নন্দাকিনী নদীর তীরে রোজ সকাল আটটায় নিজের ড্রাই ক্লিনিংয়ের দোকানের বাদামি শাটার খুলে কাজ শুরু করেন আহমেদ হাসান। উত্তর ভারতের হিমালয় অঞ্চলের উত্তরাখন্ড রাজ্যের নন্দনগরে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন তিনি।
সকালে দোকান খুলে নিত্যদিনের কাজ শুরু করেন হাসান। শুকনো পদ্ধতিতে পরিষ্কার (ড্রাই ক্লিনড) করা কাপড় নিজের দোকানের গোলাপি দেয়ালের প্লাস্টিক কভারে সুচারুভাবে ঝুলিয়ে রাখেন। এরপর ৪৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তি গ্রাহকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। খবর: আল জাজিরা
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মধ্যাহ্নভোজের আগে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক হাসানের কাছে আসতেন। শেরওয়ানি, স্যুট, কোট, প্যান্ট এবং শীতকালীন পোশাক তাঁর কাছে পরিষ্কার করতে দিতেন। কোনো কোনো গ্রাহক তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতেন। চা খেতে খেতে রাজনীতি নিয়ে আলাপ ও মজা করতেন, হাসি–আনন্দ ও সুখ-দুঃখ বিনিময় করতেন। গ্রাহকদের বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু, অল্প কিছু ছিলেন মুসলিম।
কিন্তু ১২ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত পাঁচজনেরও কম হিন্দু গ্রাহক হাসানের দোকানে এসেছেন। তিনি জানান, কোনো মুসলিম গ্রাহকের আশায় থাকা বৃথা। এ সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।
নন্দনগরে এখন হাসানই একমাত্র মুসলিম পুরুষ। অথচ এই শহরে কয়েক মাস আগেও ১৫টি মুসলিম পরিবার ছিল, যারা বংশপরম্পরায় এখানে বসবাস করে আসছিল। হাসানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। পূজা-পার্বণে হিন্দুরা তাঁদের নিমন্ত্রণ করতেন। আর ঈদের সময় হিন্দু প্রতিবেশীদের তাঁরা দাওয়াত দিতেন। প্রতিবেশী হিন্দু মারা গেলে শবদাহের জন্য তিনি কাঠ সংগ্রহ করতেন, হিন্দু বন্ধুদের মরদেহ কাঁধে বহন করে শ্মশানে নিয়ে গেছেন।
কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে এই এলাকায় মুসলিমবিরোধী সহিংসতা শুরুর পর এ সবকিছু রাতারাতি বদলে গেছে। এক হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এ সহিংসতা শুরু হয়েছিল। তবে নন্দনগরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে মন–মানসিকতায় আরও আগে থেকেই বড় পরিবর্তন সূচনা হয়েছিল, যা করোনাকাল থেকে খেয়াল করে আসছিলেন হাসান।
গত সেপ্টেম্বরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে শারীরিক হামলার আগে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ঘৃণামূলক স্লোগান দেওয়া হতো। মুসলিমবিরোধী কিছু বিক্ষোভও হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রাণভয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা রাতের আঁধারে নন্দনগর ছেড়ে পালিয়ে যান।
হাসানও পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসেন। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ছোট্ট শহর আবার মুসলিমদের বসবাসের উপযোগী করার ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ, এটাই তাঁদের জন্মভূমি। কিন্তু হাসানের পরিবারকে সেখানে এখনো ভয়ে ভয়েই থাকতে হচ্ছে।
হিন্দু প্রতিবেশীরা এখন হাসানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন না। আগে তিনি সন্ধ্যায় নিয়মিত নন্দাকিনী নদীর তীরে হাঁটতে গেলেও এখন যান না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের কারও সঙ্গে দেখা করতে দেন না। তাঁর আশঙ্কা, আবারও সহিংসতা দেখা দিতে পারে।
