শিরোনাম

প্রকাশিত : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০১:০০ রাত
আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১২:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়ে এখন ছাত্ররাই কেন সংগঠন তৈরি করছে?

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। বাংলাদেশে এখন নতুন দলের আত্মপ্রকাশ নিয়ে সরগরম রাজনীতি। শীর্ষ নেতৃত্বে কারা থাকবেন কিংবা সেটি নিয়ে দ্বন্দ্ব, দলের নাম কী হবে- এরকম নানা বিষয় নিয়ে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এই আগ্রহের মূল কারণ দলটির উদ্যোক্তা জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছাত্ররা। এর পেছনে কাজ করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি।

কিন্তু এই আলোচনার মধ্যেই এখন জানা যাচ্ছে, ছাত্ররা একটি নতুন ছাত্র সংগঠনও গঠন করতে যাচ্ছেন।

গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক নতুন ছাত্র সংগঠনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান।

তারা বলেন, নতুন ছাত্র সংগঠন তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। এমনকি রাজনৈতিক দল গঠনের আগেই ছাত্র সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে এমন কথাও জানানো হয়।

তবে সম্ভাব্য ছাত্র সংগঠনের আত্মপ্রকাশের ঘোষণায় নতুন প্রশ্নও উঠেছে। এই ছাত্র সংগঠনটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বাধীন সম্ভাব্য রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন হবে কি না এমন সন্দেহ দেখা যাচ্ছে কারো কারো মধ্যে।

ছাত্রদের পক্ষ থেকে সেই সন্দেহ নাকচ করা হলেও প্রশ্ন উঠছে যে, একসময় যারা নিজেরাই লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছিলেন, এখন তারাই কেন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন তৈরি করছেন।

আবার রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠন তৈরির পর বৈষম্যবিরোধী এবং নাগরিক কমিটির প্ল্যাটফরমগুলোর কী হবে? তারা কি বিলুপ্ত হবে নাকি আগের মতোই থেকে যাবে?

নতুন ছাত্রসংগঠন কেন? কবে আসবে?
গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগ নিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র আবু বাকের মজুমদার। সাথে ছিলেন আব্দুল কাদের, রিফাত রশীদ, তাহমিদ আল মুদাচ্ছিরসহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।

সংবাদ সম্মেলনে আবু বাকের মুজমদার জানান, ছাত্র সংগঠন তৈরির কাজ তারা গুছিয়ে এনেছেন। খুব শিগগিরই নাম চূড়ান্ত করে দলের আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেয়া হবে।

‘বাংলাদেশ ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে স্বীকার করে সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, আটষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তর এবং চব্বিশ সকল গণআন্দোলন এবং ছাত্রজনতার সংগ্রামী চেতনাকে ভিত্তি করে আমরা ছাত্র রাজনীতিকে সক্রিয় করবো,’ বলেন আবু বাকের মজুমদার।

কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন নিজেই শিক্ষার্থীদের একটি প্ল্যাটফরম তখন আলাদা করে রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ কী কারণে এমন একটা প্রশ্ন আছে।

এর জবাবে আবু বাকের মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, যারা ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল তাদের অনেকেই সাধারণ ছাত্র। তাদের মধ্যে যারা রাজনীতিতে আগ্রহী তাদের জন্যই রাজনৈতিক সংগঠন করা হচ্ছে। যেন তারা এই সংগঠনের মাধ্যমেই 'ছাত্রদের সমস্যা সমাধানে গঠনমূলক ভূমিকা' রাখতে পারেন।

‘এখানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা একত্রিত হয়েই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নিজেদের টিকে থাকা কিংবা শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে একটা ছাত্র সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করছি,’ বলছিলেন মজুমদার।

‘ছাত্রদের মধ্যে যারা ছাত্রদল কিংবা শিবির করে তারা আন্দোলনের পরে নিজস্ব সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় আছে। কিন্তু এর বাইরে আরও একটা বড় অংশ রয়ে গেছে যারা জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তারা এখন কমিউনিটি আকারে কাজ করছে ক্যাম্পাসগুলোতে। কিন্তু তাদের সাংগনিক রূপ থাকলে তারা আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে,’ যোগ করেন তিনি।

সম্ভাব্য এই ছাত্রসংগঠনের পেছনে যারা কাজ করছেন, তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে শুরুতে কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি গঠন হবে। এরপর সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিটি গঠন করা হবে।

তবে সংগঠনের নাম চূড়ান্ত হয়নি এমন তথ্য জানিয়ে এর গঠনের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, নাগরিক কমিটির নেতারা যে রাজনৈতিক দল তৈরি করছেন, সেই 'দলের আত্মপ্রকাশের আগেই ছাত্র সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটবে'।

নিজেরাই 'লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠন' তৈরি করছে ছাত্ররা?
বাংলাদেশে জাতীয় রাজনীতিতে যেসব দল আছে সেসব দলের পক্ষ থেকে সাধারণত একটি ছাত্র সংগঠনও গঠন করা হয়। সেই হিসেবে ছাত্রদল পরিচিত বিএনপির ছাত্র সংগঠন হিসেবে, ছাত্রশিবির জামায়াতের এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগকে বলা হয় আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন।

