নিজস্ব প্রতিবেদক : বাসযোগ্য নগর গঠনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। এ সময় তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দেন। সোমবার ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এবং বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর যৌথ আয়োজনে ‘ন্যায্য নগর গঠনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা’ শীর্ষক একটি পলিসি ডায়ালগে এসব কথা বলেন তিনি। স্টেট ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকীর সভাপতিত্বে পলিসি ডায়ালগে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক বলেন, ঢাকা শহরের বেশ কিছু পরিকল্পিত এলাকা আছে, যেখানে বিল্ডিংগুলোর উচ্চতা কাছাকাছি, ফলে সেই বিল্ডিংগুলোর সোলার ক্লিয়ারেন্স অনেক বেশি। সেই এলাকাগুলোতে পরিকল্পিতভাবে সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে নিজস্ব বিদ্যুতের চাহিদা মিটিয়ে জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ করা সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকার আশপাশের উদ্ধারকৃত নদীর পাড়কে কাজে লাগিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন সম্ভব। এতে জাস্ট ট্রানজিশন এবং ন্যায্য নগরের যে চিন্তা-ভাবনা আমরা ধারন করছি তা অর্জন করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে গবেষণা প্রয়োজন। তিনি জানান, রুফটপ সোলার প্যানেল ব্যবহারকারীদের হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপর ৫% কর রেয়াত দেয়ার কথা ভাবছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। বায়ুদূষণ মোকাবেলায় প্রযুক্তির ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি। শুধুমাত্র সরকার বা সিটি কর্পোরেশন নয়, নাগরিকদের সাথে নিয়ে ন্যায্য নগর প্রতিষ্ঠার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
পলিসি ডায়ালগের মূল প্রবন্ধে ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, আমাদের প্রাণের নগরী ঢাকা জীবনের মান সূচকে শেষ দিক থেকে ৪র্থ, বিশ্বের সবচেয়ে ধীর গতির শহর, বায়ু দূষণের তালিকায় শীর্ষে, দূষিত শহরের তালিকায় ৬ষ্ঠ, বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকার ১ম সারিতে, বিশ্বে যানজটের সূচকে ৫ নম্বরে, পৃথিবীর ৪র্থ ঘনবসতিপূর্ণ শহর, শব্দ দূষণেও শীর্ষে ঢাকা এবং স্বাস্থ্যসেবার সূচকে শেষের দিকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্স (ইপিআই) এর ২০২৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদনে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৫তম। এক কথায় ঢাকা শহর এখন ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের সম্মুখীন। শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শহরের পরিবেশের প্রতিটি দিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এই দূষণগুলো থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় হতে পারে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান বলেন, ঢাকা শহর একটি অপরিকল্পিত শহর। এ অপরিকল্পিত নগরে এত সহজেই ন্যায্যতা পাওয়া সম্ভব নয়। সর্বপ্রথম শহরকে সঠিক পরিকল্পনারায় এনে এবং সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে পারব।
বিআইপি এর প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, পরিবহন ও শিল্পখাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে আমরা একটি সুস্থ ও সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। এটি শুধুমাত্র বর্তমান প্রজন্মের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক এবং চেয়ারম্যান ড. এম. শহীদুল ইসলাম বলেন, দূষণমুক্ত ন্যায্য নগর গঠনে শতাধিক উপায় রয়েছে। আমাদের চাহিদাটাকে কমিয়ে আনতে হবে। আমরা যদি গণপরিবহন ব্যবহার করি তাহলে দূষণ কমবে পাশাপাশি দূষণকারী যারা আছেন তাদেরকে সমাধানের দায়িত্ব নিতে হবে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর উপদেষ্টা বোর্ডের আহ্বায়ক মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ঢাকার দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রুফটপ ম্যানেজমেন্ট হতে পারে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের অন্যতম উৎস। শুধু দূষণ নিয়ে কথা বলে বা সরকারের উপর এর নিয়ন্ত্রণের দায়ভার চাপিয়ে দিলে চলবে না। আমরা যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করি তাহলে কোন ধরনের আইনি পদক্ষেপ ছাড়াই আমরা একটি সুষ্ঠু ও দূষণমুক্ত শহর গড়ে তুলতে পারবো।
বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির প্রাক্তন ডিন ড. ইজাজ হোসেন বলেন, দূষণ রোধ করতে সর্বপ্রথম দূষণকারীকে চিহ্নিত করে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। যানজট নিরসনে বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রচলন করলে সে ক্ষেত্রে সৌরশক্তির মাধ্যমে চার্জিং এর ব্যবস্থা করলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্রের (সিথ্রিইআর) সমন্বয়ক (অপারেশনস) মিসেস রৌফা খানম বলেন, যদিও বাংলাদেশ শহরাঞ্চলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে অনেক আইন ও বিধিনিষেধ প্রণয়ন করেছে, কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী কারিগরি ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, একটি কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা এবং টেকসই গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট, (ডব্লিউবিবিটি) এর পরিচালক গাউস পিয়ারী বলেন, জীবাশ্ম জ্বলানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি, মানসম্মত গণপরিবহন, শিল্পখাত, কৃষিখাত, অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে এর ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশেদুজ্জামান মজুমদার বলেন, এখন পর্যন্ত অনেকগুলো জ্বালানি নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু কোনটাই নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন টার্গেট পূরণ করতে পারেনি। আমাদের সবগুলো জ্বালানি নীতির মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫ এর আলোকে জ্বালানি মহাপরিকল্পনা ২০২৩ সংশোধন করতে হবে।
ব্যারিস্টার নেওয়াজ মোরশেদ বলেন, দুষণমুক্ত ও ন্যায্য নগরী গড়ার ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। ব্যক্তিগত বাহনের সংখ্যা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি চালিত আধুনিক গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।
ইয়ুথনেট গ্লোবালের সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, দূষণমুক্ত ও ন্যায্য নগর গড়তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকল্প নেই। এখন সময় হয়েছে ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি মাস্টার প্ল্যান ও ঢাকা ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান পর্যালোচনা করার, যাতে সবার জন্য ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করা যায়।
বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর রিসার্চ লিড ইঞ্জি. মারজিয়াত রহমান বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারই পারে দূষণমুক্ত ন্যায্য নগর গড়তে। এক্ষেত্রে সকলের সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি ন্যায্য নগর গড়া সম্ভব।
ব্রাইটার্সের চেয়ার ফারিহা সুলতানা অমি বলেন, যুবাদের অংশগ্রহণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে সবুজ বিপ্লব আনতে হলে পলিসি ও ইমপ্লিমেন্টেশনে যুবাদের এক্টিভ অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রশিক্ষণ ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে যুবারাই হবে এই সবুজ বিপ্লবের ড্রাইভিং ফোর্স!
ইকো-নেটওয়ার্ক গ্লোবালের নির্বাহী পরিচালক শামীম আহমেদ মৃধা বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরের ক্ষেত্রে তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, যখন তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের চর্চা করবে তখন তাদের প্রভাব আরও শক্তিশালী হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে তারা ব্যাপক পরিবর্তনকে অনুপ্রাণিত করতে পারবে এবং দেশকে আরও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করতে পারবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী বলেন, আমাদেরকে এনার্জির ব্যবহার কমিয়ে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।