শিরোনাম
◈ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরুরি নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের শ্রেণিমুখী করতে ◈ সেনাবাহিনীকে হামলার বদলা নিতে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দিলেন মোদি ◈ মূল সড়কে চলবে না ব্যাটারিচালিত রিকশা ◈ বাংলাদেশি হজযাত্রীদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিল সৌদি সরকার  ◈ আজারবাইজানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চান প্রধান উপদেষ্টা ◈ বিদ্যুতের দামে সমতা চায় ডেসকো-ওজোপাডিকো ◈ সারাভারতে বাজছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অসংখ্য ঘৃণাপূর্ণ সঙ্গীত ◈ অপকর্ম বন্ধ না করলে বিএনপিকেও ছুড়ে মারবে জনগণ: মির্জা ফখরুল ◈ বাংলাদেশিকে ধরতে এসে পা ধরে মাফ চাইল বিএসএফ (ভিডিও) ◈ ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে গুজরাটে আটকদের অধিকাংশই ভারতীয় মুসলিম

প্রকাশিত : ২৯ এপ্রিল, ২০২৫, ০৬:২৯ বিকাল
আপডেট : ২৯ এপ্রিল, ২০২৫, ১১:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে গুজরাটে আটকদের অধিকাংশই ভারতীয় মুসলিম

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। শনিবার ভোররাত থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে আটক করেছে ভারতের গুজরাটের পুলিশ। তাদের সন্দেহ, আটক ব্যক্তিরা বাংলাদেশের নাগরিক। তবে নিশ্চিতভাবে ৪৫০ জন বাংলাদেশিকে চিহ্নিত করা গেছে বলে সোমবার জানিয়েছেন রাজ্য পুলিশের মহা-নির্দেশক বিকাশ সহায়।

বার্তা সংস্থা পিটিআই সোমবার রাতে বিকাশকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, নথির ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা গেছে যে, ৪৫০ জন বাংলাদেশি নাগরিক বেআইনিভাবে এখানে থাকছিলেন। আটক হওয়া বাকিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমাদের মনে হচ্ছে, একটা বড় সংখ্যায় বেআইনি বাংলাদেশিদের পরিচয় আমরা নিশ্চিত করতে পারব।

শনিবার ভোররাত থেকে প্রথমে আহমেদাবাদ ও সুরাটে এবং তারপরের দু’ দিনে পুরো গুজরাটেই ‘বেআইনি বাংলাদেশি’ আটক করার জন্য অপারেশন চালায় পুলিশ।

‘রাত ৩টা নাগাদ পুলিশ আসে আমাদের বাসায়। আমার স্বামী, বাচ্চাদের– সবার আধার কার্ড দেখতে চায়। তারপরে তারা আমার স্বামী আর দুই ভাগ্নেকে নিয়ে যায়। ওরা বলেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে আমার স্বামী। কিন্তু প্রায় তিনদিন হতে চলল, তিনি ফেরেননি,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন সুরাট থেকে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক হওয়া সুলতান মল্লিকের স্ত্রী সাহিনা বিবি।

যেদিন প্রথম অভিযান শুরু হয়, সেদিনই আটক হন সুলতান ও তার দুই কিশোর ভাগনে।

বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হলেও সুলতান মল্লিকের পাসপোর্ট ও ১৯৯৩ সালের একটি জমির দলিল হাতে পেয়েছে বিবিসি বাংলা। এতে দেখা যাচ্ছে, তিনি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর অঞ্চলের বাসিন্দা।

পশ্চিমবঙ্গের সুলতান মল্লিক কেন আটক?

সুলতান মল্লিক বছর ছয়েক ধরে সুরাটে এমব্রয়ডারির কাজ করেন। তার স্ত্রীর কথায়, প্রথমে তো জানতেই পারিনি কোন থানায় নিয়ে গেছে, কোথায় রেখেছে। শনিবার বেলার দিকে আমার স্বামী পুলিশের একটি নম্বর থেকে ফোন করে জানান, তাদের কোনও একটা গুদাম ঘরে রেখেছে। সব নথি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে বলেন আমার স্বামী। পাসপোর্ট, জমির দলিল– যা যা প্রমাণ ছিল, সব পাঠিয়েছি। কিন্তু তারপর থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত আর কোনও যোগাযোগ নেই। এদিকে আমার শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তার ছেলের এই দশা দেখে, আমার বড় মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। মাত্র এক বছর হলো আমি গুজরাটে এসেছি– এখন কোথায় স্বামীর খোঁজ করতে যাব বুঝতে পারছি না।

পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে, এমন একটি সংগঠন ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’ গুজরাটের ধরপাকড় শুরু হওয়ার পরে একটি হেল্পলাইন খুলেছে। প্রিয়জনের খোঁজ পাওয়ার জন্য ওই হেল্পলাইনে গত দু’ দিনে ১০০রও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক।

গুজরাটে সংখ্যাটা বড়, তাই বিষয়টা ব্যাপক আলোচনায় উঠে এসেছে। কিন্তু উত্তর প্রদেশ, উড়িষ্যা আর মহারাষ্ট্রেও পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে হেনস্তা করার ঘটনা খুব বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতি হতে যাচ্ছে এই আশঙ্কা করে গত সপ্তাহে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে একটা চিঠিও দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে কাজ যে কিছু হয়নি, দেখাই যাচ্ছে,’ বলছিলেন আসিফ ফারুক।

তার কথায়, আরও একটা গুরুতর বিষয় জানতে পারলাম সুলতান মল্লিকের ব্যাপারে। আটক হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আদালতে পেশ করার কথা। কিন্তু তিনদিন হয়ে গেলেও এখনও আদালতে পেশ করা হলো না কেন?

বরযাত্রীদের ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ

কথিত ‘বাংলাদেশিদের’ খোঁজে অপারেশন শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে আহমেদাবাদ পুলিশের ‘ক্রাইম ব্রাঞ্চ’ দফতরের সামনে বিবিসি গুজরাটির সংবাদদাতা তেজশ ভৈদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ফারজানার। মেহেদি লাগানো হাত দেখিয়ে তিনি একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে একটি বিয়ের কার্ড বের করেন।

ফারজানা বলেন, বাড়িতে বিয়ে আছে। বরযাত্রীরা এসেছিল। আমাদের বাড়ি খুবই ছোট, তাই তাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছিলাম চান্দোলা এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখান থেকেই বাংলাদেশি সন্দেহ করে বরযাত্রীদের ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।

‘মহারাষ্ট্রের আকোলা থেকে এসেছিল আমার বড় ভাই আর ভাতিজা। তারা না থাকলে কী করে বিয়ে হবে! ওইদিনই বাড়িতে হলদি (গায়ে হলুদ) অনুষ্ঠান ছিল। সেটিও পিছিয়ে দিতে হয়েছে, বলেন ওই নারী।

এই বিয়েতেই সপরিবারে এসেছিলেন জেবুন্নেসা। তার ছেলে আর ভগ্নীপতিকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে। তার কথায়, আমরা মহারাষ্ট্রের আকোলা থেকে বিয়েতে যোগ দিতে এসেছিলাম বরযাত্রী হিসেবে। আমাদের কাছে জন্মের প্রশংসাপত্র থেকে শুরু করে আধার কার্ড সব আছে।

বিয়ে বাড়ি ছেড়ে সারাদিন খাওয়া-দাওয়া না করে তারা বসেছিলেন ক্রাইম ব্রাঞ্চের দফতরে। সব নথিপত্র জমা দেওয়ার পরে শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সবাইকে ছাড়া হয়।

ফারজানা বা তার আত্মীয়রা কেউ বাংলাদেশি নন, এমনকি বাংলাভাষীও নন। তারা গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের মুসলিম।

আহমেদাবাদের বাসিন্দাও আটক

ক্রাইম ব্রাঞ্চের দফতরেই বিবিসির তেজস ভৈদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আলমআরা পাঠান নামে এক নারীর।

তিনি বলছিলেন, “আমি তো সৈয়দবাড়ি মোহাম্মদী মসজিদ এলাকায় থাকি। গত ২৩ বছর ধরেই আহমেদাবাদে আছি। আমার ছেলে রিয়াজের শ্বশুরবাড়ি চান্দোলা ঝিল এলাকায়। রাতে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল ও, সেখান থেকে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। আমার পুত্রবধূকেও আটক করা হয়েছে।

“আমাদের কাছে আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র, আয়কর বিভাগের প্যান কার্ড, বিদ্যুতের বিল– সব নথিই আছে। পুলিশ আমাকে জানায় যে, সব নথি নিয়ে হাজির হলে ছেলে আর ওর বউকে ছেড়ে দেবে। সকাল ১০টা থেকে এখানে বসে আছি,” বলছিলেন আলমআরা পাঠান।

রাত ১০টা নাগাদ তার ছেলে ও পুত্রবধূকে ছেড়ে দেয় পুলিশ, তবে আবারও তাদের দেখা করতে বলা হয়েছে।

