শিরোনাম
◈ পুলিশের শতকরা ৮০ জনের হৃদয়ে ছাত্রলীগ: আসিফ নজরুল ◈ যে কারণে মধ্যরাত থেকে সারা দেশে বন্ধ হতে পারে ট্রেন চলাচল! ◈ ট্রাম্পের নীতির ধাক্কা কতটা বাংলাদেশে? ◈ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় যা বললেন ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক ◈ মধ্যরাতে প্রধান ফটকের তালা ভেঙে নীলক্ষেতে ইডেন কলেজের ছাত্রীরা (ভিডিও) ◈ সাত কলেজের ঘটনা ‘দুঃখজনক’, সব পক্ষকে ধৈর্য ধরার আহ্বান প্রো ভিসি ড. মামুনের ◈ ঢাবি-সাত কলেজ সংঘর্ষ, শিবির সভাপতির বক্তব্য ◈ সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান গ্রেপ্তার ◈ ঢাবি ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ, নীলক্ষেত নিউমার্কেট এলাকা রণক্ষেত্র (ভিডিও) ◈ তাসকিনের রেকর্ড, আবারো রাজশাহীর কাছে রংপুর রাইডার্সের অপ্রত্যাশিত হার

প্রকাশিত : ২৫ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৫:৩৩ বিকাল
আপডেট : ২৭ জানুয়ারী, ২০২৫, ১০:২৭ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘বাঁধের বদলে বাঁধ’: ভারত-চীন উত্তেজনা, সবচেয়ে ক্ষতি হবে বাংলাদেশের

গত মাসে এক শীতের বিকেলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং নদীর পাশে শতাধিক আন্দোলনকারীকে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছিল। তারা স্লোগান দিচ্ছিলেন, "এন সিয়াং-এর ওপর কোনো বাঁধ চাই না।"

শান্ত পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া সিয়াং নদী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আদিবাসী আদি সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষদের কাছে পবিত্র বলে বিবেচিত হত। এই কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু এখন সেই সবকিছুই ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা গেগং জিজং। তিনি বলেন, ভারত তাদের জমিতে দেশের বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।

১৩.২ বিলিয়ন ডলারের 'সিয়াং আপার মাল্টিপারপস প্রজেক্ট' একটি জলাধার তৈরি করবে। এটি ৯ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণ করতে সক্ষম। কাজ সম্পূর্ণ হলে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, যা ভারতের অন্য কোনো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের চেয়ে বেশি। এই প্রকল্পটি প্রথমে ২০১৭ সালে প্রস্তাব করা হয়েছিল। বর্তমানে কর্মকর্তারা এটির সম্ভাব্যতা জরিপ চালাচ্ছেন।

তবে স্থানীয়রা সতর্ক করে বলেছেন, অন্তত ২০টি গ্রাম ডুবে যাবে এবং প্রায় দুই ডজন গ্রাম আংশিকভাবে ডুবে যাবে। ফলে হাজার হাজার বাসিন্দা তাদের ঘরবাড়ি হারাবে।

স্থানীয়দের প্রতিবাদ বাড়তে থাকায় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার প্রতিবাদ থামাতে প্যারামিলিটারি বাহিনী মোতায়েনের আদেশ দিয়েছে, যদিও এখনও পর্যন্ত কোনো সংঘর্ষ ঘটেনি।

আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, তারা কোথাও যাবেন না। সিয়াং আদিবাসী কৃষক ফোরামের (এসআইএফএফ) সভাপতি জিজং বলেন, "সরকার আমার বাড়ি, আমাদের মা সিয়াংকে অধিগ্রহণ করছে এবং এটি একটি শিল্পে পরিণত করছে। আমরা এটা হতে দিতে পারি না।" তিনি বলেন, "যতদিন আমি বেঁচে আছি, ততদিন আমরা সরকারকে এই বাঁধ নির্মাণ করতে দেব না।"

তবে বিজেপি সরকার যুক্তি দিচ্ছে, আন্দোলনকারীরা ভুল বুঝছে। অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু বলেছেন, এটি "শুধু একটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ নয়" বরং এর "প্রধান লক্ষ্য, সিয়াং নদীকে রক্ষা করা।" আর সেটি চীনের হাত থেকে।