হাসান বলেন, ‘আমি সোজা দোকানে যাই, দোকান থেকে বাসায় আসি। সারাটি জীবন এই শহরে কাটালেও নিজেকে আমার এখন ভূত বলে মনে হয়। আমি যেন সম্পূর্ণ অদৃশ্য। এমনকি কেউ আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলছেন না।’
‘মুসলিমদের জুতা দিয়ে পেটাও’
রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে গাড়িতে করে নন্দনগর যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। ভারত-চীন সীমান্তের কাছাকাছি স্থানের এই শহরটি নন্দাকিনীর কয়েকটি উপনদীর সংগমস্থলে অবস্থিত। গঙ্গার ছয়টি উপনদীর একটি হলো নন্দাকিনী, যাকে হিন্দুরা পবিত্র বলে বিশ্বাস করেন। শহরটি জনসংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
হাসানের দাদা পার্শ্ববর্তী উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বিজনৌর জেলার নাজিবাবাদ শহর থেকে ১৯৭৫ সালে নন্দনগরে এসেছিলেন। তাঁদের পরিবার সেখানেই বসতি গড়ে। পরের বছর হাসানের জন্ম হয়।
হাসান বলেন, ২০২১ সাল পর্যন্ত এখানকার পরিবেশ মোটাদাগে শান্তিপূর্ণ ছিল। করোনাভাইরাসের সময় পুরো ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপপ্রচার চালানো হয়। হিন্দুদের উগ্র ডানপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী অপপ্রচার চালাতে থাকে—ধর্মীয় চর্চা এবং বড় জমায়েত মাধ্যমে মুসলিমরা ইচ্ছাকৃতভাবে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছেন। তখন উগ্র ডানপন্থীরা করোনাভাইরাসকে ‘করোনা জিহাদ’ নামে আখ্যায়িত করেছিল।
এ অবস্থায় একটা সময় হাসান লক্ষ করেন, হিন্দু বন্ধুরা তাঁর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন। তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯–এর আগে ঈদে প্রতিবেশী হিন্দুদের অনেকে আমাদের বাসায় আসতেন। দীপাবলি উৎসবের সময় অনেক হিন্দু বন্ধু আমাদের আমন্ত্রণ করতেন। কিন্তু কোভিডের পর তা বন্ধ হয়ে যায়।’
করোনাকাল থেকে নন্দনগরে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে পরিবর্তন আসতে শুরু করলেও সামাজিক সংহতি তখন পর্যন্ত একেবারে ভেঙে পড়েনি। কিন্তু ২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর শহরটির মুসলিমদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে।
এর এক সপ্তাহ আগে ২২ আগস্ট এক হিন্দু মেয়ে মুহাম্মদ আরিফ নামের এক নরসুন্দরের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। ওই হিন্দু মেয়ের অভিযোগ ছিল, তিনি স্লোগান দিতে গেলে আরিফ তাঁর ওপর যৌন হয়রানি চালান। এ ঘটনার পর আরিফ শহর ছেড়ে পালিয়ে যান।
১ সেপ্টেম্বর শহরটির দোকান মালিক সমিতি হিন্দু মেয়ের ওপর যৌন হয়রানির নিন্দা জানানো ও পুলিশি ব্যবস্থার দাবিতে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিনের বিক্ষোভ মিছিলে হাসানসহ অন্য মুসলিমরাও অংশ নেন। হাসান বলেন, ‘মুসলিম ব্যক্তির মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধকে আমরা সমর্থন করছি—হিন্দুরা এমন অভিযোগ করতে পারেন, এই ভয়ে আমরা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলাম।’
কিন্তু একপর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিলে মুসলিমবিরোধী স্লোগান শুরু হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে সহিংসতার হুমকি আসতে থাকে।
হাসান বলেন, ‘বিক্ষোভ মিছিলের সঙ্গে আমরাও হাঁটছিলাম। একটা সময় মুসলিমবিরোধী বিক্ষোভ ওঠে, “মুল্লোঁ কে দলালোঁ কো...জুতে মারো সালোঁ কো’। অর্থাৎ মুসলিম দালালদের জুতা দিয়ে পেটানো উচিত।’
