বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনার মাঝেই বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ভাষণে আরো একবার উঠে এলো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ।
সোমবার বিধানসভার অধিবেশনে তিনি যেমন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তেমনই 'একটা রাজনৈতিক দলের' বিরুদ্ধে ফেক ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগ তুলেছেন।
নাম না করেই তিনি উল্লেখ করেছেন দুই দেশের সম্পর্কে বর্তমানে যে টানাপোড়েন চলছে সেই পরিস্থিতির ফায়দা তুলতে চাইছে ওই দল। তার কথায়, ‘অনেক ফেক ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে। একটা রাজনৈতিক দল উস্কানি দেয়ার চেষ্টা করছে।’
বিধানসভায় তার ভাষণে সম্প্রীতি ও শান্তির পরিবেশ বজায় রাখার এবং প্রতিবেশী দেশের বিষয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সংযত থাকার অনুরোধও করেছেন তিনি।
অন্যদিকে, দিন কয়েক আগে বাংলাদেশের একটা ভিডিও প্রকাশ্যে আসে যেখানে কিছু ব্যক্তিকে 'কলকাতা দখলের' ডাক দিতে দেখা গিয়েছিল। নিজেদের সাবেক সেনা কর্মকর্তা বলে জানিয়েছিলেন তারা।
একইসাথে অন্য একটা ভিডিওতে বাংলাদেশের এক প্রবীণ নেতাকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা দখলের কথাও বলতে শোনা গিয়েছিল। যারা এই মন্তব্য করেছেন তাদের উদ্দেশে কড়া হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
গত সপ্তাহে বিধানসভার অধিবেশনে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন। কেন্দ্র সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন যাতে কেন্দ্রের তরফে জাতিসঙ্ঘের কাছে বাংলাদেশে শান্তি সেনা পাঠানোর আর্জি জানানো হয়। তার সেই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল বাংলাদেশ।
কী বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী?
দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মাঝে তার দলের নেতা-সহ সবাইকে শান্ত থাকার এবং উস্কানিমূলক মন্তব্য করা থেকে দূরে থাকার বার্তা দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। সীমান্তবর্তী রাজ্যের শান্তি যাতে কোনোভাবে বিঘ্নিত না হয় তা নিশ্চিত করার জন্যই এই আহ্বান।
বিধানসভায় তার বক্তব্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো বলেছেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা হচ্ছে, তা দুঃখজনক।’
একই সাথে সমস্ত বিধায়কের উদ্দেশে বলেছেন, ‘কেউ উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেবেন না।’
মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘হিন্দু, মুসলিম, শিখ বা খ্রিস্টানরা দাঙ্গা শুরু করে না। সমাজবিরোধীরা দাঙ্গা শুরু করে। আমাদের এমন কোনো মন্তব্য করা উচিত নয় যাতে বাংলায় খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমি খুশি যে এখানকার হিন্দু এবং সংখ্যালঘু উভয় সম্প্রদায়ই বাংলাদেশে অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। এটা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ স্বভাবের পরিচয় দেয়।’
সোমবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে তিনি জানান, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের যে অভিযোগ উঠেছে তার প্রতিবাদ জানিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা সমাবেশ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
তৃণমূল সুপ্রিমো বলেছেন, ‘আমি তাদের নিষেধ করেছি। অনেকে এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন। তারা আরেকটা দাঙ্গা শুরু করবে। আমরা দাঙ্গা চাই না, শান্তি চাই। হিন্দু-মুসলিম, শিখ ও খ্রিস্টানদের রক্ত একই।’
এরপরই কারো নাম না করে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের অনুরোধ করছি। অনেক ফেক (ভুয়ো) ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা রাজনৈতিক দল ইন্ধন দেয়ার চেষ্টা করছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষকেই এই বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।’
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের যে অভিযোগ উঠেছে, কিছু ক্ষেত্রে সেই বিষয়কে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘যারা এটা নিয়ে রাজনীতি করার কথা ভাবছেন, তাদের মনে রাখা উচিত, এতে আপনার রাজ্যেরও ক্ষতি হবে। ওখানে (বাংলাদেশে) থাকা বন্ধুদেরও ক্ষতি হবে।’
প্রতিবেশী দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ তুলে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোকে প্রতিবাদ দেখাতে দেখা গিয়েছে। বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকেও প্রতিবাদী কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধেও তাকে কটাক্ষ করতে শোনা গিয়েছে। শুভেন্দু অধিকারীসহ বিরোধী নেতাদের কটাক্ষের নিশানা থেকে বাদ যাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। বাংলাদেশের প্রসঙ্গে তৃণমূল তেমন সক্রিয় নয় বলে সমালোচনা করেছে বিজেপিসহ বিরোধীরা।
ওয়াকিবহাল মহলের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের বিষয় সরব বিজেপি ২০২৬-এর ভোটকে পাখির চোখ করে পশ্চিমবঙ্গে এগোতে চাইছে। তবে সোমবার বিধানসভার ভাষণে একবারও কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের নাম করেননি মমতা ব্যানার্জি।
কেন্দ্রের নীতির সমর্থন
বাংলাদেশ নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস এবং রাজ্য সরকারের পুরনো অবস্থানের কথা আরো একবার স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অনেকেই সীমান্ত দিয়ে রাজ্যে ঢুকতে চায়। ব্যাপারটা বিএসএফ দেখছে। আমরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। আমরা সীমান্ত সামলাচ্ছি না।’
‘আমরা পররাষ্ট্র বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না।’
কেন্দ্রের নীতি সমর্থনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সোমবার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের ব্যাপারটা কেন্দ্রীয় সরকার দেখবে। আমরা কোনো পক্ষে নেই। আজ পররাষ্ট্র সচিব (বাংলাদেশে) যাচ্ছেন। দেখা যাক কী হয়। আমাদের নীতি হলো আমরা বিদেশনীতি মেনে চলব।’সূত্র : বিবিসি
আপনার মতামত লিখুন :