একটি ভঙ্গুর পরিবেশ ব্যবস্থা : ভারতের এই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প মূলত পানি ও নিরাপত্তা নিয়ে নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে চলমান একটি ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্ত সংঘর্ষও বেড়েছে। কখনও কখনও সেটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।

সিয়াং নদী তিব্বতের কৈলাস পর্বতের কাছে উৎপন্ন হয়েছে। সেখানে এটি ইয়ারলুং ঝাংবো নামে পরিচিত। তারপর এটি অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশ করে এবং আরও প্রশস্ত হয়ে ওঠে। ভারতের বেশিরভাগ অংশে এটি ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত। তারপর এটি বাংলাদেশে প্রবাহিত হয় এবং বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে।

গত মাসে চীন তিব্বতের মেদোগ অঞ্চলে ইয়ারলুং ঝাংবোর ওপর বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। ভারতীয় সীমান্তে নদীটি প্রবেশের আগেই সেটির ওপর এই বাঁধ স্থাপিত হবে।

চীন ২০২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা "চীনের বাঁধ প্রকল্পগুলোর বিপজ্জনক প্রভাব মোকাবিলা" করতে একটি পালটা বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে শুরু করেন।

ভারতীয় সরকার যুক্তি দেয়, সিয়াং বাঁধের বিশাল জলাধার আসন্ন মেদোগ বাঁধের ফলে নদীর প্রবাহের ব্যাঘাত কমাবে এবং আকস্মিক বন্যা বা পানি সংকট থেকে রক্ষা করবে।

তবে বিশেষজ্ঞরা ও পরিবেশ আন্দোলনকারীরা সতর্ক করে বলেছেন, হিমালয় অঞ্চলের এক ভঙ্গুর পরিবেশ ব্যবস্থা এবং অতীতের বিধ্বংসী বন্যা ও ভূমিকম্পের ইতিহাসের মধ্যে দুটি বিশাল বাঁধের উপস্থিতি এই অঞ্চলের বাসিন্দা এবং সেখান থেকে আরও নীচু অঞ্চলে বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষের জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

তারা জানিয়েছেন, হিমালয়ের পানি সম্পদ নিয়ে ভারত ও চীনের বিপজ্জনক শক্তির লড়াই আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর জন্য অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে।

বড় উত্তেজনার কেন্দ্র: মেদোগ জেলার ইয়ারলুং ঝাংবো নদীর ওপর নতুন এই মেগা বাঁধটি চীনের কেন্দ্রীয় এলাকায় বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ থ্রি গর্জেস বাঁধকেও ছাড়িয়ে যাবে। বেইজিং দাবি করেছে, প্রকল্পটি ২০৬০ সালের মধ্যে নেট-জিরো নির্গমন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ হবে। চীনা সংবাদ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, বাঁধটি নির্মাণে ১৩৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। তবে চীনা অঞ্চলে কতজন বাস্তুচ্যুত হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই।

নাচমা বারওয়া পর্বতের কাছে গ্রেট বেঞ্চে বাঁধটির নির্মাণ একটি ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময় হবে। কারণ এখানকার পানি যেখানে পড়বে, সেটি বিশ্বের গভীরতম উপত্যকাগুলোর মধ্যে একটি। এটি ৫ হাজার মিটার (১৬,৪০০ ফুট) গভীর এবং বছরে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।

জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইনিজ স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক বি আর দীপক বলেন, নতুন এই বিশাল প্রকল্পটি চীনের ইয়ারলুং ঝাংবো এবং এর উপনদীগুলোর ওপর ধারাবাহিক বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের সর্বশেষ অংশ। আগের বাঁধগুলো ছিল ছোট আকারের।

তিনি বলেন, এই বাঁধগুলোকে "ভারত এবং চীনের মধ্যে অন্যতম প্রধান উত্তেজনার কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা উচিত।"

