মহসিন কবির: ক্ষমতার পালাবদলে পরিবর্তন এসেছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, পরিবর্তিত হচ্ছে কূটনৈতিক সম্পর্কও। আর এসবের বেড়াজালে পড়ে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত। এশিয়ায় তাদের বন্ধু রাষ্ট্র নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিছুটা ভাল থাকলেও আবার খারাপ হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ইচ্ছা করেই বিবাদ করছে ভারত।
গাছের ডাল কাটাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকদের মধ্যে হাতাহাতি, বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় দিনভর চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তে উত্তেজনার পর দুই দেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার দুপুর থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের চৌকা এবং কিরণগঞ্জ বিজিবি সীমান্ত ফাঁড়ির মাঝামাঝি সীমান্তবর্তী মাঠে দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বলে শিবগঞ্জ থানার ওসি গোলাম কিবরিয়া জানান।
এর প্রতিবাদে দিল্লির বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন, বিএসএফের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন', 'সীমান্তে হামলা হলে জবাব দেবে বাংলাদেশ', শনিবার গভীর রাতে এই ধরনেরই স্লোগানে মুখোরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর দাবি ভারতীয়
বিএসএফের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গভীর রাতে মিছিল বের তাঁরা। গতকাল স্থানীয় সময় রাত ১১টার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে মিছিল শুরু করে 'আগ্রাসনবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ' ব্যানারের অধীনে থাকা কয়েকজন ছাত্র। এরপর ক্যাম্পাস ঘুরে এসে উপাচার্যের বাসভবনের সামনেই একটি সংক্ষিপ্ত সভা করেন তাঁরা। এর আগে আবার স্থানীয় সময় রাত ৯টায় ঢাকার বাংলা মোটর এলাকায় মশাল মিছিল করে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের পড়ুয়া তথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রাক্তন সমন্বয়ক রেজওয়ান আহমে বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের সময় পারকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্র তুলে নিয়েছিল কৃষক সমাজ। চাঁপাইনবাবগঞ্জেও একই ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের এক ইঞ্চি মাটিতেও ভারতের থাবা পড়তে দেব না। বাংলাদেশের মানুষ সীমান্ত রক্ষা করতে জীবন দিতে প্রস্তুত।' এদিকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রাক্তন সমন্বয়ক মহম্মদ হাসিবুল ইসলাম আবার বলেন, 'দিল্লির কথা মতো আর চলবে না বাংলাদেশ। বিএসএফ যদি হামলা চালায়, তাহলে বিজিবি এবং দেশের মানুষ জবাব দিতে প্রস্তুত।'
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগামী সোমবার (২০ জানুয়ারি) শপথ নিতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার অভিষেক উপলক্ষে আমন্ত্রণ পেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব নেতারা। আমন্ত্রিতদের মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং থাকলেও তালিকায় নাম নেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে ভারত থেকে যোগ দেবেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক উপলক্ষে আমন্ত্রণ পেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব নেতারা। তালিকায় ইউরোপের মধ্যমপন্থিদের বাদ দিয়ে অনেক কট্টর ডানপন্থি ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমন্ত্রণের তালিকায় রয়েছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এবং আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জেভিয়ার মিলেই।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসাকারী হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্তর অরবানও আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তবে অরবানের কার্যালয় থেকে হাঙ্গেরির সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়েছে, তিনি ওই অনুষ্ঠানে থাকতে পারছেন না।
আমন্ত্রিতদের মধ্যে আছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নামও। শুক্রবার ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের সঙ্গে ফোনালাপ করেন। এসময় জিনপিং ট্রাম্পকে পুনরায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানান। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেন দুই নেতা।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ডম্বুর ও গজলডোবা বাঁধ খুলে আকস্মিক বন্যা সৃষ্টির প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
২২ আগস্ট দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরবর্তীতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা রায়সাহেব প্রদক্ষিণ করে পুনরায় ক্যাম্পাসে এসে আবার বিক্ষোভ শুরু করে। মিছিলে প্রায় ছয় শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেয়।
