মনজুর এ আজিজ : উডম্যাকেঞ্জির প্রস্তাবিত খসড়া নিয়ে যৌথসভায় কিছু বিষয়ে পর্যবেক্ষণ শেষে অনসোর পিএসসির (উৎপাদন ও বন্টন চুক্তি) খসড়া আগামী সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত খসড়া পেট্রোবাংলায় হস্তগত হয়েছে এবং সেগুলো আপডেট করে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে নিশ্চিত করেছেন পরিচালক (পিএসসি) প্রকৌশলী মো. শোয়েব।
পার্বত্য এলাকায় ও সমতলের জন্য ভিন্ন দরের সুপারিশ করা হয়েছে। পার্বত্য এলাকার ব্লকের জন্য গ্যাসের দাম ৮ ডলারের (১ হাজার ঘনফুট) মতো হতে পারে বলে পেট্রোবাংলা সুত্র ইঙ্গিত দিয়েছে। প্রস্তাবিত দর আমদানিকৃত এলএনজির তুলনায় ২ ডলারের মতো কম, আর বহুজাতিক কোম্পানির (শেভরন ও টাল্লো) সঙ্গে ইতোপুর্বে সম্পাদিত চুক্তির তুলনায় প্রায় ৫ ডলারের মতো বেশি।
শেভরন বাংলাদেশকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম দেওয়া হয় ২.৭৬ ডলার, আর টাল্লোর সঙ্গে চুক্তি রয়েছে ২.৩১ ডলার। বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ৩টি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনে থাকে পেট্রোবাংলা। সিলেট গ্যাস ফিল্ড কেম্পানির ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানিকে প্রতি হাজার ঘনফুটের দাম দেওয়া হয় ২৮ টাকার মতো, অন্যদিকে বাপেক্সকে দেওয়া হয় ১১২ টাকার মতো।
এদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে কাতার থেকে আমদানি করা এলএনজির দাম ১০.৬৬ ডলার ও ওমান থেকে আনা এলএনজির দাম পড়েছে ১০.০৯ ডলার। অন্যদিকে গভীর সমুদ্রে পিএসসিতে এই গ্যাসের দাম রাখা হয়েছে ক্রডের ১০ শতাংশের সমান। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ক্রড অয়েলের ব্যারেল প্রতি দাম ১৪০ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। যা বর্তমান ৭০ ডলারের কাছাকাছি রয়েছে।
খসড়ায় ৩ ধরণের দরের ফর্মূলা উপস্থাপন করা হয়। ব্রেন্ট ক্রড অয়েলের দামের সঙ্গে যোগসুত্র রাখার প্রস্তাব করা হয়। অর্থাৎ ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়ে গেলে গ্যাসের দাম বাড়বে, আর কমে গেলে কমে আসবে। কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান সাড়ে ৯ শতাংশ করার প্রস্তাবনা দিলেও যৌথসভায় ক্যাপিং করে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এমন একটি সূত্র থাকতে পারে যাতে ক্রডের দাম অনেক বেড়ে গেলেও ৮ ডলারের বেশি হবে না বলে আভাস পাওয়া গেছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, এখানে বাপেক্সের শেয়ার ১০ শতাংশ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাপেক্স আগে কোন বিনিয়োগ করবে না। গ্যাস পাওয়া গেলে তখন তারা ১০ শতাংশ মুলধন বিনিয়োগ করবে। অর্থাৎ বাপেক্সের কোন ঝুঁকি থাকছে না। গ্যাস পেলে মুলধন বিনিয়োগ করে মুনাফার ভাগ পাবে।
মডেল পিএসসি-২০১৯ থেকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ অনেক ছাড় দিয়ে মডেল পিএসসি-২০২৩ চুড়ান্ত করা হয়েছে। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রডের ১০ শতাংশ দরের সমান। আগের পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫.৬ ডলার ও ৭.২৫ ডলার স্থির দর ছিল।