অধ্যাপক দীপক আরও বলেন, "বৃহত্তম সংঘর্ষগুলোর অনেক কিছুই শুরু হয়েছে নদীর পানি নিয়ে সংঘাত থেকে।" সিন্ধু নদীর উপনদীগুলোর পানি ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি বড় বিরোধের কারণ। এদিকে, ইথিওপিয়া এবং মিশর নীল নদের ওপর একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণ নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছে।

তিনি বলেন, প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে সিয়াং নদীর ওপর ভারতের একটি বাঁধ নির্মাণ "আগুনে ঘি ঢালার মতো। যতদিন চীন এই নদীগুলোর ওপর বাঁধ নির্মাণ করতে থাকবে, ততদিন ভয় ও উদ্বেগ অব্যাহত থাকবে এবং নিম্ন প্রবাহের দেশগুলোর কাছ থেকে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া আসবে।"

২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ার থিংক ট্যাংক লোই ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তিব্বত মালভূমি থেকে উৎপন্ন নদীগুলোর ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ ভারতীয় অর্থনীতি জন্য একটি "চোকহোল্ড" (গ্রাস করার শক্তি)।

'চোকহোল্ড'

ইতিহাসজুড়ে চীনে ইয়ারলুং ঝাংবো নদী প্রায়ই "পাগলা নদী" নামে পরিচিত ছিল। অন্যান্য প্রধান চীনা নদীগুলো মতো পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হলেও, এই নদী গ্রেট বেঞ্চে একটি তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে দক্ষিণে মোড় নেয় এবং ভারতে প্রবেশ করে।

ভারতের সীমান্তের কাছে এরকম একটি কৌশলগত অবস্থানে বেইজিংয়ের বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নয়াদিল্লির জন্য উদ্বেগজনক।

নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাহেলি চট্টরাজ বলেন, "এটা স্পষ্ট যে চীন পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য এই বাঁধটিকে ভারতীয়দের সঙ্গে তার সম্পর্কের কৌশলগত উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।"

অধ্যাপক দীপক তার সাথে একমত হয়ে বলেছেন, "চীন অস্ত্র হিসেবে পানি ব্যবহার করতে পারে, এ নিয়ে নিম্ন প্রবাহের দেশগুলো যেমন বাংলাদেশ এবং ভারত সবসময় ভয় পাবে। বিশেষ করে শত্রুতার সময়ে, কারণ বাঁধটির বিশাল জলাধার রয়েছে।" এই জলাধারটি ৪০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণ করতে পারে।

এছাড়া, ভূমির ভঙ্গুরতা উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। "নদীটিতে বাঁধা দেওয়ার সাথে সাথে একাধিক বিপদ জড়িত রয়েছে," বলেছেন দীপক। ২০ শতকের ৮.০ বা তার বেশি মাত্রার বড় ভূমিকম্পগুলোর প্রায় ১৫ শতাংশ হিমালয় অঞ্চলে ঘটেছিল।

তিব্বতে বড় ভূমিকম্পের ঘটনার এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ৭ জানুয়ারি ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্পে কমপক্ষে ১২৬ জনের মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পের পর চীনা কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন করা ১৪টি জলবিদ্যুৎ বাঁধের মধ্যে পাঁচটি বাঁধে ক্ষতির আশঙ্কাজনক চিহ্ন ছিল। একটি বাঁধের দেয়াল হেলে পড়েছিল, আবার কিছু বাঁধে ফাটল দেখা গেছে। তিনটি বাঁধ খালি করা হয়েছিল এবং বেশ কিছু গ্রাম থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

এদিকে, ভারত সরকার অরুণাচল প্রদেশের বাঁধ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বলেছে, তাদের ভূমি প্লাবিত করার জন্য চীন থেকে যে ঝুঁকি রয়েছে, তা মোকাবিলার জন্য একটি পালটা বাঁধের প্রয়োজন। সরকার থেকে এই সতর্কতার সঙ্গে "পানি বোমা" এবং "পানি যুদ্ধ"-এর মতো শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

সহকারী অধ্যাপক চট্টরাজ জানিয়েছেন, ভারত এবং চীন উভয়ের ওপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের মতো সাধু পানির উৎস প্রবাহিত হলেও, দুই দেশই জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ আইন চুক্তির স্বাক্ষরকারী নয়।

