টানা কয়েকদিন বিমান হামলার পর মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) ভোর থেকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। ইসরাইলের নতুন এই সামরিক অভিযান তাদের জন্য বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সবশেষ ২০০৬ সালে লেবানন ভূখণ্ডে স্থল অভিযান পরিচালনা করে পরাজিত হয় ইসরাইল।
২০০৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া মাসব্যাপী যুদ্ধে ইসরাইলি সেনারা হিজবুল্লাহর তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ওই যুদ্ধে ইসরাইলের কমপক্ষে ২০টি ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং ১২১ জন সেনা নিহত হয়। লেবাননে ওই সামরিক আগ্রাসনের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিশন উইনোগ্রাড জানায়, ‘ইসরাইল দীর্ঘ একটি যুদ্ধ শুরু করেছিল, যা কার্যত সামরিক বিজয় ছাড়াই শেষ হয়েছিল।’
প্রায় দুই দশক পর মঙ্গলবার ইসরাইল আবারও দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভিযান শুরু করেছে। যদিও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অভিযানের জন্য সেনা ও ট্যাঙ্কের উপস্থিতি দেখে বোঝা যায় যে, ইসরাইল হয়তো দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গত বছরের অক্টোবরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই লেবানন সীমান্তে যুদ্ধ করছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহর হামলার কারণে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে উত্তর ইসরাইলের প্রায় ৬০ হাজার বাসিন্দা।
সেই বাসিন্দাদের ঘরে ফেরানোর লক্ষ্যে সম্প্রতি লেবাননে ব্যাপক আকারে হামলা শুরু করে নেতানিয়াহু বাহিনী। প্রধানত বিমান ও ড্রোন ব্যবহার করে এই হামলা চালানো হয়। প্রায় দুই সপ্তাহে লেবাননে ইসরাইলি হামলায় এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩২ বছর ধরে হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব দেয়া হাসান নাসরুল্লাহ ও আরও কয়েকজন কমান্ডার রয়েছেন।
লেবাননের দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ জানিয়েছে, ইসরাইলি আগ্রাসানের শিকার এলাকাগুলো থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যার মধ্যে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬০০ জনের তথ্য আশ্রয়কেন্দ্রে নিবন্ধিত রয়েছে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, হিজবুল্লাহ যেন আর ইসরাইলি নাগরিকদের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে না পারে তা নিশ্চিত করা তার সরকারের দায়িত্ব। বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহু সরকার হয়তো হিজবুল্লাহর শক্তি ও সক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করছে এবং ইসরাইল আবারও লেবাননে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
যুদ্ধের প্রস্তুতি: যুদ্ধের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর প্রধান হারজি হালেভি হিজবুল্লাহর বিপক্ষে লড়াইয়ে আরও পেশাদার ও অভিজ্ঞ বাহিনী পাঠানোর ঘোষণা দেন।
ইসরাইলি সেনাপ্রধান ২০০৬ সালের যুদ্ধ থেকে নেয়া শিক্ষার দিকে ইঙ্গিত করে সেনাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের মুখোমুখি হলে তাদের দেখিয়ে দেবেন কীভাবে একজন পেশাদার, অত্যন্ত দক্ষ এবং যুদ্ধ-অভিজ্ঞ বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়।
