বিশ্ব অর্থনীতি চলতি বছরে মন্দার কবলে পড়ার ঝুঁকি প্রবলভাবে বেড়ে গেছে। ৫০টি দেশের অর্থনীতিবিদ এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।
বিশ্ব অর্থনীতি চলতি বছরে মন্দার কবলে পড়ার ঝুঁকি প্রবলভাবে বেড়ে গেছে। ৫০টি দেশের অর্থনীতিবিদ এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। রয়টার্সের সাম্প্রতিক এক জরিপে অধিকাংশ অর্থনীতি বিশ্লেষক মত প্রকাশ করেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত শুল্ক বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক আস্থা নষ্ট করেছে, বিনিয়োগ পরিবেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।
ফলে চলতি বছর মন্দার ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। মাত্র তিন মাস আগেও এ অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশ বিশ্ব অর্থনীতিতে ধারাবাহিক ও শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্পের বিশ্ব বাণিজ্য ‘নতুনভাবে গঠনের’ উদ্যোগ, বিশেষ করে সব আমদানির ওপর শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত আর্থিক বাজারে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। ফলে ট্রিলিয়ন ডলারের শেয়ারবাজার মূল্য হ্রাস পেয়েছে। ডলারসহ যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদগুলোয় বিনিয়োগকারীদের আস্থা নড়বড়ে হয়েছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩০০ জনেরও বেশি অর্থনীতিবিদের মধ্যে কেউই শুল্কনীতির ইতিবাচক প্রভাব দেখেননি। ৯২ শতাংশ অর্থনীতিবিদ বলেছেন, এটি ব্যবসায়িক মনোবলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মাত্র ৮ শতাংশ নিরপেক্ষ মত দিয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই ভারত ও অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির প্রতিনিধি।
চলতি বছরে বৈশ্বিক মন্দার সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ১৬৭ জন বিশ্লেষকের মধ্যে ১০১ জন ‘উচ্চ’ বা ‘খুব উচ্চ’ ঝুঁকির কথা বলেছেন। ৬৬ জন বলেছেন ঝুঁকি ‘কম’, যার মধ্যে চারজন বলেছেন ‘অত্যন্ত কম’।
জরিপে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের জন্য বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে আনা হয়েছে। গড় প্রবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে কমে ২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) একটু বেশি, ২ দশমিক ৮ শতাংশ পূর্বাভাস দিয়েছে। জরিপে অংশ নেয়া ৪৮টি অর্থনীতির মধ্যে ২৮টির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে আনা হয়েছে।
চীন ও রাশিয়ার অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো পারফর্ম করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যেখানে চীনের প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং রাশিয়ার ১ দশমিক ৭ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। অন্যদিকে মেক্সিকো ও কানাডার প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে দশমিক ২ ও ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা গত কয়েক মাসে সবচেয়ে বড় অবনতি।
২০২৬ সালের জন্য প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসও আশাব্যঞ্জক নয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দার সূচনা হয়েছে, তা সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৬৭ অর্থনীতিবিদের মধ্যে ১০১ জন (৬০%) বলেছেন, চলতি বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি বেশি বা খুব বেশি। মাত্র ৬৬ জন এটিকে কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেছেন।
স্টেট স্ট্রিটের ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার প্রধান ম্যাক্রো স্ট্র্যাটেজিস্ট টিমোথি গ্রাফ বলেন, ‘এটি এমন একটি পরিবেশ যেখানে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী হওয়া অত্যন্ত কঠিন। যদি আজকেই সব শুল্ক তুলে নেয়া হয়, তবু এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা চুক্তিতে বিশ্বাসযোগ্যতার যে ক্ষতি হয়েছে তা থেকেই বিপুল ক্ষতি রয়ে যাবে।’
বিশ্বব্যাপী কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির ঢেউ সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো দ্রুত সুদের হার বাড়িয়েছিল। কিন্তু এখন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ শুল্কনীতি নতুন করে মুদ্রাস্ফীতির চাপ তৈরি করছে, যা সেই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।
গ্রাফ আরো বলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদারকে বাদ দেয়া মানে দামের ওপর বিরাট অস্থিরতা তৈরি করা, যা প্রকৃত আয় ও মোট চাহিদার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
তিনি সতর্ক করেন, যেখানে দীর্ঘ সময়ের জন্য কম প্রবৃদ্ধি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি একসঙ্গে ঘটে—সেই স্ট্যাগফ্লেশন পরিস্থিতির আশঙ্কা এতদিন খুব কম ছিল। কিন্তু এখন তা অনেক বেশি বাস্তবসম্মত হয়ে উঠেছে।
স্ট্যাগফ্লেশন হলো এমন এক পরিস্থিতি যেখানে অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়ে, কিন্তু দাম বাড়তে থাকে এবং কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়।
রয়টার্সের জরিপে আরো দেখা গেছে, ২৯টি প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে ১৯টি ব্যাংক চলতি বছরে তাদের নির্ধারিত মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আগামী বছরের জন্য এ সংখ্যা কিছুটা কমে ১৫টিতে নামবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের এ বাণিজ্যনীতির অভিঘাত কেবল যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতেই নয়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, যা সামনের বছরগুলোয় বিশ্ববাজারে চাপ অব্যাহত রাখবে। এখন দেখার বিষয় বিশ্বনেতারা কীভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থিতিশীল বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করতে পারেন। অনুবাদ: বণিক বার্তা।