মিছিল নন্দনগরের থানার কাছে পৌঁছার পর একদল বিক্ষোভকারী হারুন আনসারি নামের ৩০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসে এবং মারতে শুরু করে। আনসারিকে মারার বিষয়টি অনেক হিন্দু এই বলে ন্যায্য প্রমাণের চেষ্টা করে যে এই শহরের মুসলিমরা অভিযুক্ত নরসুন্দর আরিফকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন।
হামলার পর নাজিবাবাদে পালিয়ে যান আনসারি।
সেখান থেকে তিনি ফোনে আল–জাজিরাকে জানান, তাঁর মাথায় একাধিক আঘাত করা হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা সম্পর্কে আনসারি বলেন, ‘আমার শুধু এতটুকুই খেয়াল আছে যে একদল লোক আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। এরপর আমি চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।’
আনসারিকে মারার পর হাসানসহ নন্দনগরের সব মুসলিম সদস্য নিজেদের ঘরে বন্দী করে রাখেন। একটা সময় পর তাঁদের মহল্লায় কয়েক শ মানুষের একটি মব (উচ্ছৃঙ্খল জনতা) আসে। তারা মুসলিমদের বাড়িতে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে।
হাসান বলেন, ‘আক্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলো সহায়তার জন্য থানায় ফোন করে। কিন্তু কেউ আসেনি।’ সহায়তার জন্য হাসান তাঁর হিন্দু বন্ধুদের ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরাও হাসানের ফোন ধরেননি।
ওই দিন সন্ধ্যার পর মব চলে যাওয়া পর্যন্ত মুসলিম পরিবারের লোকজন হাসানের ঘরেই অবস্থান করেন। সেদিন মধ্যরাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর সন্তর্পণে নিজের দোকানে যান হাসান।
নিজের বাসার সামনেই ছিল হাসানের দোকান। দোকানে গিয়ে দেখেন, তাঁর দোকানের শাটার ভেঙে দুমড়েমুচড়ে দেওয়া হয়েছে। শুকনো পদ্ধতিতে পরিষ্কার করা সব কাপড় সামনের রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর তিলে তিলে সঞ্চিত চার লাখ রুপি রাখা ছিল দোকানের শক্ত একটি কাঠের টেবিলের ড্রয়ারে। ড্রয়ার ভেঙে হামলাকারীরা সব অর্থ নিয়ে গেছে। সন্তানদের বিয়ের জন্যই হাসান এই অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন।
হাসানের দোকানের নাম ছিল ‘দ্য হাসান ড্রাই ক্লিনার্স’। একটি সাইনবোর্ডে তা লেখা ছিল, যা হামলাকারীরা ভেঙে দিয়েছে। এই সাইনবোর্ড দুমড়েমুচড়ে নন্দাকিনীর তীরে ফেলে গেছে হামলাকারীরা।
নিজের ভাঙা দোকানের ছবি দেখিয়ে হাসান আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমি জীবনেও সেই দিনটির কথা ভুলব না।’ কিন্তু পরের দিনটি ছিল আরও ভয়ংকর।
২ সেপ্টেম্বর উগ্রপন্থী কিছু হিন্দু জনগোষ্ঠী আরও বড় বিক্ষোভের আয়োজন করে। এবার তারা অন্য শহরের হিন্দুদেরও নন্দনগরের বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায়। আগের দিন মার খাওয়া হারুন আনসারি বলেন, ‘আমাদের অনুরোধ সত্ত্বেও নন্দনগরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি।’
মুসলিমবিদ্বেষী বক্তৃতার জন্য পরিচিত উগ্রপন্থী হিন্দু নেতা দর্শন ভারতীও ২ সেপ্টেম্বর নন্দনগরে এসেছিলেন। হাসান বলেন, দর্শনের বক্তৃতার পর ‘মব উন্মত্ত হয়ে ওঠে, আমাদের সম্পত্তিতে ভাঙচুর চালায়’। উচ্ছৃঙ্খল জনতা একটি অস্থায়ী মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। এক মুসলিম ব্যক্তির গাড়ি নদীতে ফেলে দেয়।
এদিনের ঘটনার বিষয়ে জানতে দর্শনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু নিজের নন্দনগরে যাওয়া এবং এরপর পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।
