কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহির্গমন এলাকা। সপ্তাহের যেকোনো দিন সেখানে গেলে দলবেঁধে থাকা নারীদের দেখা মিলবে। একই রকমের টি-শার্ট পরে, চোখে স্বপ্ন পূরণের উচ্ছ্বাস নিয়ে সেলফি তুলছেন তাঁদের অনেকেই। নতুন চাকরিতে পাওয়া বেতনের টাকায় কে কী করবেন, তা নিয়ে আলোচনায় মশগুল তাঁদের কেউ কেউ।
কেনিয়ার এসব নারী চাকরি করতে যাচ্ছেন সৌদি আরবে। কেনিয়া সরকারের উৎসাহে এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের প্রলোভনে তাঁদের এই দলবেঁধে বিদেশযাত্রা। দুই বছর সৌদি আরবে থাকবেন। গৃহকর্মীর কাজ করবেন। এরপর বেতনের টাকায় দেশে ঘরবাড়ি করবেন, সন্তানদের শিক্ষিত করবেন ও নিজেদের ভাগ্য ফেরাবেন, ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করবেন—এসবই তাঁদের প্রত্যাশা।
যদিও প্রত্যাশা আর বাস্তবতায় ঢের ফারাক। সেটা বোঝা যায় একই বিমানবন্দরের আগমন এলাকায় গেলে। সেখানে অনেক নারী শ্রমিক সৌদি আরব থেকে ফিরে আসেন স্বপ্ন হারানোর রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে। তাঁদের কেউ হয়তো ঠিকঠাক বেতন পাননি। কেউ–বা দিনের পর দিন অনাহারে থেকেছেন। কাউকে মারধর করা হয়েছে। আবার কেউ যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কফিনবন্দী হয়ে দেশে ফিরেছেন।
আফ্রিকার দেশ কেনিয়া-উগান্ডা দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় দিন পার করছে। দেশ দুটির আয়ের অন্যতম এক উৎস বিদেশে থাকা শ্রমিকদের পাঠানো বিপুল রেমিট্যান্স। বিশ্বের অনেক দেশ সৌদি আরবের কাছ থেকে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই দেশটিতে শ্রমিক পাঠায়। নথিপত্র ঘেটে দেখা গেছে, কেনিয়া ও উগান্ডা সেই সুযোগ পায়নি।
সৌদি আরবে গত ৫ বছরে কেনিয়ার অন্তত ২৭৪ জন শ্রমিক মারা গেছেন। বেশির ভাগই নারী। এর মধ্যে ২০২৪ সালে মারা গেছেন ৫৫ জন। এ সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনগুলো অস্পষ্ট আর পরস্পরবিরোধী। বলা হয়েছে, কেউ হয়তো ট্রমায় মারা গেছেন। কেউ–বা পুড়ে কিংবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। অর্থাৎ তাঁদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। একজন নারীর মৃত্যুর কারণ লেখা হয়েছে, ‘ব্রেইন ডেড’।
শুধু কেনিয়া নয়, আফ্রিকার আরেক দেশ উগান্ডার অনেক নারী শ্রমিক সৌদি আরবে মারা গেছেন। যদিও উগান্ডার সরকার সেই সংখ্যা প্রকাশ করেনি।
সৌদি আরবে গিয়ে প্রতারিত এসব নারীর সুরক্ষায় কাজ করেন ফাবিয়ান কাউলে মুলি। তিনি কেনিয়ার পার্লামেন্টের শ্রমবিষয়ক কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান। প্রভাবশালী এই কমিটি নারী শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে তদন্ত দাবি করতে পারে। আরও ভালো সুরক্ষার জন্য সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনা করতে নিজ দেশের সরকারকে চাপ দিতে পারে। এমনকি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিবাসন কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত রাখতে আইনের খসড়া করতে পারে।
কেনিয়া ও উগান্ডার প্রায় লাখ পাঁচেক শ্রমিক এখন সৌদি আরবে কর্মরত রয়েছেন। এটা সৌদি আরবের সরকারি হিসাব। তাঁদের বেশির ভাগই নারী। তাঁরা মূলত গৃহকর্মী হিসেবে রান্না, পরিচ্ছন্নতা ও শিশুদের দেখাশোনার কাজ করেন। সাংবাদিক ও অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে শ্রমিক নির্যাতনের কথা বলে আসছে। আর এ জন্য দায়ী দেশটির পুরোনো শ্রম আইন।
তবে পূর্ব আফ্রিকার অন্যান্য অনেক সরকারি কর্মকর্তার মতো ফাবিয়ান কাউলে মুলির মালিকানায় সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানোর একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করতে সৌদি আরবে যাওয়া শ্রমিকদের একজন মার্গারেট মুথেউ মুয়েনি বলেন, সৌদি নিয়োগকর্তা তাঁর পাসপোর্ট আটকে রেখেছিলেন। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁকে কেনিয়া থেকে ‘কিনে আনা’ হয়েছে। নিয়মিত খাবার দিতেন না।