ভারত এবং চীন ২০০২ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহের তথ্য এবং উপাত্ত বন্যা মৌসুমে ভাগাভাগি করার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে ডোকলাম-এ ভুটানের সাথে তাদের সীমান্তে একটি সামরিক উত্তেজনার পর ভারত বলেছিল, বেইজিং পানিপ্রবাহের তথ্য দেওয়া অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছে।

সেই বসন্তে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্য আসামে বন্যার ফলে ৭০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ৪ লাখ জনেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

অধ্যাপক দীপক বলেন, "এটি একটি সমস্যা তৈরি করার মতো পরিস্থিতি এবং যখন সম্পর্কের অবনতি হয় বা এটি বৈরী হয়ে ওঠে যেমন ২০১৭ সালে হয়েছিল, তখন চীন অবিলম্বে তথ্য শেয়ার করা বন্ধ করে দেয়।"

প্রতিবেশীদের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্ক: মেদোগ কাউন্টি বাঁধ চীনের ১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০২১-২০২৫) অংশ ছিল। দশকেরও বেশি সময় ধরে এই পরিকল্পনা চলমান রয়েছে। তবে ২৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা আসার পরেই ভারতের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, "নয়াদিল্লি নদীর পানির ওপর ব্যবহারিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে" এবং "আমরা চীনকে নদীগুলোর ওপর মেগা প্রকল্প নির্মাণ নিয়ে নিয়মিত উদ্বেগ জানিয়েছি।"

তিনি আরও বলেছেন, "নয়াদিল্লি বেইজিংকে ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন প্রবাহের দেশগুলোর স্বার্থ নিশ্চিত করতে বলেছে এবং ভারত আমাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।"

দুই দিন পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সাংবাদিকদের বলেন, প্রকল্পটি "নিম্ন প্রবাহের অঞ্চলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না এবং বেইজিং "বিদ্যমান চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে [নিম্ন প্রবাহের] দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ বজায় রাখবে এবং দুর্যোগ প্রতিরোধে সহযোগিতা বাড়াবে।"

তবে, ভারত এবং চীনের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব রয়েছে।

গত অক্টোবর দুই দেশ ২০২০ সালে বিতর্কিত সীমান্তে এক মারাত্মক সামরিক সংঘর্ষের পর প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলা উত্তেজনাপূর্ণ সামরিক অবস্থান থেকে আলাদা হওয়ার জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছেছিল।

কিন্তু এই চুক্তিকে সম্পর্কের কোনো বড় উন্নতি হিসেবে ভুলভাবে নেওয়া উচিত নয় বলে সতর্ক করেছেন উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, "ভারত এবং চীনের মধ্যে অনেক বিরোধ এবং উত্তেজনা রয়েছে, যার মধ্যে এই নতুন পানি নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। তাই সম্পর্ক শক্তিশালী হওয়ার আশা করা যায় না।" 

কুগেলম্যান উল্লেখ করেছেন, ভারত এবং চীন উভয়েই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব ভোগ করছে, যেমন পানি সংকট। তাদের মধ্যে পানির জন্য এই লড়াই আগামী বছরগুলোতে আরো তীব্র হবে।

তিনি বলেন, "চীন থেকে নিম্ন অঞ্চলে পানির প্রবাহ আটকে যাওয়া ভারতের জন্য কঠিন হবে।"

'বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে' :  ভারত এবং চীনের মধ্যে টানাপড়েন চললেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে খারাপ প্রভাব বাংলাদেশের লাখো মানুষের ওপর পড়বে।

যদিও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ৫ লাখ ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশে মাত্র ৮ শতাংশ, নদীটি প্রতিবছর ৬৫ শতাংশেরও বেশি পানি সরবরাহ করে। এজন্য এটিকে "বাংলাদেশের জীবনরেখা" হিসেবে দেখা হয় বলে জানিয়েছেন ঢাকাভিত্তিক সিভিল সোসাইটি সংগঠন রিভারিন পিপলের সাধারণ সম্পাদক শেখ রোকন।