হাসান বলেন, ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা ঢিল ছুড়তে শুরু করলে শহরের সব মুসলিম আমার বাসার ওপরতলায় আশ্রয় নেন। ওই দিনের কথা মনে পড়লেই আমার শরীর এখনো কেঁপে ওঠে।’ হাসানের বাসায় লোহার ফটক ও গ্রিল ছিল। কয়েক তলাবিশিষ্ট এই বাড়ি সেদিন শহরের সব মুসলিমের জন্য ভরসাস্থল হয়ে উঠেছিল।
ওই দিন উত্তর প্রদেশ থেকে যৌন হয়রানির অভিযোগে নরসুন্দর আরিফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আগের দিন ১ সেপ্টেম্বর পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করে। আরিফকে পুলিশ হেফাজতে রেখে এক সপ্তাহের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। এরপর তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।
এসব ঘটনার পর স্থানীয় পুলিশ মুসলিম পরিবারগুলোকে জানায়, তারা আর তাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না। নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে রাতের অন্ধকারে কর্মকর্তারা পুলিশের গাড়িতে করে তাদের পার্শ্ববর্তী শহরে রেখে আসেন। এর মধ্য দিয়ে অধিকাংশ মুসলিম পরিবারের নন্দনগরের জীবনের অবসান ঘটে।
কিন্তু হাসান ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি বলেন, ‘এটা আমার বাসা। আমি এখানেই জন্মেছি, এখানে বেড়ে উঠেছি। আমার পরিচয় থেকে শুরু করে সবকিছু উত্তরাখন্ডের সঙ্গে জড়িত।’ নিজের সব পরিচয়পত্রে নন্দনগরের ঠিকানা লেখা জানিয়ে চার সন্তানের এই জনক বলেন, ‘আমার পুরো পরিবার উত্তরাখন্ডেই বসবাস করে। এই শহর ছেড়ে আমি কোথায় যাব?’
‘পুরোপুরি বর্জন’
পুলিশ তাঁদের যেখানে রেখে এসেছিল, সেখান থেকে হাসান ও তাঁর পরিবার উত্তরাখন্ডের রাজধানী দেরাদুনে চলে যায়। সেখানে যেতে তাঁদের পাড়ি দিতে হয়েছে প্রায় ২৬৬ কিলোমিটার পথ।
দেরাদুনে কয়েক দিন থাকার পর নন্দনগর নিবাসী ৪৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ আইয়ুবকে সঙ্গে নিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর উত্তরাখন্ডের হাইকোর্টে একটি মামলা করেন হাসান। তাঁরা চামোলি জেলার নন্দনগরের মুসলিমদের পুলিশি সুরক্ষার দাবি জানান।
হাইকোর্ট চামোলি জেলার সিনিয়র পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টকে (এসএসপি) নন্দনগরের ‘আইনশৃঙ্খলা বাজায় রাখার কঠোর নির্দেশ দেন এবং বলেন, কোনো সুনির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষকে নিশানা করে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে’। কোনো জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখার কাজ তদারকির জন্য এসএসপিই সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা।
হাসান বলেন, ‘হাইকোর্ট আমাদের সুরক্ষার নির্দেশ দেওয়ার পর আমার ধারণা হয়েছিল, আমি এখন নন্দনগরে ফিরে যেতে পারি। কিন্তু ভয়ে আর কোনো মুসলিম পরিবার আমার সঙ্গে যেতে রাজি হচ্ছিল না।’
হাসান বলেন, ‘তবে অনেক চিন্তাভাবনার পর আমি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ, আমার ঘরবাড়ি, দোকান—সবাই তো নন্দনগরে।’
নিজের স্ত্রী বেশি সাহসী ছিলেন উল্লেখ করে হাসান বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের নিয়ে তিনিই প্রথমে নন্দনগরে ফিরে যান। আমি পরে যাই। আতঙ্ক সত্ত্বেও তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যদি ফিরে না যাই, তাহলে আমরা তো জীবিকা নির্বাহের উপায় হারিয়ে ফেলব।’