এই পরিস্থিতিতে নিরূপায় হয়ে ফাবিয়ানের প্রতিষ্ঠানে ফোন করে সহায়তা চান মার্গারেট। তখন শ্রমিক পাঠানো ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি তাঁকে বলেন, ‘আপনি সাঁতার কেটে লোহিত সাগর পার হয়ে এরপর দেশে (কেনিয়ায়) ফিরে আসতে পারেন।’
নিউইয়র্ক টাইমসের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কেনিয়া, উগান্ডা আর সৌদি আরবে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হলেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রয়েছে। সৌদি আরবের রাজপরিবারের সদস্যরা গৃহকর্মী নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান বিনিয়োগকারী। কেনিয়া ও উগান্ডায় রাজনীতিবিদ আর তাঁদের পরিবারের সদস্যরা শ্রমিক পাঠানোর প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক।
বর্তমানে প্রতি মাসে বেশ কয়েকবার কেনিয়ার প্রত্যন্ত এলাকাগুলো হতে অনেকে সৌদি আরব থেকে আসা কফিন বুঝে নেওয়ার জন্য রাজধানী নাইরোবিতে আসছেন। এসব কফিনে কারও পরিবারের সদস্য আছেন। কারও আছেন বন্ধু বা স্বজন। সবাই সৌদি আরবে কাজ করতে বা ভাগ্য ফেরাতে গিয়েছিলেন।
অনেক সময় এসব রাজনীতিবিদের সরকারি ও ব্যবসায়িক প্রভাবের সীমারেখা অনেকটা ঝাপসা হয়ে আসে। যেমন বিদেশে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের সুরক্ষায় ফাবিয়ানের শ্রম কমিটির উচ্চকণ্ঠ থাকার কথা। কিন্তু অনেক সময় এই কমিটি নির্যাতনের প্রমাণ প্রকাশ্যে এলেও সেটা প্রত্যাখ্যান করেছে।
সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরত উগান্ডার চারজন নারী গত মাসে একটি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানে ভিডিও পাঠান। তাঁরা বলেন, সৌদি আরবে মাস ছয়েক ধরে চারজনই বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন।
ভিডিওতে এক নারী বলেন, ‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটক থাকতে থাকতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’ ওই নারী আরও জানান, তাঁরা এমন একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়েছেন, যেটার মালিক উগান্ডার ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা। পরে উগান্ডার সংবাদমাধ্যম জানতে পারে, ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক দেশটির প্রেসিডেন্টের ভাই।
সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠানো কেনিয়া ও উগান্ডার অভিযোগ উঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা সত্ত্বেও এ বিষয়ে তারা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
আফ্রিকার দেশ কেনিয়া-উগান্ডা দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক মন্দায় দিন পার করছে। দেশ দুটির আয়ের অন্যতম একটি উৎস বিদেশে থাকা শ্রমিকদের পাঠানো বিপুল রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়)। বিশ্বের অনেক দেশ সৌদি আরবের কাছ থেকে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই দেশটিতে শ্রমিক পাঠায়। নথিপত্র ঘেটে দেখা গেছে, কেনিয়া ও উগান্ডা সেই সুযোগ পায়নি।
কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো বলেন, কয়েক বছরের মধ্যে তিনি কেনিয়া থেকে সৌদি আরবে প্রায় পাঁচ লাখ শ্রমিক পাঠাতে আগ্রহী। তাঁর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মোসেস কুরিয়ার মালিকানায় শ্রমিক পাঠানোর একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কুরিয়ার ভাইয়েরও এমন একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিনি স্থানীয় একজন রাজনীতিক।