রোকন আল জাজিরাকে বলেছেন, "চীন ও ভারতের 'বাঁধের বদলে বাঁধ' প্রতিযোগিতার প্রভাব আমাদের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়বে।"

এই আশঙ্কাগুলো গত দশক ধরে সেজিআইএস (সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস) এর নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা খানকে উদ্বিগ্ন করে রেখেছে।

তিনি বলেন, "আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। কোনো সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন বা ব্যবহৃত প্রযুক্তির বিস্তারিত তথ্য নেই। আমাদের একটি সম্মিলিত এবং বিস্তারিত সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন এবং সামাজিক ও বিপর্যয় প্রভাব মূল্যায়ন প্রয়োজন। কিন্তু আমরা কিছুই পাইনি।"

ব্রহ্মপুত্র বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হওয়ার আগে বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম পলি মাটির অববাহিকা তৈরি করে। লাখো মানুষ এই নদীর ওপর নির্ভরশীল।

মালিক ফিদা খান বলেন, "যদি পলি প্রবাহে কোনো অস্বাভাবিকতা ঘটে, তাহলে নদীভাঙন বাড়বে এবং জমি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যাবে।"

তিনি আরও বলেন, ভারতের বাঁধ বিশেষভাবে বাংলাদেশের অববাহিকার অংশে ক্ষতিকর হতে পারে। "একটি বাঁধকে অন্য একটি বাঁধ দিয়ে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। এটি আমাদের নদী তীরবর্তী এলাকায় বসবাস করা লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিপদে ফেলবে"

রোকন তার সাথে একমত। বাংলাদেশের বর্তমান নীতির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, "চীনা বা ভারতীয় বাঁধগুলোর ব্যাপারে আমাদের 'অপেক্ষা এবং দেখা' মনোভাব থেকে বের হতে হবে। ব্রহ্মপুত্র নদী নিয়ে আলোচনা শুধু বাংলাদেশ এবং ভারতের বা ভারত ও চীনের মধ্যে আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়; এটি একটি নদী অববাহিকাভিত্তিক আলোচনা হওয়া উচিত।"

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা [যার সরকার দিল্লির সমর্থন পেয়েছিল] ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার ভারতের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মানে হল চীনের ব্রহ্মপুত্র নদী নিয়ে কর্তৃত্ব বাড়ানোর বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কোনো যৌথ উদ্যোগ বা একত্রিত প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না।

এদিকে, ফিদা খান এই জলসংকটকে "ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের একটি সোনালি সুযোগ" হিসেবে দেখলেও, উইলসন সেন্টারের কুগেলম্যান এ নিয়ে আশাবাদী নন।

কুগেলম্যান বলেন, "আমরা দেখেছি, চীন এমন একটি দেশ যা বহিরাগত চাপ গ্রহণ করে না। সেটা এক দেশ থেকেই হোক বা দুই বা দশ দেশ থেকে। এমনকি ভারত এবং বাংলাদেশ যদি যৌথভাবে চীনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে সক্ষম হয়, তাও সেটি বেইজিংয়ের পদক্ষেপ আটকাতে যথেষ্ট হবে না।"

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জলসংকটের সম্মুখীন হওয়া জনগণের জন্য হুমকি কেবল বাড়বে।

কুগেলম্যান আল জাজিরাকে বলেন, "এই জলসংকটের গুরুত্ব এবং তীব্রতা যথেষ্টভাবে বলা হয়নি, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আগামী দশকে এই সংকটকে আরও বিপজ্জনক এবং সম্ভাব্যভাবে অস্থিতিশীল করতে পারে ।" 

সিয়াং নদীর তীরে পরং গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা গেগং জিজং বলেন, "আমরা আরও বেশি মানুষকে এই বাঁধগুলোর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করছি।"

তিনি বলেন, "আমি জানি না পরবর্তী প্রজন্মের কী হবে। যদিও আমি ৯০ বছর বয়সী এবং হাঁটতে পারি না, তবুও আমি প্রতিরোধ করতে থাকব।"  অনুবাদ: বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়