শিরোনাম
◈ ‘জাতির পিতা’ বিধান বিলুপ্তির সুপারিশ: সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ◈ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের ◈ বেনজীরের বিতর্কিত বক্তব্যে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবাদ (ভিডিও) ◈ হঠাৎ ট্রাম্পকে যে কারণে ‘টোপ’ দিলেন জেলেনস্কি ◈ ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু, মোজাম্মেল হকের বাড়িতে র‌্যাব ◈ আপিল ট্রাইব্যুনালে জয়ী পুলিশ সদস্যদের চাকুরীতে পুনর্বহালের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে ◈ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার গায়েবানা জানাজা পড়লেন বৈষম্যবিরোধীর নেতাকর্মীরা ◈ সেদিন গাজীপুরে কি ঘটেছিল? আহতদের মুখে ঘটনার বর্ণনা ◈ টিউলিপের নামে গাজীপুরে বাংলো, যা বলছে লেবার পার্টি ◈ ফরিদপুরের সালথায় চার কৃষকের ১০ ঘরে আগুন, সব পুড়ে ছাই

প্রকাশিত : ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০১:১৭ রাত
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০৫:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

হঠাৎ ট্রাম্পকে যে কারণে ‘টোপ’ দিলেন জেলেনস্কি

অস্ত্রের বদলে বিরল খনিজ! যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে এমনই এক বিনিময় প্রত্যক্ষ করতে পারে আধুনিক পৃথিবী। সম্প্রতি এ বিষয়ে এক সুরে কথা বলতে শোনা যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অব্যাহত সমর্থনের বিনিময়ে ইউক্রেনের একাধিক বিরল ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার কথা বিবেচনা করছেন জেলেনস্কি। তবে শেষ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে এই চুক্তি হলে পূর্ব ইউরোপের পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা।

 গত প্রায় তিন বছর ধরে রাশিয়ার সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন। লড়াইয়ে কিয়েভের বড় ভরসা মার্কিন সামরিক সহায়তা। কিন্তু ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সেই সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা কমেছে। এই পরিস্থিতিতে অস্ত্র ও গোলা-বারুদের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে ওয়াশিংটনকে বিরল খনিজের টোপ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি।
 
ইউরোপের ‘রুটির ঝুড়ি’ খ্যাত ইউক্রেনের মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের বিরল সব খনিজ। এর মধ্যে লিথিয়াম ও টাইটানিয়াম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দেশটির যে এলাকায় এই খনিজগুলো পাওয়া যায়, বর্তমানে তার সিংহভাগই রয়েছে রাশিয়ার দখলে। বাকি খনিগুলোর অবস্থান রণক্ষেত্র সংলগ্ন এলাকায় হওয়ায় সেখান থেকে খনিজ উত্তোলন বেশ কঠিন।
 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। রাজধানী ওয়াশিংটনের ওভাল কার্যালয়ে বসে তিনি বলেছেন, ‘বিরল খনিজের নিরাপত্তা দিতে হবে। এর জন্য আমরা কোটি কোটি ডলার খরচ করছি। তাদের (ইউক্রেন) কাছে প্রচুর পরিমাণে বিরল খনিজ রয়েছে। আমাদের পদক্ষেপ মেনে নিতে তারা ইচ্ছুক।’
  
ইউক্রেনের লিথিয়াম ও টাইটানিয়ামের খনিতে ট্রাম্পের নজর পড়ার মূল কারণ হিসেবে চীনের কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনে করেন, বিরল খনিজের কারণেই অভাবনীয় উন্নতি করেছে বেইজিং। দেশটিতে এই ধরনের খনিজের বিপুল ভান্ডার রয়েছে।
 
ইউক্রেনীয় সংবাদ সংস্থা কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনে রয়েছে বিশ্বের ২০টি গুরুত্বপূর্ণ জটিল খনিজ ও ধাতু। বিরল খনিজ বলতে ট্রাম্প এর মধ্যে কোনগুলোকে বুঝিয়েছেন, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
 
তবে ওভাল অফিসে বসে করা মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই মন্তব্যের পর মূলত দু’টি খনিজ নিয়ে সর্বাধিক আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি টাইটানিয়াম। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও মহাকাশ গবেষণায় এর বহুল ব্যবহার রয়েছে।
 
দ্বিতীয় খনিজটির নাম লিথিয়াম। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি থেকে শুরু করে মাইক্রো চিপ সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের মেরুদণ্ড হল এই খনিজ। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, এই ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে এগিয়ে রয়েছে চীন। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রে লিথিয়ামের মজুত বাড়াতে চাইছেন ট্রাম্প।
 
কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই দুই খনিজ ছাড়াও ইউক্রেনের মাটির গভীরে রয়েছে সেরিয়াম, ইট্রিয়াম, ল্যান্থানাম ও নিওডিয়ামিয়াম। সাম্প্রতিক সময়ে নবায়নযোগ্য শক্তি বা জ্বালানির দিকে নজর দিয়েছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। আর তাই এই খনিজগুলোর চাহিদা বিশ্বজুড়ে হু হু করে বাড়ছে।
  
নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে বায়ু টারবাইন জেনারেটরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এতে অতি শক্তিশালী চুম্বকের প্রয়োজন হয়। সেটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় সেরিয়াম, ইট্রিয়াম, ল্যান্থানাম ও নিউওডিয়ামিয়ামের মতো বিরল খনিজ।
 
