বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বে বিচারপতি সঞ্জয় কুমার ও কেভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ সংশোধিত ওয়াক্ফ আইন স্থগিতের ঘোষণা দেন।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সংশোধিত ওয়াক্ফ আইনের বিরুদ্ধে করা মামলার শুনানিতে এই আইনের বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে। বুধবার (১৬ এপ্রিল) আইনটির বিরুদ্ধে করা ৭৩টি পিটিশনের শুনানি শুরু হয়। পরে বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বে বিচারপতি সঞ্জয় কুমার ও কেভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ সংশোধিত ওয়াক্ফ আইন স্থগিতের ঘোষণা দেন।
আইন স্থগিতের পর সরকারের পক্ষ থেকে আদালতকে নিশ্চিত করা হয়, পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত ওয়াক্ফ বোর্ডে নতুন নিয়োগ বা সম্পত্তির অবস্থা পরিবর্তন করা হবে না। পুরোনো ওয়াক্ফ এবং ‘ওয়াক্ফ বাই ইউজার’ সম্পত্তিও আগের মতো থাকবে। তবে আদালতের এই সিদ্ধান্তের পরও দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে।
‘ওয়াক্ফ বাই ইউজার’ এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধর্মীয় বা দানের কাজে ব্যবহৃত সম্পত্তিকে ওয়াক্ফ হিসেবে দাবি করতে পারে, এমনকি কাগজপত্র না থাকলেও। নতুন আইনে বলা হয়েছে, বিরোধপূর্ণ বা সরকারি জমিতে এটি প্রযোজ্য হবে না। গতকালের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা শুনেছি, দিল্লি হাইকোর্ট ওয়াক্ফ জমির ওপর। সব ওয়াক্ফ বাই ইউজার ভুল নয়।’
তিনি জানান, ১৩শ, ১৪শ বা ১৫শ শতাব্দীর মসজিদের জন্য কাগজপত্র পাওয়া অসম্ভব। তিনি সরকারকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কি বলছেন, আদালতের রায়ে প্রতিষ্ঠিত ওয়াক্ফ এখন বাতিল হবে? আইন দিয়ে আদালতের রায় বাতিল করা যায় না।’
আইনজীবী কপিল সিবাল বলেন, ‘হাজার বছর আগে ওয়াক্ফ তৈরি হলে এখন কাগজপত্র চাওয়া সমস্যা।’ আইনজীবী অভিষেক সিংভি জানান, ভারতের আট লাখ ওয়াক্ফ সম্পত্তির মধ্যে চার লাখই ওয়াক্ফ বাই ইউজার।
এদিকে নতুন আইনে কেন্দ্রীয় ওয়াক্ফ কাউন্সিল ও রাজ্য ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য রাখার বিধান আছে। এতে মুসলিম সদস্যের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। কাউন্সিলে ২২ জনের মধ্যে ৮ জন এবং রাজ্য বোর্ডে ১১ জনের মধ্যে চার জন মুসলিম থাকবে। এই বিধান মুসলিম সম্প্রদায় ও বিরোধী দলগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে।
প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না সরকারের আইনজীবী তুষার মেহতাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা কি হিন্দু দেবোত্তর বোর্ডে মুসলিম সদস্য রাখতে দেবেন? খোলাখুলি বলুন।’ তিনি আরও বলেন, এই আইন নিয়ে সহিংসতা ‘খুবই উদ্বেগজনক’।
বৃহস্পতিবার সরকার জানায়, নতুন আইনের ৯ ও ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনো নিয়োগ করা হবে না। এই ধারাগুলো কাউন্সিল ও বোর্ডে সদস্য নিয়োগের বিষয়ে। সরকারের আইনজীবী তুষার মেহতা মামলার জবাব দেয়ার জন্য এক সপ্তাহ সময় চান, যা আদালত মঞ্জুর করেছে। আদালত বলেছে, আবেদনকারীরা সরকারের জবাবের পর পাঁচ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবেন।
সুপ্রিম কোর্ট ৭৩টি পিটিশনের মধ্যে পাঁচটি নিয়ে আলোচনা করবে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘১০০ বা ২০০টি পিটিশন নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। বাকিগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে বলে ধরা হবে।’
এর আগে বুধবার আদালত সংশোধিত ওয়াক্ফ আইনের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সময় চাওয়ায় পিছিয়ে যায়। হিংসাত্মক বিক্ষোভ বন্ধ করতে স্থগিতাদেশের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়।
প্রসঙ্গত, চলতি মাসে সংসদে ওয়াক্ফ আইন সংশোধনের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, যা তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তৃণমূল বলেছে, তারা এই আইন রাজ্যে কার্যকর করবে না। বিজেপি অভিযোগ করেছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী নির্বাচনের আগে ‘তোষণের রাজনীতি’ করছেন।
বিরোধী দলগুলো—কংগ্রেস, আপ, ডিএমকে, সিপিআই—এই আইনের বিরোধিতা করেছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারের জেডিইউ, যারা বিজেপির সঙ্গে জোটে আছে, এটির বিরোধিতা করছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিহারে মুসলিম জনসংখ্যা বেশি এবং এই বছর সেখানে বিধানসভা নির্বাচন হবে। জমিয়ত উলামা-ই-হিন্দ ও অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের মতো ধর্মীয় সংগঠনও আপত্তি জানিয়েছে। কিছু আবেদনকারী আইন বাতিলের দাবি করেছেন, অন্যরা স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন। সূত্র : এনডিটিভি