প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোর মুখপাত্র হুসেইন মোহাম্মদ বলেন, প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে কেনিয়া সরকার। এ জন্য অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টার এমন একটি প্রতিষ্ঠান চালানো স্বার্থের সংঘাত কি না, জানতে চাইলে এই মুখপাত্র বলেন, ‘না। কারণ, তিনি সরকারের শ্রম ইস্যুতে কাজ করেন না।’
উগান্ডা থেকে সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠায় এমন একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক দেশটির পুলিশ বাহিনীর সদ্য অবসর নেওয়া একজন কর্মকর্তা এবং যুক্তরাষ্ট্রে উগান্ডার সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল লিওপোল্ড কায়ান্দা। সৌদি আরবের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে এসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে।
নির্যাতনের যত ঘটনা: কেনিয়া থেকে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন ইউনাইস আচিয়েং। ২০২২ সালে সেখান থেকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বাড়িতে ফোন দেন তিনি। বলেন, তাঁর নিয়োগকারী তাঁকে খুন করার হুমকি দিয়েছেন। তাঁকে পানির ট্যাংকে ছুড়ে ফেলেছেন। ইউনাইস আচিয়েং ভীত কণ্ঠে বলেন, ‘দয়া করে আমাকে বাঁচান!’
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ইউনাইস আচিয়েংর মা জানান, শেষ পর্যন্ত বাড়ির ছাদের পানির ট্যাংক থেকে তাঁর মেয়ের গলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। তখন সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, মরদেহ এতটাই পঁচে গেছে যে তাঁর মৃত্যুর কারণ বোঝা দুষ্কর। পরে সৌদি পুলিশ ইউনাইস আচিয়েংর মৃত্যুকে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বলে উল্লেখ করে।
নির্যাতনকারী নিয়োগকর্তার হাত থেকে বাঁচতে অপর একজন অল্পবয়সী মা তিনতলা ভবন থেকে ঝাঁপ দেন। এতে তাঁর মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। অন্য এক নারী অভিযোগ করেন, তাঁর নিয়োগকর্তা তাঁকে ধর্ষণ করেছিলেন। পরে গর্ভধারণ করলে তাঁকে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেন। এই ঘটনায় কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন ওই নারী।
উগান্ডার ইসিকো মোসেস ওয়াইশোয়ার সঙ্গে কথা বলেছে নিউইয়র্ক টাইমস। তাঁর স্ত্রী আয়েশা মেমে সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে মারা যান। ইসাকো বলেন, তখন তাঁর স্ত্রীর নিয়োগকর্তা তাঁকে দুটি বিকল্প দিয়েছিলেন। হয় স্ত্রীর মরদেহ ফেরত পেতে পারেন অথবা স্ত্রীর বকেয়া মজুরির ২ হাজার ৮০০ ডলার পাবেন। যেকোনো একটি বেছে নিতে বলা হয় তাঁকে।
‘আমি তাঁকে জবাব দিই, আপনি আমাকে মজুরির বকেয়া অর্থ পাঠান আর নাই পাঠান, আমি আমার স্ত্রীর মরদেহ ফেরত চাই’, এমনটা বলছিলেন ইসিকো।
সৌদি আরবে করা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আয়েশা বেশ শীর্ণ ছিলেন। তাঁর শরীরে ব্যাপক আঘাতের চিহ্ন ছিল। পাঁজরের তিনটি হাড় ভেঙে গিয়েছিল। তাঁর কান, হাত আর পায়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের গুরুতর পোড়া দাগ দেখা গেছে। এরপরও সৌদি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, আয়েশার ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হয়েছে।
কেনিয়া ও উগান্ডার লাখ পাঁচেক শ্রমিক এখন সৌদি আরবে কর্মরত রয়েছেন। এটা সৌদি আরবের সরকারি হিসাব। তাঁদের বেশির ভাগই নারী। তাঁরা মূলত গৃহকর্মী হিসেবে রান্না, পরিচ্ছন্নতা ও শিশুদের দেখাশোনার কাজ করেন। সাংবাদিক ও অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে শ্রমিক নির্যাতনের কথা বলে আসছে। আর এ জন্য দায়ী দেশটির পুরোনো শ্রম আইন।