ফলে নাগরিক কমিটির নেতারা যখন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করছেন এবং একইসময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকা নেতারা একটা ছাত্র সংগঠন তৈরি করছেন তখন এ দুটোর মধ্যে সম্পর্ক আছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনটি জাতীয় রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন হিসেবে কাজ করবে কি না সে প্রশ্ন উঠছে।

জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক রিফাত রশীদ অবশ্য সে সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। বলেন, তাদের সংগঠন কোনো দলের অংশ হবে না।

‘এটা আসলে আমাদের স্বতন্ত্র উদ্যোগ। এখানে একটা রাজনৈতিক দল হচ্ছে আবার একই সময়ে ছাত্র সংগঠন হচ্ছে এটা আসলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ দুটোর একটার সাথে অন্যটার আসলে সম্পর্ক নেই।’

জুলাইয়ের আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলেছিল। পরবর্তীকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে নয় দফা দাবি ঘোষণা করে সেখানেও বলা হয় 'লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি' নিষিদ্ধের কথা।

রিফাত রশীদ দাবি করেন, যেহেতু তারা কোনো দলের অঙ্গসংগঠন হবেন না, তাই তারা লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতিও করবেন না।

‘আমরা কোনো প্রকার লেজুড়বৃত্তি করবো না, সমর্থনও করবো না। বাংলাদেশ প্রশ্নে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এবং ছাত্রদের স্বার্থে যে রাজনৈতিক দলই কাজ করবে আমরা তাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করবো। আর যদি বিরোধিতা করে আমরাও তার সমালোচনা এবং বিরোধিতা করবো। আমরা লেজুড়বৃত্তিক হবো না। কাজেই এর প্রমাণ দেখাবো আমরা,’ বলেন রশীদ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিক কমিটির কী হবে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন, বলা হচ্ছে, সেটি হবে মধ্যপন্থী দল।

অন্যদিকে নতুন ছাত্র সংগঠনের নেতারাও 'জুলাইয়ের স্পিরিট রক্ষা' এবং তাদের ভাষায় সব মত-পথের মধ্যপন্থী দল হয়ে ওঠার কথা বলছেন।

ফলে দল দুটিকে আলাদা বলা হলেও বাস্তবে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিল পাওয়া যাচ্ছে।

আবার একই আন্দোলন এবং একই উৎস থেকে তৈরি হওয়ায় তারা কতটা আলাদা থাকবে কিংবা রাজনীতির ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠবে কি না সে আলোচনা তো আছেই। সেই সাথে রাজনৈতিক দল হয়ে যাওয়ার পর জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন- এই দুটি প্ল্যাটফরমের কী হবে সেটাও একটা বড় বিষয়।

জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠন আব্দুল হান্নান মাসউদ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, জাতীয় রাজনৈতিক দল হোক বা ছাত্রদের দল হোক, বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফরম আগের মতোই থেকে যাবে অর্থাৎ এই প্ল্যাটফরমকে বিলুপ্ত করা হবে না।

‘এটা গণআন্দোলনের প্ল্যাটফরম হিসেবেই থাকবে। এটার প্রতি সারাদেশের সকল দল-মত নির্বিশেষে যে সফট কর্নার আছে সেটাকে একটা পবিত্র জায়গা হিসেবে রাখা হবে। তবে যারা এখানে থাকবে বা নেতৃত্ব দেবে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হতে পারবে না,’ বলেন আব্দুল হান্নান মাসউদ।

অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিবও বলেছেন একই কথা।

‘যারা পলিটিক্যাল একটিভিস্ট এবং বিপ্লবী চিন্তা করেন তারা কিন্তু রাজনৈতিক দল আকারে আলাদা হয়ে যাবেন। আর যারা সিভিল সোসাইটি কেন্দ্রিক কাজ করবেন, তারা জাতীয় নাগরিক কমিটিতেই থেকে যাবেন। জাতীয় স্বার্থ বা অন্যান্য ইস্যুতে নিরপেক্ষভাবে তারা ভূমিকা রাখবে, প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করবে।’

বলা হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির ভূমিকা হবে নিরপেক্ষ এবং অরাজনৈতিক।

কিন্তু দুটি সংগঠনই যখন সারাদেশে কমিটি দিয়ে তাদের সাংগঠনিক বিস্তৃতি করছে, তখন তাদের ভূমিকা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।

বিশেষ করে কুয়েটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্রদলের সংঘর্ষের ঘটনার পর ইতোমধ্যেই ছাত্রদল এর জন্য দায়ী করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিজেই একটি রাজনৈতিক সংগঠন হয়ে উঠছে কি না।

সবমিলিয়ে একদিকে রাজনৈতিক সংগঠন বানানো, অন্যদিকে ছাত্রদের ভাষায় বৈষম্যবিরোধী কিংবা নাগরিক কমিটিকে অরাজনৈতিক প্লাটফরম হিসেবে রেখে দেয়া- এই সবকিছুর পেছনেই যে আবার একধরনের রাজনীতি আছে সেটাও এখন স্পষ্ট।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়