শিরোনাম

প্রকাশিত : ০৯ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৭:০৮ বিকাল
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ঋণ দেওয়ায় চীনের চেয়ে ৫ গুণ পিছিয়ে ভারত

বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ: দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে চীনের তুলনায় ভারতের সক্ষমতা ব্যাপক হ্রাস পাচ্ছে। উল্টো ভারতের নিজেরই ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক ঋণ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ভারতের মোট ঋণ গ্রহণের পরিমান গত বছর ৩১ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে তা দাঁড়িয়েছে ৬৪৬.৭৯ বিলিয়নে। গত বছর নেওয়া ভারতকে এ ঋণের বিপরীতে সুদ দিতে হবে ২২.৫৪ বিলিয়ন ডলার। এর আগের বছর ভারতের নেওয়া ঋণে সুদের পরিমান ছিল ১৫.০৮ বিলিয়ন ডলার। 

গত মঙ্গলবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক ঋণ প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যাচ্ছে, চীন ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোকে ৪৮.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, অথচ এসব দেশগুলোকে নয়াদিল্লি যে পরিমান ঋণ প্রদান করেছে তার পাঁচ গুণেরও বেশি ঋণ দিয়েছে বেইজিং। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য বিদেশী প্রতিষ্ঠান সহ বহিরাগত ঋণদাতাদের কাছে ৩২৪.৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে। আর চীন একাই এসব দেশকে দিয়েছে ৪৮.১ বিলিয়ন ডলার। ভারত একই দেশগুলিকে ঋণ দিয়েছে মাত্র ৯ বিলিয়ন ডলার। যা এই দেশগুলির মোট ঋণের ২.৮ শতাংশ। তবে ভারত এ অঞ্চলে ভুটান ও শ্রীলঙ্কাকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে। 

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রতিবেশি দেশগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত পিছিয়ে থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাব ও এসব দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একধরনের প্রপাগান্ডা অব্যাহতভাবে প্রচার করে চলেছে যা প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হতে  সবসময় বাধা সৃষ্টি করে আসছে। একই কারণে দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা পরিষদ সার্ক কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না। বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদরা বলে আসছেন ভারতের ‘বিগ্র ব্রাদার’ নীতির কারণেই আঞ্চলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ইউরোপিও ইউনিয়ন, ব্রিকস বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক জোটের মত কখনোই একাট্টা হয়ে নিজেদের মধ্যে উন্নয়নের অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করতে পারছে না।  

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ এই আন্তর্জাতিক ঋণ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়. আফগানিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমান প্রায় ৩.৪ বিলিয়ন ডলার। আর দেশটিকে সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশ রাশিয়া। অথচ একসময়ে আফগানিস্তান রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের কবলে পড়েছিল। দুটি দেশই বছরের পর বছর যুদ্ধ করেছে। আর বর্তমানে কাবুল রাশিয়ার কাছে তার মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ ঋণী, যার পরিমান ১.২ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্যণীয় দিক হচ্ছে, আফগানিস্তানের কোনো প্রতিবেশী দেশ নয়, সৌদি আরব এবং ইতালি আফগানিস্তানের জন্য অন্যান্য বড় দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতা। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে ভারত বা চীন আফগানিস্তানকে কি পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। 

আবার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ বেইজিং থেকে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। মোট বিদেশি ঋণের ৯ শতাংশ। কিন্তু চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতা দেশ নয়। বৃহত্তম ঋণদাতা দেশ হিসেবে টোকিও ঢাকাকে ১৫.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, এরপর আছে রাশিয়া, তৃতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা হিসেবে বাংলাদেশকে দিয়েছে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক (২৬ শতাংশ) এবং এডিবি (২০ শতাংশ) বাংলাদেশের দুটি বৃহত্তম প্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতা। শুধু বাংলাদেশ নয় এ অঞ্চলে জাপান নেপাল ও মিয়ানমারের সর্বোচ্চ ঋণ দাতা ও শ্রীলঙ্কাকে তৃতীয় সর্বোচ্চ ঋণদাতা দেশ। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বিদেশি ঋণগ্রহীতা দেশ পাকিস্তান নিয়েছে ১৩০ বিলিয়ন আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহীতা দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ ১০১ বিলিয়ন ডলার। 

