শিরোনাম

প্রকাশিত : ১২ অক্টোবর, ২০২৪, ১২:২৫ দুপুর
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৫:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ভ্যাপিং বা ই-সিগারেটের থাবা !

ভ্যাপিং বা ই-সিগারেট দিন দিন বাড়ছে। সম্প্রতি রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার কয়েকটি স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা স্কুলের ব্যাগে করে ভ্যাপিং বা ই-সিগারেট নিয়ে আসে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। লালবাগের একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির কিছু শিক্ষার্থীর স্কুল ব্যাগে সুগন্ধি মেশানো নানা ফ্লেভারের ই-সিগারেট দেখতে পান শিক্ষকরা। তাৎক্ষণিক বিষয়টি অভিভাবকদের ডেকে অবহিত করেন তারা। ভ্যাপিং বা ই-সিগারেটের শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতিকর দিক এবং এটি নিষিদ্ধ একটি পণ্য তাও তাদের অভিভাবকদের জানান স্কুল কর্তৃপক্ষ। সূত্র : মানবজমিন

শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের হুমকির কথা তুলে এখনই তাদের সন্তানদের সাবধান করার পরামর্শ দেন শিক্ষকরা। কয়েকজন ছাত্র শিক্ষকদের জানায়, যেসব ছাত্রদের স্কুল ব্যাগে ই-সিগারেট পাওয়া গেছে এসব শিশু শিক্ষার্থীরা বাবা মা’র চোখ ফাঁকি দিয়ে খেলাধুলার নামে মাঠেও নিয়ে যায় এসব পণ্য। সেখানে দল বেঁধে এগুলো সেবন করে। র্থীরা টিফিনের ও যাতায়াতের খরচের নাম করে বাবা-মা’র কাছ থেকে টাকা নিয়ে এগুলো কিনে বলে ওই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা জানিয়েছেন।

ই-সিগারেট গ্রাস করছে তরুণ সমাজকে। এতে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস (ভ্যাপিং, ই-সিগারেট)-এর আবির্ভাবের পর থেকে বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের পদ্ধতি ও ব্যবহার, বিপণন কৌশল, তামাক আসক্তি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কৌশলী প্রচার-প্রচারণার কারণে এসব পণ্যের জনপ্রিয়তা এবং ব্যবহার বর্তমানে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইতিমধ্যে অনেক দেশ ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং পণ্য নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশেও দাবি উঠেছে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে অবশ্যই ই-সিগারেট বন্ধে আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। 

রাস্তাঘাট, ক্যাম্পাস, তরুণদের আড্ডাস্থল, বিভিন্ন মার্কেট এবং রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা ভ্যাপিং ক্লাবে এসব পণ্যের ব্যবহার ব্যাপকহারে চোখে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান বাজারে মোট দুই ধরনের ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম্‌স এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট। ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম্‌স এক ধরনের ব্যাটারিচালিত ডিভাইস যা ই-লিক্যুইড বা নিকোটিনযুক্ত তরল দ্রবণকে তাপের মাধ্যমে বাষ্পে রূপান্তরিত করে। একজন ব্যবহারকারী যখন ডিভাইসটিতে টান দেয়, তখন নিকোটিনের দ্রবণ গরমে বাষ্পীভূত হয় এবং ব্যবহারকারীকে নিকোটিন সরবরাহ করে।

নিকোটিন ছাড়াও নানারকম রাসায়নিক মিশ্রণ এবং সুগন্ধি মেশানো থাকে, যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইলেক্ট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট, ভ্যাপ বা ভ্যাপ পেন্‌স?, ই-হুক্কা, ই-পাইপ এবং ই-সিগার প্রভৃতি এন্ডস?? পণ্যের বিভিন্ন ধরন। সাধারণ সিগারেট বা পাইপ আকৃতি ছাড়াও এগুলো দেখতে কলম, পেনড্রাইভ, বিভিন্ন খেলনা কিংবা সিলিন্ডার আকৃতির হয়ে থাকে।