আলমআরা পাঠান বলছিলেন, “আমরা তো বাংলাদেশ থেকে আসিনি, অপরাধও করিনি। আমার সন্তানরা এখানেই জন্মেছে। তবুও বুঝতে পারছি না ছেলে আর তার স্ত্রীকে কেন আটক করা হলো।”

পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার এক বাসিন্দা আটক

‘বাংলাদেশি’ ধরার অভিযান প্রথমে আহমেদাবাদ আর সুরাটে শুরু হলেও গত দু’দিনে তা ছড়িয়েছে পুরো গুজরাটেই।

ভারুচেও চলেছে সেই অপারেশন

সোমবার কাপড় কলে সারাদিন কাজ করার পর বিকালে চা খেতে বেরিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার সাঁকরাইলের বাসিন্দা নূর শেখ।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “কাজের পরে বিকালে চা খেতে যাচ্ছিলাম বড় রাস্তায়। সেদিকে যেতেই এক বন্ধু বলল একটু আগে হাওড়ারই এক বাসিন্দাকে দোকানের সামনে থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। আমি তখনও গলির ভেতরেই ছিলাম।”

“বাংলাদেশিদের ধরবে ধরুক। কিন্তু আমরা তো ভারতীয়। দরকার হলে আধার চেক করে দেখুক। অন্য সব নথিও আছে। কিন্তু ধরে নিয়ে গিয়ে এরকম হেনস্থা করার কী মানে?” বলেন নূর শেখ।

‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক বলছিলেন, “নূর শেখ যে অঞ্চলে থাকেন, সেই ভারুচ জেলার কোটকপুর এলাকায় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও হাওড়া জেলার প্রায় এক হাজার জনের বেশি শ্রমিক আছে। গুজরাট পুলিশ এসে এই শ্রমিকদের ডকুমেন্ট চেক করে গেছে।”

গুজরাট পুলিশের সন্দেহ আধার কার্ড বা ভোটার পরিচয়পত্রসহ নথি বাংলাদেশিরাও বানিয়ে নিতে পারে। তাই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়সহ বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া কয়েকটি রাজ্যে গুজরাট পুলিশ তাদের দল পাঠাচ্ছে। যেসব পরিচয়পত্র জমা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আসল না কি নকল, সেটা সরেজমিনে তদন্ত করে দেখবে গুজরাট পুলিশের দলগুলো।

অন্য রাজ্যেও বাঙালি মুসলমানদের হেনস্থা

‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’ বলছে তাদের কাছে সারাদেশ থেকে অন্তত একশ’টি অভিযোগ জমা পড়েছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে ‘বাংলাদেশি’ অভিহিত করে হেনস্থা, মারধর করা হয়েছে।

ওই সংগঠনটির কাছে অভিযোগ এসেছে যে ১৮ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার ২৩ জন ফেরিওয়ালাকে উত্তরপ্রদেশের কুশিনগরে বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে দেয় ও বাংলাভাষায় কথা বলার জন্য মারধর করে স্থানীয়রা। এরপরে ওই আক্রান্তদেরই পুলিশ হেফাজতে নেয়, একদিন পরে তারা ছাড়া পান।

আবার ২১ এপ্রিল মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ থেকে ৬০ জন পরিযায়ী শ্রমিক বাসে করে কর্মক্ষেত্র ওড়িশার কেওনঝড়ের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন বলে জানায় ওই সংগঠনটি। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার জসিপুরে সকাল বেলায় বাস পৌঁছানোর পর স্থানীয়রা তাদের বাংলাদেশি বলে হেনস্থা ও মারধর করে। পরে তারা মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন।

ওই মুর্শিদাবাদেরই সামশেরগঞ্জের এক বাসিন্দা ঈদের পর ফেরিওয়ালা হিসেবে জিনিসপত্র বিক্রি করতে ওড়িশার ভদ্রক টাউন থানা এলাকায় গেলে তাকে ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে হেনস্থা করা হয় বলে অভিযোগ পেয়েছে ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’।

সংগঠনটির প্রধান আসিফ ফারুক বলেন, “এরকম প্রচুর অভিযোগ পাচ্ছি আমরা। সেই ২০১৪ সাল থেকেই এগুলো চলছে আর দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পেহেলগাঁওকাণ্ডের পরে তো আরও বেড়েছে এটা। কোথাও স্থানীয় পুলিশ, কোথাও বা ছোটখাটো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের লোকজন পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা করছে, মারধর করছে। সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

“ভারতের নাগরিক হিসেবে কী দেশের যেকোনও জায়গায় গিয়ে কাজ করার বা ব্যবসা করার অধিকার নেই বাংলাভাষী আর মুসলমান বলে?” প্রশ্ন আসিফ ফারুকের। 

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়