এই পরিবার যে এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। হাসান মাঝেমধ্যে ভাবেন, চার সন্তানের মধ্যে সবার বড় মেয়েটির স্কুল শেষ হলে তিনি পরিবার নিয়ে দেরাদুনে চলে যাবেন। তবে হাসানের স্ত্রীর কথা, তাঁরা অন্যত্র চলে গেলে তাঁদের বাড়ি ও দোকান স্থানীয় লোকজন দখল করে নেবে।
এমন একটা টানাপোড়েনে হাসান গত ১৬ অক্টোবর নন্দনগরে পৌঁছান। গিয়ে দেখেন, সেখানে তাঁর দোকানের মুখোমুখি স্থানে এক হিন্দু ব্যক্তিও একটি ড্রাই ক্লিনিংয়ের দোকান খুলেছেন। মানে, প্রকাশ্যে তাঁর সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে।
ফিরে গিয়ে নিজের দোকান মেরামতের চেষ্টা করেন হাসান। কিন্তু কোনো হিন্দু শ্রমিক তাঁকে সাহায্য করতে রাজি হননি। এ পরিস্থিতিতে তাঁর মনে হয়েছে, ‘মুসলিমদের সম্পূর্ণ বর্জন করা হচ্ছে’। হাসান বলেন, ‘তারা (উগ্র হিন্দুরা) এত বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছিল যে কোনো শ্রমিকেই আমাদের দোকান মেরামত করতে রাজি হচ্ছিলেন না। শ্রমিকেরা আমাকে বলেন, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো তাঁদের মুসলিমদের সহায়তা না করতে নির্দেশ দিয়েছে।’ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সঙ্গের সংশ্লিষ্ট এসব হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বেশ শক্তিশালী ও উগ্র।
কারও সহায়তা না পেয়ে নিজেই মেরামত করে দোকান আবার চালু করেন হাসান। কিন্তু দেখা গেল, কোনো গ্রাহক তাঁর দোকানে আসছেন না। এ পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর আগের হিন্দু গ্রাহকদের ফোন করা শুরু করেন। কিন্তু তাঁর দোকানে আসতে তাঁরা অস্বীকৃতি জানান। যিনিই তাঁর দোকানে যাবেন, তাঁকে হিন্দুত্ববাদীরা হুমকি দিতে পারে—এমন একটি আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। পুরোনো গ্রাহকেরা তাঁর কাছে না এসে হিন্দু ড্রাই ক্লিনারের কাছে যাওয়ার কথা জানান।
অনেকটা পরিতাপ নিয়ে হাসান বলেন, ‘সেদিনই আমি প্রথমবারের মতো জানতে পারলাম, ড্রাই ক্লিনিংয়েরও ধর্ম আছে।’
অবশেষে একফালি হাসি
নতুন নন্দনগরে হাসানের পরিবারকে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কারণ, শুধু ধর্মের কারণে তাঁরা অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে পড়েছিলেন।
ধর্মের কারণে হাসানের ১৬ বছরের মেয়েকে স্কুলে কটূক্তি (বুলিং) সহ্য করতে হয়েছে। এক সহপাঠী তাকে বলেছিল, মুসলিম হওয়ার কারণে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা উচিত।
হাসান ও অন্যান্য মুসলিম, যাঁরা নন্দনগর ছেড়েছিলেন, তাঁরা এখনো ন্যায়বিচার পাননি। ১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর নন্দনগর থানার প্রধান সঞ্জয় সিং নেগি সেদিন যা দেখেছিলেন, তার ভিত্তিতে উত্তরাখন্ডের পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে একটি অভিযোগ গ্রহণ করেছেন।
সঞ্জয় সিং নেগি অভিযোগপত্রে লিখেছেন, ‘২৫০ থেকে ৩০০ ব্যক্তিকে আমি একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে ব্যাপক নিপীড়ন চালাতে দেখেছি। তাদের থামাতে গেলে তারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে এক পাশে সরিয়ে দেয়। এ কথা আমি আমার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের জানাই এবং বাড়তি পুলিশ মোতায়েনের জন্য তাঁদের প্রতি অনুরোধ করি।’ মবের হাতে মুসলিমদের বাড়িঘর ও একটি মসজিদে ভাঙচুরের কথাও অভিযোগে উল্লেখ করেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সেদিন উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে লাঠি, বেলচা ও রড ছিল উল্লেখ করে সঞ্জয় সিং নেগি অভিযোগে লিখেছেন, ‘মব একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে উঠেছিল। তখন ওই গোষ্ঠীর নারী ও শিশুরা ভয়ে চিৎকার শুরু করেছিল।’ এ ঘটনার পর অনেক মাস পার হয়ে গেলেও যত দূর জানা যায়, পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।