সৌদি আরবে কাজ করা ৯০ জনের বেশি শ্রমিক এবং মৃত শ্রমিকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে নিউইয়র্ক টাইমস। দিনের পর দিন একই অবস্থা চলে আসার আরেকটি কারণ উঠে এসেছে। তা হলো ক্ষমতাবানেরা বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে লাভবান হচ্ছেন।
এসব সাক্ষাৎকার ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, পুরো প্রক্রিয়াটিতে নারী শ্রমিকদের ‘গৃহস্থালি পণ্যের মতো’ বিবেচনা করা হয়। কেনাবেচার পর ছুঁড়ে ফেলা যেন তাঁদের নিয়তি। বেশকিছু কোম্পানি তাদের ওয়েবসাইটে নারী শ্রমিকদের ছবির পাশে অনলাইনে কেনার জন্য যেমন থাকে, সেই রকম ‘অ্যাড টু কার্ট’ অপশন যুক্ত করেছে। এমনকি ‘কেনিয়ার গৃহকর্মী বিক্রির জন্য’ একটি বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে।
সৌদি সরকারের উদ্যোগ: সৌদি আরবের মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাইক গোল্ডস্টেইন বলেন, বিদেশি শ্রমিকদের সুরক্ষায় সৌদি সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। গৃহকর্মীদের যেকোনো ধরনের শোষণ কিংবা নির্যাতন সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য। এ ধরনের আচরণের অভিযোগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা হচ্ছে।
মাইক গোল্ডস্টেইন আরও বলেন, সরকার নির্যাতনের ঘটনাগুলোয় জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়েছে। শ্রমিকদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। কাজের সময় দৈনিক ১০ ঘণ্টায় সীমিত করা হয়েছে। সপ্তাহে এক দিন ছুটির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, সৌদি সরকার অনলাইনে গৃহকর্মীদের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। যারা বারবার শ্রম আইন লঙ্ঘন করছে, একদিন তাদেরও শনাক্ত করা হবে।
শ্রমিকদের নির্যাতন ও মজুরি বকেয়া রাখা কিংবা চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ জানানোর জন্য হটলাইন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং সরাসরি অভিযোগ জমা দেওয়ার প্রক্রিয়াসহ একাধিক উপায় রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন মাইক গোল্ডস্টেইন।
তবে উগান্ডার লিঙ্গ, শ্রম ও সামাজিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহকারী কমিশনার মিল্টন তুরিয়াসিমা বলেন, ‘এখনো নির্যাতন ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে। প্রতিদিনই আমরা কোনো না কোনো অভিযোগ পাচ্ছি।’
ফরিদার কষ্টের জীবন: ফরিদা নাসানগারের বাড়ি উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায়। এক কক্ষের ওই পাকা বাড়ির সামনে বসেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। পাশেই খোলা ড্রেন। তারই এক পাশে রান্নার আয়োজন। একটি মাত্র ঘরে তিন ধাপের একটি বিছানা রয়েছে। সেখানে মা আর সন্তানদের নিয়ে থাকেন তিনি।
‘আমরা ভীষণ গরিব’, বলছিলেন ফরিদা। তিনি বলেন, এক বন্ধুর মাধ্যমে মারফি ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির একজন দালালের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেটা ২০১৯ সালের ঘটনা। এই প্রতিষ্ঠানের মালিকদের একজন হেনরি তুকাহিরওয়া। তিনি উগান্ডার পুলিশ বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা ছিলেন। সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত মাসে ২০০ ডলার মজুরিতে সৌদি আরবে গৃহকর্মীর চাকরি করতে যান ফরিদা। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি তাঁর প্রতি। ফরিদা জানান, একদিন তাঁর নিয়োগকর্তার স্বামী হঠাৎ তাঁর কক্ষে ঢুকে পড়েন। তাঁকে ধর্ষণ করেন। সেই সঙ্গে তাঁকে লাথি আর চড় মারেন ওই ব্যক্তি।
