বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। দুই পক্ষই প্রতিশোধমূলক পাল্টপাল্টি পদক্ষেপ নিয়েছে।
মঙ্গলবারের (২২ এপ্রিল) ঘটনার পর দ্রুত কতগুলো সিদ্ধান্ত জানায় দিল্লি। এই তালিকায় সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত, প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া, পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা বন্ধ এবং কূটনীতিকদের বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্তও রয়েছে।
জবাবে পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। জানানো হয়েছে, ভারত আর পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারবে না। সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ থাকবে। ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিও স্থগিতের ঘোষণা করেছে পাকিস্তান।
সিমলা চুক্তি স্থগিতের দাবি কেন
ভারতের দিক থেকে সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের পরপরই পাকিস্তানের ভেতরে সিমলা চুক্তি স্থগিতের দাবি উঠেছিল। পাকিস্তান এই চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দেশটির অনেক নাগরিক মনে করছেন, এতে তারা উপকৃত হবেন।
এর পেছনে তারা যুক্তি দিয়েছেন, সিমলা চুক্তি পাকিস্তানকে কাশ্মীর ইস্যুর আন্তর্জাতিকীকরণ থেকে বিরত রেখেছে। ওই চুক্তি স্থগিত হলে পাকিস্তান কোনো ধরনের কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াই আন্তর্জাতিক ফোরামে কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপন করতে পারবে।
তবে সিমলা চুক্তির অধীনে থাকা অবস্থাতেও অবশ্য পাকিস্তান তা করেছে। কিন্তু পাকিস্তানি বিশ্লেষকদের মতে, সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাশ্মীর ইস্যু ‘আরও জোর গলায়’ তুলে ধরতে পারবে পাকিস্তান।
সিমলা চুক্তি কী?
সিমলা চুক্তি এমন একটা আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছিল যা দুই দেশের মধ্যে ‘শত্রুতা’ অবসানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের পর ১৯৭২ সালের জুলাইতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এই চুক্তি।
তার মাস ছয়েক আগেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পাকিস্তানের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪৫ হাজার সৈন্য এবং আধাসামরিক বাহিনীসহ ৭৩ হাজার যুদ্ধবন্দি ভারতের কারাগারে ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় পাঁচ হাজার বর্গমাইল এলাকাও ভারতের দখলে ছিল।
এই পটভূমিতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের হিমাচল প্রদেশের সিমলায় বৈঠক করছিলেন। সেখানে যে সমঝোতা হয় তার নাম সিমলা চুক্তি।
চুক্তির দলিল স্বাক্ষরের তারিখ রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৭২ সালের ২ জুলাই। তবে বাস্তবে ৩ জুলাই সকালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এই চুক্তি।
দুই দেশের মধ্যে ‘শত্রুতা’ অবসানের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সমঝোতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সিমলা চুক্তির বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল।
সিমলা চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব সমস্যার সমাধান করবে।
সিমলা চুক্তির অধীনে দুই দেশের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) গঠিত হয়। সেই সময় ভারত-পাকিস্তান দুইপক্ষই এই নিয়ন্ত্রণ রেখাকে সম্মান জানাতে রাজি হয়। তারা এই বিষয়েও সম্মত হয়েছিল যে দুইপক্ষ কোনো ধরনের একতরফা সিদ্ধান্ত নেবে না।
নিয়ন্ত্রণ রেখাকে স্কেল হিসেবে বিবেচনা করে একে অপরের ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান।
কিন্তু পরবর্তীতে দুই দেশই একে ওপরের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ রেখাকে ‘না মানার’ অভিযোগ তুলে এসেছে।
মৃত চুক্তি?
গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) সিনিয়র ফেলো সুশান্ত সারিন পাকিস্তান বিষয়ক পর্যবেক্ষক। তার মতে, সিমলা চুক্তি থেকে পাকিস্তানের বেরিয়ে যাওয়া মোটেও ভারতের জন্য কোনো ধাক্কা নয়।
তিনি বলেছেন, কাশ্মীর ইস্যুতে বড় সিদ্ধান্ত নিতে বরং এটা ভারতকে সাহায্য করবে। পাকিস্তান অনেক আগেই সিমলা চুক্তি থেকে সরে এসেছে। তারা কখনোই এই চুক্তিতে অটল থাকেনি।
সুশান্তের মতে, পাকিস্তান যদি এই চুক্তি মেনে নিতো, তাহলে তারা কার্গিলের যুদ্ধ করতো না। প্রতিদিন আমরা সীমান্তের ওপার থেকে গুলি চালাই না এবং সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়ও দেই না। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান যদি মৃত চুক্তির সৎকার করতে চায়, তাহলে তা করুক।
কাশ্মীরি গবেষক ও আইনবিদ তথা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো মির্জা সায়ব বেগ অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন। তার মতে, সিমলা চুক্তি শুধু কার্যকর নয়, দুই স্বাক্ষরকারী দেশও তা বাস্তবায়ন করতেও বাধ্য।
‘সিমলা চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য ভারতকে জবাবদিহি করাতে বা এই নিয়ে আন্তর্জাতিক কোনো দাবি না তুলতে পারাটা পাকিস্তানের অযোগ্যতা। সিমলা চুক্তিতে একতরফা সিদ্ধান্তের কোনো ধারণা নেই।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, পাকিস্তান তাদের অধিকারের অধীনে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে (আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত) ভারতের বিরুদ্ধে ওই চুক্তিকে লঙ্ঘনের অভিযোগ জানিয়ে মামলা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান কেন এমনটা করেনি সেটা তারাই জানে।
পাকিস্তান কী বলছে?
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তার আমলে ভারতের সঙ্গে আলোচনা সিমলা চুক্তির সীমারেখার মধ্যে থেকেই হয়েছিল কি না। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এখন এই অঞ্চলের পরিস্থিতি সিমলা চুক্তির যুগ পার করে গেছে। গত দশকেও লাহোর চুক্তি, ইসলামাবাদ চুক্তির কথা মাথায় রেখে আলাপ আলোচনা এগোচ্ছিল। যে কারণে দুই দেশ আলাপ আলোচনা করছিল।
ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। তার কথায়, সিমলা চুক্তিতে দ্বিপাক্ষিক ও শান্তিপূর্ণভাবে বিতর্কিত বিষয়গুলো সমাধানের কথা বলা হলেও ভারত একতরফা পদক্ষেপের মাধ্যমে কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা পরিবর্তন করেছে, যা এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
তবে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে সিমলা চুক্তি বাতিল করা সম্ভব নয়। ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, মোদীর পদক্ষেপে এই চুক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আমি এটি বাতিল করতে পারি না। কারণ (সবসময়) সরকার এবং নীতি এক থাকে না।
ভারতের ওপর প্রভাব পড়বে?
জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল কি সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন? এই প্রশ্নের উত্তরে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক মহেন্দ্র পি লামা বলেছেন, ৩৭০ ধারা বিলোপের বিষয়টি সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন ছিল না। ৩৭০ ধারা ভারতীয় সংবিধানের বিষয় ছিল এবং সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতা সংসদের রয়েছে।
তার মতে, সিমলা চুক্তি স্থগিত হলে তার প্রভাব ভারতে পড়বে না।
অধ্যাপক মহেন্দ্র লামা বলেন, পাকিস্তান সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে ভারতের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়বে না। এমনিতেও পাকিস্তানকে মোকাবিলা করা যাবে এবং সেটা শুধু বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, সিমলা চুক্তির মাধ্যমে নয়।
‘সিমলা চুক্তির এখন কোনো অর্থ নেই। পাকিস্তান প্রতিদিনই তা লঙ্ঘন করছে। সুতরাং এটা ভালো বিষয় যে তারা এখন চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসছে।’