৯) রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি পরপর তিনটি জুমা বিনা ওজরে ও ইচ্ছা করে ছেড়ে দেবে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার অন্তরে মোহর মেরে দেবেন। (সুনানে আবু দাউদ) জুমার দিনে মুমিন-মুসলমানদের ইমানী সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই দিনের গুরুত্ব বর্ণনা করে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যেসব দিবসে সূর্য উদিত হয় তার মধ্যে উত্তম দিবস হচ্ছে জুমা, সেদিন আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে। একই দিনে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন। আবার পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করেন। এই দিনেই তিনি ইন্তেকাল করেন। এ জুমার দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এই পুণ্য দিনে এমন একটি সময় রয়েছে, যখন মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া কবুল হয়।’ (সুনানে তিরমিজি  ৪৯১, সুনানে আবু দাউদ: ১০৪৬)

নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন “যে ব্যক্তি জুমার দিনে ভালো করে গোসল করবে এবং আগে আগে পায়ে হেঁটে মসজিদে যাবে এবং ইমামের কাছাকাছি বসে খোতবা মনোযোগ সহকারে শুনবে আর কোনো রকম অনর্থক কাজ করবে না তাকে তার প্রতিটি কদমের বিনিময়ে লাগাতার এক বছর নামাজ ও রোজার সওয়াব দান করা হবে। (সুনানে ইবনে মাযা, হাদিস: ১০৮৭, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩৪৫, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদিস: ১৭০৩, সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ১৩৮৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৬১৭৬, সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ২৭৮১)

ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, রমজান মাসের শেষ জুমাবার আল্লাহর নবী হযরত সুলায়মান (আ.) জেরুজালেম নগরী প্রতিষ্ঠা করেন এবং আল্লাহর মহিমা তুলে ধরতে সেখানে র্র্নিমাণ করেন মুসলমানদের প্রথম কিবলাহ্ ‘মসজিদুল আকসা’। যে স্থানে মসজিদুল আকসা অবস্থিত সে স্থানসহ আশপাশের পুরো স্থানকেই ‘আলকুদস’ বা পবিত্র স্থান বলা হয়। মুসলমানদের কাছে মক্কা ও মদীনার পাশাপাশি আলকুদসও পবিত্র নগরী হিসেবে পরিচিত এবং ঈমানী অস্তিত্বের সাথে জড়িত। কারণ, মসজিদে আকসা থেকে আমাদের প্রিয়নবী হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম মিরাজে গমন করেছিলেন। মসজিদে আকসা ও  আশপাশের পুরো এলাকাকেই আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বরকতময়  স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছেন। (সূরা বনী ইসরাইল: ০১)

হযরত উমরের (রা.) শাসনামলে এই আলকুদস বা জেরুজালেম নগরী মুসলমানরা জয় করেন। এর পর ১০৯৬ খৃস্টাব্দে ইউরোপের ক্রুসেডার খৃস্টানরা সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন হয় পুরো জেরুজালেম নগরী  দখল করে নেয়। এরপর ১১৮৭ সালে সালাউদ্দীন আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করে। এর পর ১৯১৭ সালে বৃটিশরা আবার ফিলিস্তিন দখল করে এবং স্যার হার্বট স্যামুয়েল নামক একজন ইহুদিকে সেখানে কমিশনার নিযুক্ত করে। এভাবে জমি কেনার মাধ্যমে বহিরাগত ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনের দরজা খুলে যায়। পশ্চিমা সাজ্যবাদী শক্তি যায়নবাদী ইহুদিদের স্থায়ীভাবে বসতির জন্য শত কোটি ডলার সহয়তা প্রদান করে। যার ফলে ১৯৪৮ সালে ১৫ মে ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইহুদিরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। তারা স্থানীয় ভূমিপূত্র ফিলিস্তিনী মুসলমানদের ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছদ ও হত্যা করতে থাকে। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মুসলমানদের প্রথম কিবলা ‘বায়তুল মোকদ্দাস’ মুসলমানদের হাতছড়া হয়ে যায়।  এর পর থেকে ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণ তাদের আবাসভূমি আলকুদ্স (বায়তুল মোকাদ্দাস) মুক্তির লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। গেল দুই বছর থেকে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল গাজার মুসলমানদের ওপর নিরি¦চারে বোমা হামলা করে আসছে। নতুন করে শুরু হওয়া এই বোমা হামলায় এ পয়ন্ত নারী-শিশুসহ ৫০ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনী মুসলমান শাহাদাত বরণ করেছেন।

তারা যায়নবাদী ইহুদিদের হাতে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হতে থাকে। আশেপাশের আরব রাষ্ট্র, আরব লীগ এবং ওআইসিসহ মুসলিম শক্তিধর দেশগুলো কখনো কখনো কাগুজে বিবৃতি ও নিন্দাপ্রস্তাব প্রকাশ করলেও র্কাযকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অথচ অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, “তোমাদের কি হলো যে, তোমরা সংগ্রাম করবে না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য? যারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এই জনপদ-যার অধিবাসী জালিম, তা থেকে আমাদের অন্যত্র নিয়ে যাও; তোমার কাছ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক করো এবং তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের সহায় করো।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৭৫)

আবছার তৈয়বী: লেখক, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ। প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি: প্রবাসী সাংবাদিক সমিতি (প্রসাস), দুবাই, ইউ.এ.ই।  চেয়ারম্যান: আহলে বায়ত (আ.) ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র, আবুধাবি, ইউ.এ.ই।

 E-mail:muntyping@gmail.com

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়