এই ঘটনার জেরে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন ফরিদা। নিয়োগকর্তা সব দায় ফরিদার ওপর চাপান। পরে তাঁকে উগান্ডাগামী একটি উড়োজাহাজে চড়িয়ে দেওয়া হয়। দেশে ফিরে এখন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার চেষ্টা করছেন ফরিদা। এখন তাঁকে আইনি সহায়তা দিচ্ছে আবদুল্লাহ কিয়োন্দের পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান।
আবদুল্লাহ বলেন, ফরিদা তাঁর নিয়োগকারীর নাম জানেন। তবে তাঁর ফোন নম্বর জানেন না। এখন একমাত্র নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য পেতে পারেন ফরিদা।
সেই মোতাবেক কাম্পালায় মারফি ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন ফরিদা। প্রতিষ্ঠানটি তাদের সৌদি অংশীদারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে তা সৌদি দূতাবাসকে জানানো হয়েছে।
এতকিছুর পর ফরিদা এখন মায়ের সঙ্গে সেই এক কক্ষের ছোট বাড়িতে থাকেন। সঙ্গে রয়েছে তাঁর আগের দুই সন্তান। সৌদি আরব থেকে ফেরার পর এক ছেলেশিশুর জন্ম দিয়েছেন ফরিদা।
তিনতলা থেকে ঝাঁপ দেন: নির্যাতনের বর্ণনা দেন মেরি নিসিমেন্তা নামের আরেক নারী শ্রমিক। নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, সৌদি আরবের দক্ষিণাঞ্চলের নাজরানে একটি বাড়িতে পরিচ্ছন্নতা এবং পাঁচ শিশুর দেখভালের কাজ করতেন তিনি। শিশুদের বয়স ছিল ৯ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। ওই শিশুরা তাঁকে লাঠি দিয়ে মারধর করত। তাঁর চোখে ব্লিচ ঢেলেছিল।
মেরি বলেন, তাঁর নিয়োগকর্তা বেতন দিতে চাইতেন না। বারবার বেতন চাওয়ায় একদিন তাঁকে তিনতলা ভবনের ছাদে আটকে রাখা হয়। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে খাবার আর পানি ছাড়া সেখানে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, সেখানেই হয়তো তাঁর মৃত্যু ঘটবে।
তিনতলার ছাদ থেকে বাইরের রাস্তায় ঝাঁপ দেন মেরি। এতে তিনি মেরুদণ্ডে আঘাত পান। মেরি বলেন, ‘হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তায় উঠি। তখন পথচারীরা আমাকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান। মেরুদণ্ডের চিকিৎসা করা হয়। আমি নির্যাতনের কথা পুলিশ ও চিকিৎসককে জানাই। তবে তাঁরা আমাকে কাজে ফিরে যেতে বলেন।’
মেরি কাজে ফিরতে অস্বীকৃতি জানালে সৌদি আরবের প্লেসমেন্ট এজেন্সি তাঁকে নিজ দেশে (উগান্ডা) ফেরত পাঠায়। ২০২৩ সালে দেশে ফিরলেও দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার কারণে এখন আর কাজ করতে পারেন না তিনি। সন্তানদের দেখভালের ভার নিয়েছেন বন্ধু ও স্বজনেরা। মেরি বলেন, ‘আমার জীবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।’
বাড়ি ফেরার তাড়া: সৌদি আরবের শ্রম আইন অনুযায়ী, যখন একজন শ্রমিকের নিজ দেশে ফেরার প্রয়োজন হবে, তখন সেটার ব্যয়ভার নিয়োগকারী বা সৌদি সরকারকে বহন করতে হবে। সৌদি আরবের মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাইক গোল্ডস্টেইন বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই একজন কর্মী প্রত্যাবাসনের জন্য আর্থিক দায়িত্ব বহন করবেন না।’
বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা শ্রমিক ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, শ্রমিকদেরই ব্যয়ভার বহন করতে বাধ্য করা হয়। যাঁদের সামর্থ্য নেই, তাঁদের আটকে রাখার ঘটনাও ঘটে থাকে।
এর কারণ ভিসা কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত। যাঁরা চাকরি ছেড়ে দেন, তাঁদের আইনগত বৈধতা হারানোর ঝুঁকি দেখা দেয়। এই সমস্যা সমাধানে সৌদি সরকার ‘সাকান’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছে। তারা বিবিধ সমস্যায় পড়া বিদেশি শ্রমিকদের আবাসন ও আইনি সহায়তার ব্যবস্থা করবে।
