বেলুচিস্তান অঞ্চলে চারশোরও বেশি যাত্রীবাহী ট্রেনে হামলা এবং যাত্রীদের জিম্মি করার ঘটনা কেন্দ্র করে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগে জড়িয়েছে পাকিস্তান-ভারত। ওই ঘটনার সঙ্গে ভারতের যোগ রয়েছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ তুলেছিল পাকিস্তান। সেই অভিযোগ খারিজ করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাল্টা পাকিস্তানের দিকে আঙুল তুলেছে। ভারতের মতো আফগানিস্তান পাকিস্তানের অভিযোগ অস্বীকার করে বিষয়টি দেশটির অভ্যন্তরীণ বলে উল্লেখ করেছে। এর ফলে দেশ তিনটির সম্পর্কের উত্তেজনার পারদ ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘটনাটি এখন আঞ্চলিক উত্তেজনায় রূপ নেওয়ার পথে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, পাকিস্তানের এ অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’। ভারতের সঙ্গে এ হামলার কোনো যোগ নেই। শুধু তাই নয়, নাম না করে পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্র’ বলেও পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন তিনি। পাশাপাশি অন্য কোনো দেশের দিকে আঙুল তোলার আগে পাকিস্তানকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবিলার কথাও বলেছেন।
এর আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শাফাকত আলি খান অভিযোগ করেন, পাকিস্তানে ‘সন্ত্রাসবাদ’ চালাচ্ছে ভারত। তিনি দাবি করেন, চলতি সপ্তাহের মঙ্গলবার কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেসে যে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামলা চালিয়েছিল, তাদের সঙ্গে আফগানিস্তানের যোগ রয়েছে। ভারতের মতো আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও পাকিস্তানের তোলা অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, সাম্প্রতিক এ হামলার সঙ্গে তাদের কোনোরকম যোগ নেই। একই সঙ্গে পাকিস্তানকে আভ্যন্তরীণ ‘নিরাপত্তা ও সমস্যার’ দিকে মনোযোগ দেওয়ার অনুরোধও জানিয়েছে আফগানিস্তান।
চলতি সপ্তাহে মঙ্গলবার কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেস বেলুচিস্তানের বোলান এলাকায় পৌঁছানোর পর সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার মুখ পড়ে। হামলার সময় ট্রেনে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর শতাধিক সদস্যসহ কমপক্ষে ৪০০ যাত্রী ছিলেন বলে জানা গেছে। উপস্থিত যাত্রীদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষকেই জিম্মি নেয় আক্রমণকারীরা। পরে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গোটা এলাকা ঘিরে ফেলে। জিম্মিদের উদ্ধার করতে শুরু হয় বিশেষ অভিযান। প্রায় দুদিন ধরে চলা এ অভিযানে নিহতদের সংখ্যা সঠিকভাবে এখনো জানানো না হলেও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের তরফে দাবি করা হয়েছে যে, জিম্মি যাত্রীদের উদ্ধারের অভিযান সম্পূর্ণ হয়েছে এবং এতে ৩৩ আক্রমণকারীর মৃত্যু হয়েছে।
এ ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসার পরই তার দায় স্বীকার করে বালোচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। এর আগেও এ গোষ্ঠী ওই এলাকার বিভিন্ন অংশে আক্রমণ চালিয়েছে বলে অভিযোগ। সেই তালিকায় সেনা ছাউনি, রেলওয়ে স্টেশন ও ট্রেনও রয়েছে। তবে এই প্রথম তারা কোনো ট্রেন হাইজ্যাক করে। ওই ট্রেন জিম্মি করে বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাবি জানায় বালোচ লিবারেশন আর্মির সদস্যরা।
বিবিসি বলছে, গত মঙ্গলবার থেকেই বিশ্বস্তরে খবরের শিরোনামে ছিল জাফর এক্সপ্রেসে এ হামলার ঘটনা। উদ্ধার হওয়া যাত্রীরা এবং ঘটনার সাক্ষী থাকা পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের অনেকে আক্রমণের অভিজ্ঞতার কথা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
এ অভিযানের বিষয়ে খুঁটিনাটি তথ্য বা নিহতদের সঠিক সংখ্যার বিষয়ে সরকারিভাবে এখনো কোনো ঘোষণা করা হয়নি। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনার সঙ্গে আফগানিস্তান ও ভারতের যোগের বিষয়ে অভিযোগ তোলে পাকিস্তান।
ওই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শাফাকত আলি খান তার সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে ভারত জড়িত। এরপর তিনি জাফর এক্সপ্রেসে হামলার প্রসঙ্গ টেনে আনেন এবং তার সঙ্গে আফগানিস্তানের যোগের উল্লেখও করেন। তিনি বলেছেন, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে জাফর এক্সপ্রেসে হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আফগানিস্তানে থাকা তাদের হ্যান্ডলার এবং চক্রের নেতাদের যোগাযোগ ছিল।
তবে জাফর এক্সপ্রেসে হামলা এবং ওই ট্রেনটি হাইজ্যাক করার অভিযোগ নাকচ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলার পাশাপাশি, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তোলা হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বৃহস্পতিবারের প্রেস ব্রিফিংয়ে পাকিস্তানের তোলা অভিযোগ সরাসরি খারিজ করে দিয়ে বলেছেন, পাকিস্তানের তোলা অভিযোগ আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে খারিজ করছি।
জাফর এক্সপ্রেসে আক্রমণ এবং যাত্রীদের জিম্মি করার ঘটনার সঙ্গে আফগানিস্তানের যোগের যে অভিযোগ তুলেছিল পাকিস্তান, তার বিরোধিতা করেছে আফগানিস্তান। ওই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল কাহার বলখি ওই অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি জানিয়ে, পাকিস্তানকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবিলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের এ জাতীয় অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমরা এ অভিযোগকে খণ্ডন করছি। বেলুচিস্তানের ঘটনার সঙ্গে আফগানিস্তানের কোনো যোগ নেই। পাকিস্তানের তরফে তোলা অভিযোগকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য’ বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বিবিসি জানাচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে এ অঞ্চলের সামরিক শিবির, রেলস্টেশন এবং ট্রেনে হামলা চালানোর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বালোচ লিবারেশন আর্মির। ট্রেন ছিনতাইয়ের পরপরই তারা পাকিস্তানের প্রতি বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি জানায়। এর জন্য সময়সীমাও বেঁধে দেয়। তারা আক্রমণের ভিডিও প্রকাশ করেছে। তাই বিষয়টি নিয়ে অন্য দেশের দিকে আঙুল তোলা পাকিস্তানের অনুচিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে নতুন করে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ দাঁড় করাচ্ছে পাকিস্তান।