মহসিন কবির: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করার অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। ছয় বছর আগের সেই নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা নির্বাচন কমিশনার, রিটানিং কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম তদন্ত করা হবে। দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার বলেছেন, জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ও রক্ষা করা এখনও সুদূরপরাহত। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে ব্যলট পেপারের ঘটনাটি বিবিসি প্রকাশ করার পর নির্বাচন কমিশন দিনের ভোট রাতে করে বলে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হই। এটি কোনভাবেই কাম্য ছিল না। এখন সন্ত্রাস ও সংঘর্ষ যেন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে। ভোটযুদ্ধে এখন যুদ্ধ আছে ভোট নেই।
ঢাকার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে গতকাল দুদক মহাপরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক অসদাচরণ, জাল-জালিয়াতি, দিনের ভোট রাতে করা এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে টিম গঠন করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হবে। রাতের ভোট অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
দিনের ভোট রাতে করা, ব্যালট জালিয়াতি, কিছু কিছু কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি কাউন্ট দেখানো, ব্যাপক আর্থিক লেনদেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রার্থীকে জেতানো ইত্যাদি নানা অভিযোগ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে এবং দুদকেও কিছু অভিযোগ জমা হয়েছে।
জানা গেছে, অভিযোগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি মহানগর, জেলা, বিভাগীয়, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মীকে নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা যেমন পুলিশের তৎকালীন আইজিপি জাভেদ পাটোয়ারী, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, র?্যাবের প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ, পুলিশের সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকি, তৎকালীন জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, জেলা প্রশাসক, জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা, বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ সুপার, থানার অফিসার ইনচার্জ, জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং অফিসারসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তার যোগসাজশের কথা উল্লেখ রয়েছে। অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদকের একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে বিভিন্ন ভিডিও, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ, নির্বাচনের ফলাফলপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে অনুসন্ধান টিম প্রতিবেদন দাখিল করবে।
এদিকে গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নানা অপকৌশলে ক্ষমতাসীনদের গদি টিকিয়ে রাখতে যারা ছিলেন কুশীলব, ইতোমধ্যেই তাদের একটি তালিকা চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যেই বিভাগীয় কমিশনারদের একটি তালিকা করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ডিসিদের তালিকাও হয়েছে। এখন চলছে এসব নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করা ইউএনওদের তালিকা চূড়ান্তকরণের কাজ। এ ছাড়া চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে ওই তিন নির্বাচনে পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়েও এবং সেই মোতাবেক তালিকাও হচ্ছে। যেসব কর্মকর্তা পাতানো নির্বাচনে দলীয় কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে যেসব অফিসারের প্রত্যক্ষ দায় নেই কিংবা পরিস্থিতির শিকার, তারা ছাড় পাবেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ২০৮ জন ডিসির নাম রয়েছে তালিকায়। ৬৪ জেলায় তিন নির্বাচনে ১৯২ জন ডিসি ছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। কিন্তু তফশিল ঘোষণার পর তিন নির্বাচনে ১৬ জেলা প্রশাসকের বদলির কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তার সংখ্যা বেড়ে হয় ২০৮। এতে তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ২৩ বিভাগীয় কমিশনারের নামও রয়েছে (২০১৪ সালে ময়মনসিংহ বিভাগে উন্নীত হয়নি।)
বিতর্কিত তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিদের অনেকে পরবর্তীকালে সচিব হয়েছেন। কেউবা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব পদেও পুরস্কৃত হন। ইতোমধ্যে অনেকে অবসরে গেছেন। অনেকে ওএসডি হয়েছেন। কেউবা মারা গেছেন। মাঠ প্রশাসনে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, ইউএনওদের তৎপরতা ছিল। পুলিশের ডিআইজি, এসপি, ওসিরও এসব কর্মকা-ে প্রত্যক্ষ মদদ ছিল। অবশ্য প্রহসনের এসব নির্বাচনে তাদের সবাই যে এ তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন, এমনটি না-ও হতে পারে। তবে কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এ ধরনের দায়িত্ব পালনকালে নির্দেশ অমান্য করার সুযোগ ছিল কম।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার দেখানো হয় ৮০ দশমিক ০২ শতাংশ। ‘রাতের ভোট’ হিসেবে চিহ্নিত ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সেই নির্বাচনে সর্বাধিক কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে ভোট বাক্স ভরা হয়। রাতের বেলায় বাক্স ভরার অভিযোগে নির্বাচনের দিন সকাল বেলায় শতাধিক আসনে ভোট বর্জন করেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা। অস্বাভাবিক ফলাফলের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭৯ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পায়। আসনের হিসাবে আওয়ামী লীগ ২৫৮টি, জাতীয় পার্টি ২২টি আসন পায়। অন্যদিকে বিএনপি পায় মাত্র ৬টি আসন। চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায়, ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ১ হাজার ২০৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। আওয়ামী লীগ শতাধিক প্রার্থী ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন বলে দেখানো হয়। অভিযোগ আসে- রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও প্রিসাইডিং অফিসারদের যোগসাজশে নির্বাচনের আগে ব্যালটে সিল দিয়ে ভোটবাক্স ভর্তি করে পুলিশ।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লার রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন প্রশাসনের ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা আবুল ফজল মীর। অস্বাভাবিক ফলাফল ছিল কুমিল্লা জেলার ১১টি আসনেই। আবুল ফজল মীর বর্তমানে যুগ্ম সচিব হিসেবে কর্মরত।
অতীতে দেখা গেছে, প্রতিবারই ফেনী-১ আসনে জয়ী হয় বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এই আসনে একাদশ নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ২৪ হাজার ৯৭২ ভোট পায়। নৌকা প্রতীকে জাসদের শিরিন আখতার ২ লাখ ৪ হাজার ২৫৬ ভোট পেয়েছেন বলে দেখানো হয়। এমন অস্বাভাবিক ফলাফল ছিল নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের সব আসনেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ফেনীর তিনটি আসনেই জয়ী দেখানো হয় আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থীদের। ২০১৮ সালের নির্বাচনকালে ফেনীর ডিসি ছিলেন ২০ ব্যাচের ওয়াহিদুজ্জামান। নোয়াখালী জেলা প্রশাসক ছিলেন তন্ময় দাস। ১৮ ব্যাচের এই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে বিজয়ী করতে বিএনপির প্রার্থী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে একদিনের জন্যও প্রচারণা চালাতে দেননি। রিটার্নিং অফিসার তন্ময়ের কাছে অসংখ্যবার অভিযোগ করেও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। বর্তমানে তন্ময় দাস অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।
ভোট কারচুপির মাধ্যমে পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করার অভিযোগ আসে প্রতিটি নির্বাচনের পরপর। পরাজিত প্রার্থী ও দল এমন অভিযোগ করলেও নির্বাচন কমিশন এবং ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই তা অস্বীকার করা হয়।
আপনার মতামত লিখুন :