হান্না নাজেরি মিরিয়ামের বাড়ি কেনিয়ার রিফত উপত্যকায়। সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে ২০২২ সালে তিনি সাকান পরিচালিত একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। কথা–কাটাকাটির একপর্যায়ে নিয়োগকর্তা তাঁকে চাকরি থেকে বের করে দেন। ফলে সাকানের আশ্রয়ে থাকা ছাড়া তাঁর আর কোনো গতি ছিল না।
হান্নার পরিবারের সদস্যরা জানান, ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। বলা হয়েছিল, ৩০০ ডলার ভ্রমণের ব্যয় দিতে পারলে হান্না দেশে ফিরতে পারেন। পরে হান্না পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জানান, ওই আশ্রয়কেন্দ্রে তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়।
যা–ই হোক, হান্নাকে ছাড়িয়ে আনতে কেউ ৩০০ ডলার দিতে পারেনি। একদিন ওই আশ্রয়কেন্দ্রের একজন নারীকর্মী হান্নার পরিবারে ফোন করেন। বলেন, হান্না পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দোতলা থেকে পড়ে নিহত হয়েছেন।
ময়নাতদন্ত করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, মাথায় আঘাত পেয়ে হান্নার মৃত্যু হয়েছে। পরে সৌদি পুলিশ জানায়, হৃৎপিণ্ড আর শ্বাসযন্ত্র অকেজো হয়ে পড়ায় হান্নার মৃত্যু হয়েছে।
হান্নার মৃত্যু নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে সাকান কর্তৃপক্ষ। আর মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাইক গোল্ডস্টেইন শুধু একজন শ্রমিকের মৃত্যু নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। কেন ময়নাতদন্ত ও পুলিশের প্রতিবেদন আলাদা কারণ উঠে এল, তা–ও জানানো হয়নি।
তবে মাইক গোল্ডস্টেইন বলেন, ২০২৩ সালেই সাকানের অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে সৌদি সরকার। এখন এই দায়িত্ব পালন করছে ‘সামাসকো’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান।
এই প্রতিষ্ঠানের নামেও অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আশ্রয়ে থাকা তিনজন কেনিয়ান নারী নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, জনপ্রতি ৪০০ ডলার না দিলে তাঁদের বাড়ি ফিরতে দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
লাশ হয়ে ফেরা : বর্তমানে প্রতি মাসে সৌদি আরব থেকে মরদেহভর্তি বেশ কিছু কফিন আসছে। স্বজনেরা কেনিয়ার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মরদেহ বুঝে নেওয়ার জন্য রাজধানী নাইরোবিতে আসছেন। সবাই সৌদি আরবে কাজ করতে বা ভাগ্য ফেরাতে গিয়েছিলেন।
কেনিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক গ্রামের বিদ্যালয়ে গত সেপ্টেম্বরে একটি আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে কয়েক শ মানুষ মিলিসেন্ট মোরা ওবওচাকে (২৪) শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হয়েছেন। স্বামী ও শিশুসন্তানকে রেখে কয়েক মাস আগে মারা যান মিলিসেন্ট।
সৌদি আরবে নিয়োগকর্তার হাতে যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এই নারী। দেশটিতে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে ফোন করে সহায়তাও চেয়েছিলেন তিনি। কিছুদিন পর মিলিসেন্টের স্বামী ওবুয়া সাইমন আরেবা সৌদি আরব থেকে একটি ফোনকল পান। জানানো হয়, তাঁর স্ত্রী আর বেঁচে নেই। কেনিয়ার সরকার তাঁর মৃত্যুর জন্য ‘স্নায়ু সমস্যাকে’ চিহ্নিত করে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান চলাকালে মিলিসেন্টের মরদেহ একটি খোলা কফিনে শোয়ানো ছিল। পরনে সাদাপোশাক ও মাথায় ওড়না ছিল। কফিনের পাশে রাখা ছিল মিলিসেন্টের ছয় ফুট লম্বা একটি ছবি। ছবিটা সৌদি আরবে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরের বাইরে দাঁড়ানো অবস্থায় তোলা হয়েছিল। মিলিসেন্টের চোখেমুখে আনন্দের ঝলকানি। আঙুল তুলে বিজয়সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর সেই সুখের প্রত্যাশা কফিনবন্দি হয়ে নিজ ভূমিতে ফিরেছে। অনুবাদ: প্রথম আলো।