এ বিষয়ে জানতে চামোলি জেলার পুলিশ সুপার সর্বেশ পানওয়ারের সঙ্গে আল–জাজিরার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
উত্তরাখন্ড রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের মধ্যে যে একটি বড় পরিবর্তন এসেছে, নন্দনগর সেটার ক্ষুদ্র জগতে (মাইক্রোকোজমে) পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামির চলতি শাসনে উত্তরাখন্ডের অনেক শহরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তৃতা ও বৈষম্য বেড়েছে। এমন বেশ কিছু ঘটনা আছে, সেখানে দেখা গেছে, উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো মুসলিমদের শহরছাড়া করতে প্রচার চালিয়েছে।
উত্তরাখন্ডের বিভিন্ন শহরে মুসলিমদের মালিকানাধীন দোকানে লুটপাট চালানো হয়েছে বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে অর্থনৈতিক বর্জন চলছে। মুসলিমরা প্রায় সময় হামলার শিকার হচ্ছেন।
পুষ্কর সিং ধামির সরকার অতি সম্প্রতি রাজ্যে ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউসিসি) জারি করেছে। এতে রাজ্যটিতে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম পালনে বাধার মুখে পড়ছেন।
অনেক ঘটনায় আদালত হস্তক্ষেপ করেছেন। কিন্তু কিছু কিছু অ্যাকটিভিস্ট মনে করেন, আদালতের আরও বেশি কিছু করা দরকার। দেরাদুনভিত্তিক সমাজকর্মী খুরশিদ আহমেদ বলেন, ‘মুসলিমরা বর্তমানে যে মাত্রায় নিপীড়নের মুখে পড়ছেন, আমাদের দেশের আদালতগুলো তা বুঝতে পারছেন না।’ হাসানকে হাইকোর্টে মামলা করতে এই কর্মীই সহায়তা করেছিলেন। তাঁর মতে, ‘শারীরিক, আবেগ ও আর্থিক—সব জায়গার ওপর আঘাত আসছে।’
এ পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রতি একটি আশার ঝিলিক খুঁজে পেয়েছেন হাসান।
সেপ্টেম্বরের ঘটনার পাঁচ মাসের বেশি সময় পর সহিংসতায় নেতৃত্বদানকারী এক হিন্দু ব্যক্তি হাসানের দোকানে এসেছিলেন। তখন দোকান সামলাচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী। ওই হিন্দু লোক একটি কোট ও ট্রাউজার দেখিয়ে বললেন, এগুলো কি একটু তাড়াতাড়ি ড্রাই ক্লিন করে দিত পারবেন?
হাসানের স্ত্রী ওই হিন্দু লোকের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনি আমাকে বোন বলে ডাকলেন। কিন্তু আপনি কি চান, মুসলিমরা এখান থেকে চলে যাক?’
উত্তরে ওই লোক বলেন, ‘যা হয়েছে, তা ভুলে যান। আপনাদের কাজ বেশ ভালো। এ কারণেই আমি আপনাদের কাছে এসেছি।’
এ ঘটনার কথা উল্লেখ করে স্মিত হেসে হাসান বলেন, ‘আমি চলে যাইনি বলে, পাল্টা লড়াই করেছি বলে আজ এই দিন এসেছে।’
তবে হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়ার ব্যথা এখনো হাসানকে পীড়া দেয়। তিনি বলেন, ‘মুসলিম পরিবারগুলো যখন তাদের সহায়-সম্বলের জন্য নন্দনগরে ফিরে আসে, তখন একসময় যাঁদের সঙ্গে তাদের ওঠাবসা ছিল, হাসাহাসি হতো, তাঁরাই তাদের উপহাস করে। তাঁরা জানতে চান, “কেন তোমরা ফিরে এসেছ?” এটা আমার হৃদয়কে ভেঙে দেয়। শারীরিক নিপীড়ন থামলেও নীরব সামাজিক সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে।’
তবে এ সবকিছু সত্ত্বেও ভবিষ্যতের বিষয়ে বা নন্দনগরের বিষয়ে হাল ছেড়ে দিতে রাজি নন হাসান। উৎস: প্রথম আলো।