ধানমণ্ডির লেকের পাড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন স্নাতক পর্যায়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে তিন-চার জন ই-সিগারেট টানছিলেন। কিছুক্ষণ পরপর মুখ দিয়ে পাফ নিচ্ছেন আর মুখ থেকে অনেক ধোঁয়া ছাড়ছেন। জানতে চাইলে এই প্রতিবেদককে একজন জানান, ই-সিগারেটের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তার তেমন জানা নেই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় থাকলে তিনি ই-সিগারেট টানেন। তার মতে, এটা সিগারেটের চেয়ে কিছুটা ‘নিরাপদ’। 

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য সচিব এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল শাফি মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, স্কুল গোয়িং শিক্ষার্থীরাও ভ্যাপিং বা ই-সিগেটে ঢুকে যাচ্ছে, যা আমাদের জন্য অ্যালার্মিং এবং পার্শ্ববর্তী দেশসহ ৩৪টি দেশে পণ্যটি নিষিদ্ধ। এই হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান কঠোর থাকবে। প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য আইনকে শক্তিশালী করা দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

অতি সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত WHO Report on Global Tobacco Epidemic ২০২১ এ ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেমস (ENDS) অর্থাৎ ই-সিগারেটসহ সকল ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টকে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো আসক্তিসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য ক্ষতি তৈরি করে। ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি প্রোডাক্ট তামাকপণ্য ব্যবহারের ‘মধঃবধিু’ হিসেবেও কাজ করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট ২০১৬ এ ই-সিগারেটসহ নিকোটিনযুক্ত সকল পণ্যকে ‘অনিরাপদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং-সৃষ্ট শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে মহামারির আকার ধারণ করলে এই ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসগুলোর সত্যিকারের চেহারা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। 

শিশু-কিশোর এবং তরুণরাই মূল টার্গেট: মূলত তরুণ এবং শিশুদের টার্গেট করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস উৎপাদন ও বাজারজাত করছে তামাক কোম্পানিগুলো। উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাকপণ্যের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

তারুণ্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন তামাক কোম্পানির মূল টার্গেট:  বাংলাদেশেও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসের ব্যবহার তরুণ এবং যুব সমাজের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। রাস্তাঘাট, ক্যাম্পাস, তরুণদের আড্ডাস্থল, বিভিন্ন মার্কেট এবং রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা ভ্যাপিং ক্লাবে এসব পণ্যের ব্যবহার ব্যাপক হারে চোখে পড়ছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বিক্রয় কেন্দ্র। অনলাইন এবং ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ই-সিগারেট সামগ্রী নিয়ে আলোচনা, বিক্রয় ও হাতবদল হচ্ছে। তবে এসব পণ্য ব্যবহারের মাত্রা কতোটা বিস্তার লাভ করেছে সে বিষয়ে সর্বশেষ কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত নেই। 

তামাক কোম্পানিগুলোও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে যেকোনো উপায়ে তামাকপণ্য ও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট-এ আসক্ত করে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং মুনাফা বৃদ্ধি করতে চায়। এ জন্য তারা ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট ইত্যাদিকে সিগারেটের ‘নিরাপদ বিকল্প’ হিসেবে ভোক্তা এবং নীতিনির্ধারকদের সামনে উপস্থাপন করে থাকে। 

তামাক বিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)-এর নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের এ ব্যাপারে বলেন, ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাংলাদেশের তরুণ ও যুব সমাজকে রক্ষা করতে ই-সিগারেটসহ সকল ভ্যাপিং এবং হিটেড তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করতে হবে। ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ই-সিগারেট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, নেপাল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ৩৪টির অধিক দেশ এসব পণ্য নিষিদ্ধ করেছে। ই-সিগারেট এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট (এইচটিপি) বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হলে তরুণ এবং কিশোর বয়সীদের ধূমপানে আসক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে, যা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে সহায়তা করবে। 

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব (মহাপরিচালক ভারপ্রাপ্ত, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল) মো. আখতারউজ-জামান বলেন, আইনটির খসড়া মন্ত্রণালয়ে আছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়