আবার দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটানকে ভারত সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে ভুটানের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৩ বিলিয়ন ডলার। থিম্পুতে নিখুঁত শর্তে ভারতের মোট ঋণ প্রায় ২.১ বিলিয়ন। ভুটানের মোট ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতাদের, যার মধ্যে রয়েছে জাপান (৩ শতাংশ) এবং অস্ট্রিয়া (০.২ শতাংশ)। এডিবি (১৫ শতাংশ) এবং বিশ্বব্যাংক (১৪ শতাংশ) সহ বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান দুটি বড় ঋণদাতা।

এ অঞ্চলে ছোট দেশ হিসেবে মালদ্বীপের মোট ঋণের পরিমান ৪ বিলিয়ন ডলার। দেশটির বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতা হল চীন এবং ভারত, যা তার মোট ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশ। কিন্তু বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলি মালদ্বীপের মোট ঋণের ১৮ শতাংশ, বন্ডহোল্ডার এবং বাণিজ্যিক ঋণ সহ ব্যক্তিগত ঋণদাতারা দেশটির মোট ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশ দিয়েছে। এক্ষেত্রে দেশটির কাছে চীনের ৯৬০ মিলিয়ন বা মোট ঋণের ২৪ শতাংশ পাওনা রয়েছে, ভারতের রয়েছে প্রায় ৬৪০ মিলিয়ন বা ১৬ শতাংশ পাওনা। 

বিশ্বব্যাংকের হিসেবে মিয়ানমারের মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ১২.১ বিলিয়ন, এর মধ্যে ৬ শতাংশ (৭২০ মিলিয়ন) চীনের কাছে পাওনা। জাপান মিয়ানমারের পাওয়া মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ দিয়েছে যার পরিমাণ ৪.৩৫৬ বিলিয়ন। দেশটির প্রায় ১৫ শতাংশ ঋণ বেসরকারী ঋণদাতাদের কাছে পাওনা, এর প্রায় ২৮ শতাংশ বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি সহ বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা। 

সম্প্রতি মিয়ানমারে বেইজিং ২.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে মি লিন গিয়াং-এ এলএনজি পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং নিউ ইয়াঙ্গুন প্রকল্পের মতো অবকাঠামো প্রকল্পে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন। এর বিপরীতে ভারত মিায়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল সংযোগ, দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বেশ কিছু অবকাঠামো প্রকল্প বিনিয়োগ বিলম্বিত করেছে। ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপাক্ষিক মহাসড়ক (আইএমটি হাইওয়ে) এমন একটি প্রকল্প, যা মণিপুরের মোরেহকে থাইল্যান্ডের মায়ে সোটের সাথে মিয়ানমার হয়ে সংযুক্ত করবে। প্রকল্পের সিংহভাগ যাবে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে।

নেপালের পাওনা বৈদেশিক ঋণের প্রায় ৮৮ শতাংশ বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি-র মতো বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর মোট ৯.৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণ মজুদের মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশ বিশ্বব্যাংকের, আর ৩৩ শতাংশ এডিবির কাছ থেকে। নেপালের দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতা হিসেবে ভারত এবং চীন উভয়ই কাঠমান্ডুর মোট ঋণের ৩ শতাংশ দিয়েছে যা ৩০০ মিলিয়ন ডলার। জাপান দেশটিকে দিয়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায় ইসলামাবাদ এই অঞ্চলে চীনা ঋণের বৃহত্তম প্রাপক, বেইজিং থেকে প্রায় ২৮.৬ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে, যা তার মোট ঋণের ২২ শতাংশ। চীন পাকিস্তানের জন্য একক বৃহত্তম ঋণদাতা, যেটি বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং আইএমএফ সহ বিভিন্ন বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ঋণের ওপর ইসলামাবাদের সুদের অর্থের পরিমাণ তার মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৪৩ শতাংশ, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ।

এছাড়া চীন, সৌদি আরব এবং আমিরাতের কাছ থেকে পাকিস্তান ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে।
শ্রীলঙ্কাকে ভারত ঋণ দিয়েছে ৬.১ বিলিয়ন ডলার যা মোট ঋণের ১০ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের মতে, কয়েক বছর ধরে চীন শ্রীলঙ্কাকে ৮.৫৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার মোট ঋণ প্রায় ৬১.৭ বিলিয়ন। জাপান দ্বীপরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতা, যার মোট ঋণের প্রায় ৬ শতাংশ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়