ইউক্রেনের আরেক সংবাদমাধ্যম কিয়েভ পোস্ট লিখেছে, গত বছর বিরল খনিজের বিনিময়ে অস্ত্র ও গোলা-বারুদের সরবরাহ চালু রাখার বিষয়টি মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে তুলে ধরেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। পরে এই ইস্যুতে তিনি বলেন, ‘আগ্রাসী রাশিয়ার মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। আর তাই ওয়াশিংটনের খনি সংস্থাগুলোকে প্রবেশাধিকার দেয়া ন্যায্য সিদ্ধান্ত হবে।’
 
জেলেনস্কির এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করেছে রাশিয়া। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ বলেছেন, ‘ইউক্রেনীয় খনিজের বিনিময়ে হাতিয়ার সরবরাহ আমরা কখনোই মেনে নেব না। কিয়েভকে এই সাহায্য করা হলে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাধ্য হব আমরা।’
 
দ্য কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের অর্ধেকের বেশি রয়েছে রাশিয়ার দখলে। এর মূল্য ৭৫ লক্ষ কোটি ডলারেরও বেশি। সংশ্লিষ্ট খনিজগুলো পাওয়া যায় লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন এলাকায়। এর মধ্যে খেরসনে খনির সংখ্যা সবচেয়ে কম।
 
২০১৪ সালে ইউক্রেনের থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নেয় মস্কো। দ্য কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর দাবি, কৃষ্ণসাগর সংলগ্ন এই এলাকাটিতেও রয়েছে ২৫ হাজার ৮০০ ডলার মূল্যের খনিজ। এছাড়া দোনেৎস্ক ও জাপোরিঝিয়ার সীমানাবর্তী দেনিপ্রোপেট্রোভস্ক ওব্লাস্টে থাকা খনিজের বাজারমূল্য ৩৫ লাখ কোটি টাকার সমান।
  
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে দোনেৎস্ক, লুহানস্ক ও জাপোরিঝিয়াসহ মোট চারটি এলাকা দখল করে রুশ বাহিনী। এরপর ওই বছরের  সেপ্টেম্বরে এই চার এলাকায় গণভোট করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
 
মস্কোর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হওয়া ওই নির্বাচনে ৯৯ শতাংশের বেশি ভোট রাশিয়ার পক্ষে পড়ে। এরপর সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোকে রুশ ভূখণ্ড বলে ঘোষণা করা হয়।
 
বর্তমানে দেনিপ্রোপেট্রোভস্ক ওব্লাস্টের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে রুশ সেনা। ওই খনি এলাকাটির উপর যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ চালাতে পারে মস্কো। বিষয়টি নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। তাতে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের খনিগুলো রণক্ষেত্রের এতটাই কাছে যে সেখান থেকে কিছু উত্তোলন করা কার্যত অসম্ভব।
 
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ট্রাম্প। ক্ষমতায় বসার পর থেকেই পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ বন্ধ করার উপর জোর দিয়েছেন তিনি। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সরবরাহ বন্ধ করার নির্দেশে সই করেছেন।
 
ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। এই পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটন যদি কিয়েভের অস্ত্রের বিনিময়ে বিরল খনিজের টোপ গেলে, তাহলে পরিস্থিতি অন্য দিকে বাঁক নেবে। কারণ হাতে আসা খনিজ সম্পদ ছাড়তে ছাড়তে চাইবে না মস্কো। বিশ্লেষকদের দাবি, ইউক্রেনের জ্বালানি, ধাতু ও খনিজ পদার্থ মিলিয়ে ১ হাজার ২০০ লাখ কোটি ডলারের সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ক্রেমলিনের।
  
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, অস্ত্রের বিনিময়ে খনিজের টোপ দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। প্রথমত, বিভিন্ন রণাঙ্গনে রুশ বাহিনীর সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছে না তার বাহিনী। প্রায় তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধে বিপুল প্রাণহানির জেরে সেনাক সংকটেও ভুগছেন তার দেশ।
 
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ শুরুর দিন থেকে ইউক্রেনকে অস্ত্র ও কোটি কোটি ডলার দিয়ে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে জেলেনস্কির বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে নামাতে চাইছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। আর তাই অস্ত্রের বিনিময়ে বিরল খনিজের টোপ দিয়েছেন তিনি।
 
বিশেষজ্ঞদের মতে, জেলেনস্কি জানেন, কিছুদিনের মধ্যেই লড়াই বন্ধ করতে প্রবল চাপ তৈরি করবে যুক্তরাষ্ট্র। আর ইউক্রেনীয় বাহিনী লড়াই বন্ধ করে দেয়, সেক্ষেত্রে কিয়েভ বিপুল জমি হারাবে এমন শঙ্কা রয়েছে তার। আর তাই যুদ্ধবিরতির দর কষাকষিতে নিজের অবস্থান মজবুত করতে চাইছেন তিনি। এই অবস্থায় খনিজের লোভ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে রুশ বাহিনীর দখলে থাকা এলাকা মুক্ত করার ‘মাস্টারস্ট্রোক’ দিয়েছেন জেলেনস্কি।
 
তবে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের এই স্বপ্ন কত দূর সফল হবে, তা নিয়ে সন্দিহান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেলেনস্কিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর নীল নকশা আঁকা শুরু করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। কিয়েভে ক্ষমতা বদল না হলে যুদ্ধবিরতি যে সম্ভব নয়, তা একরকম বুঝে গেছে ওয়াশিংটন ও মস্কো।
 
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। ট্রাম্পের শপথের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে কথা বলতে আগ্রহী বলেও বার্তা দিয়েছেন তিনি। মনে করা হচ্ছে, খুব শিগগিরই এক টেবিলে দেখা যাবে দুই রাষ্ট্রনেতাকে। উৎস: সময়নিউজটিভি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়