৭ম সাঁজোয়া ব্রিগেডের পাশাপাশি ইসরাইলি সামরিক বাহিনী তাদের ৯৮তম ডিভিশনের অভিজ্ঞ বিমানবাহিনী সেনাদের সমাবেশ করেছে, যারা গাজায় কয়েক মাস ধরে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল এবং উত্তর কমান্ডের অধীনে থাকা ইউনিটগুলোর রিজার্ভ সেনাদেরও সক্রিয় করেছে।
আলজাজিরার প্রতিরক্ষা সম্পাদক অ্যালেক্স গ্যাটোপোলোস বলেছেন, ইসরাইল হিজবুল্লাহকে তাদের উদ্দেশ্য গুরুত্ব দিতে এলিট ইউনিট পাঠিয়েছে। ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের হাতে আট সেনা হত্যা এবং আরও দুই অফিসারকে অপহরণ হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইল দ্রুত একটি অভিযান শুরু করেছিল। যদিও এবার তেমনটি হচ্ছে না।
হিজবুল্লাহর প্রতিক্রিয়া: ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ কখনোই বন্ধ করেনি হিজবুল্লাহ। ইসরাইলি সেনাবাহিনী সম্পর্কে গ্যাটোপোলোস বলেন, ‘যখন আপনি ভাবেন যে আপনার প্রতিপক্ষ আপনাকে প্রতিরোধ করতে পারবে না, তখন আপনি তাদের হালকাভাবে নেন। এই অহংকার বেশ বিপজ্জনক।’
তিনি বলেন, ২০০৬ সালের তুলনায় হিজবুল্লাহ যোদ্ধা এখন অনেকে বেড়েছে। সেই সময় দক্ষিণ লেবাননে প্রায় ৫ হাজার সেনা ছিল। তাদের অভিজাত রাদওয়ান ফোর্সের যোদ্ধারা দক্ষিণে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং তারা এলাকাগুলো হাতের তালুর মতো চিনে। এই অভিজাত বাহিনীর সংখ্যাও প্রায় ৩ হাজার।
এছাড়া হিজবুল্লাহর কাছে হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত রয়েছে বলে জানা যায়। ২০১৩ সাল থেকে বাশার আল-আসাদের শাসনের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতাও সমৃদ্ধি হয়েছে।
যদিও ইসরাইলি সামরিক বাহিনী এখন হিজবুল্লাহর অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নজরদারি ড্রোনগুলোর ওপর নির্ভর করতে পারে। তবে লেবানেন ভূগর্ভস্থ যুদ্ধের টানেলগুলো হিজবুল্লাহকে নিজ দেশে সামরিক সুবিধা দিতে পারে।
যুদ্ধের লক্ষ্য: সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ও ওয়াশিংটন ডিসির আরব সেন্টারের সিনিয়র ফেলো নাবিল খুরি আল জাজিরাকে বলেন, বর্তমান সংঘাতে ইসরাইলের লক্ষ্য শুধু হিজবুল্লাহর মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তুতে সীমাবদ্ধ করছে না।
তিনি বলেন, সামরিকভাবে তারা নির্দিষ্ট লক্ষ্য বেছে নিয়ে কিছু লোককে হত্যা করতে পারে। তবে তাদের লক্ষ্য তার চেয়ে অনেক বিস্তৃত। তারা গাজা, পশ্চিম তীরের জন্য এবং এখন স্পষ্টভাবে লেবাননের জন্য একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
‘সুতরাং আমি মনে করি না যে এটি (লেবাননের) মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত অভিযান হবে এবং এটি অবশ্যই ইসরাইলের জন্য সহজ হবে না। এটা কঠিন হবে এবং লেবাননে তারা যে ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে তাতে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী না চাইলেও সেখানে দীর্ঘ সময় থাকতে বাধ্য হবে’, বলেন খুরি।
শেষ পর্যন্ত ইসরাইলি সামরিক বাহিনী হিজবুল্লাহর হুমকি দূর করার জন্য একটি ‘সীমিত’ অভিযান পরিচালনার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। যদিও হিজবুল্লাহর হুমকি দূর করার যে লক্ষ্য এটি বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসরাইল কতদূর যেতে রাজি তা নৈতিকভাবে এবং ভৌগোলিকভাবে এখনও স্পষ্ট নয়। গ্যাটোপোলোসের মতে, ইতিহাস যদি নির্শক হয়, তবে এটি ইসরাইলে জন্য একটি খুব অগোছালো অভিযান হতে চলেছে। উৎস: সময়নিউজটিভি।