এসময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা- ‘অ্যাকশন, অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘ভারতীয় দালালেরা, হুঁশিয়ার, সাবধান’। ‘দিল্লি না ঢাকা? ঢাকা, ঢাকা’। ‘ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘পেতে চাইলে মুক্তি, ছাড়তে হবে ভারত ভক্তি’, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ, রাজপথ’ সহ নানা স্লোগান দিতে থাকেন।
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সাল থেকে ভারত সরকার পাকিস্তানে ঢুকে প্রায় ২০ জনকে হত্যা করেছে। তবে রয়টার্সের পক্ষ থেকে ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তাতে সাড়া দেয়নি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
২০১৯ সালে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি গাড়ির বহরে বোমা হামলার পর দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। হামলায় পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার দাবি ভারতের। এর জবাবে পাকিস্তান জঙ্গিদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় ভারত।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী আবারও ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ অধিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিস্ফোরক বিবৃতিতে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দিবেদির চরম দ্বিচারিতার নিন্দা করেছে। পাকিস্তানের দাবি, ভারত তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য মিথ্যা অভিযোগ তুলছে। আইএসপিআর আরও জানিয়েছে, ভারতীয় সেনাপ্রধানের এই মন্তব্যটি ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যমূলক। এটি ভারতীয় সরকারের নিজস্ব ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে প্রশ্ন উঠছে, ভারত কেন এমন অভিযোগ করছে? তাদের আসল উদ্দেশ্য কী?
ভারতীয় সেনাপ্রধান দাবি করেছেন, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রস্থল। তিনি বলেন, অবৈধভাবে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে সহিংসতা পাকিস্তান থেকে পরিচালিত হচ্ছে। আরও চমকপ্রদ দাবি করে তিনি জানান, গত বছর নিহত সন্ত্রাসীদের ৬০% পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত।
এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের এসব বক্তব্যকে মিথ্যা দাবি করে, বলে যাচ্ছে যে, ভারতীয় সেনাপ্রধান নিজের দেশের ব্যর্থতা ঢাকতেই এমন মন্তব্য করেছেন। পাকিস্তান আরও বলেছে, এই মন্তব্য কেবল মিথ্যাই নয়, বরং ভারত কাশ্মীরে চলমান দমন-পীড়নের ওপর থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা করছে।
পাকিস্তান দাবি করেছে, ভারতের উচিত আত্মসমালোচনা করা। কাশ্মীরের নিরীহ মানুষদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন করা যাবে না।
পাকিস্তানের আইএসপিআর ভারতীয় সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিতর্কিত অঞ্চল। এর চূড়ান্ত মর্যাদা নির্ধারিত হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব এবং কাশ্মীরি জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে।’’
এই পরিস্থিতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দেয় না? পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকে ভদ্রতা, পেশাদারিত্ব এবং রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রের আচরণের নিয়ম মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
এ সংঘাত কি কখনো শেষ হবে না? ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের এই টানা-পড়েন কেবল দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার লড়াই, নাকি বৃহত্তর এশিয়ার ক্ষমতার লড়াই?
ভারত-কানাডা সম্পর্ক: ট্রুডোর পদত্যাগের পর ভারত-কানাডা সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কানাডায় শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে ভারতের জড়িত থাকার বিষয়ে অভিযোগ করেন ট্রুডো। এর পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে। তবে অনেক ইন্ডিয়ান-কানাডীয় আশা করছেন, নতুন নেতৃত্বে সম্পর্কের উন্নতি হতে পারে।
সুরজ সুভদর্শি বলেন, ‘নতুন সরকার ভারত-কানাডা সম্পর্ক মেরামতের দিকে মনোযোগ দেবে বলে আশা করি। তবে অভিবাসন নীতি আরও কঠোর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
কনজারভেটিভ নেতা পিয়েরে পোলিয়েভর ট্রুডোর অভিবাসন নীতির কড়া সমালোচনা করেছেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি অভিবাসন সীমিত করে বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও চাকরি প্রাপ্যতার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করার প্রস্তাব দেন।
সুরজ সুভদর্শি এনডিটিভিকে বলেন, ‘পোলিয়েভরের নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখি। আমি মনে করি, কনজারভেটিভদের সুযোগ দেওয়ার সময় এসেছে।’