অফসোর পিএসসির পর অনসোর পিএসসির বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। ওই পিএসসির আদলে অনসোর ব্লক ২২ ও ২২(ক) (পার্বত্য এলাকা) এর দরপত্র চুড়ান্ত করা হচ্ছে। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যাপ্ত তথ্য নেই, তাছাড়া তেল গ্যাস উত্তোলন করা কঠিন, রাস্তা তৈরি করা, গ্যাস পেলে পাইপলাইনের নির্মাণ ব্যায় বহুল। তাই স্থলভাগের অতীতের পিএসসির তুলনায় দাম অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ১৯১৪ সালে প্রথম কূপ খনন (সীতাকুন্ড) করে বার্মা ওয়েল কোম্পানি। এরপর ১৯২২ সালে পাথারিয়ায় কূপ খনন করে। এরপর প্রায় ১২টি কূপ খনন করা হয়েছে, সর্বশেষ কূপ খনন করা হয় হালদা (১৯৯৮ সাল)। এরমধ্যে সেমুতাং ১,২,৩ ও ৪ এ গ্যাস পেলেও বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য নয় বলে জানানো হয়। আর কোন কূপে সামান্য মজুদ আবার হালদা, সেমুতাং-৫ পটিয়াতে গ্যাসের আলামত পাওয়া যায়নি বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
সেমুতান-৪ কূপের রিপোর্টে কেয়ান বলেছে, রিজার্ভ খুবই কম, পাইপলাইনের বিনিয়োগ ব্যয়বহুল, বিনিয়োগ তুলে আনা কষ্টকর হবে। কূপ এলাকায় ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যেতে পারে।
সূত্র মতে, বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ নিয়ে নানা রাজনীতি বিদ্যমান। এক সময় বলা হলো গ্যাসের উপর দেশ ভাসছে, আবার আরেক সময় বলা হলো গ্যাস নেই আমদানি করতে হবে। এই রাজনৈতিক খেলার কারণে অনুসন্ধান কার্যক্রম এখনও তিমিরেই বলা চলে। বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে প্রথম কূপ খনন করা হয় ১৯১১ সালে। ১১৪ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে কমবেশি ৯৯টি।
আন্তর্জাতিকভাবে ১০টি কূপ খনন করে একটিতে গ্যাস পাওয়া গেলে সফল বলা হয়। সেখানে বাংলাদেশের ৯৯টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ২৯ গ্যাস ফিল্ড আবিস্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ সাফল্যের হার তিন অনুপাত এক। বাংলাদেশের সফলতার হার উচ্চ হলেও তেল-গ্যাস অনুসন্ধান এখন তিমিরেই মনে করেন অনেকে।
১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালায় বছরে ৪টি অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা বলা হয়। কিন্তু কোন সরকারেই সেই লক্ষ্যমাত্রার ধারের কাছেও ঘেষতে পারেনি। এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। মজুদ কমে আসায় ১৮৫০ মিলিয়নে নেমে এসেছে দেশীয় উৎপাদন।
এদিকে বাংলাদেশে প্রচুর গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৯টি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তেল-গ্যাস সম্পদের সম্ভাবনা নিরূপণে কাজ করে। কিছু সংস্থা সারাদেশে এবং কিছু সংস্থা বিশেষ এলাকায় অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০০১ সালে ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) ও পেট্রোবাংলা, হাইড্রোকার্বন ইউনিট ও নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডাইরেক্টরেট সমীক্ষা পরিচালনা করে। ইউএসজিএস-পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে সর্বনিম্ন ৮ দশমিক ৪, গড় ৩২ দশমিক ১ ও সর্বোচ্চ ৬৫ দশমিক ৭ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন কিউবিক ঘনফুট) গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে হাইড্রোকার্বন ইউনিট ও নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডাইরেক্টরেট সর্বনিম্ন ১৯, গড় ৪২ ও সর্বোচ্চ ৬৪ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছে।
পেট্রোবাংলার ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ যাবত ২০.৩৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। তখন অবশিষ্ট মজুদ ছিল ৮.৪৬ টিসিএফ। বছরে প্রায় ১ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। সে হিসেবে আরও প্রায় ২ টিএসএফ এর মতো উত্তোলন করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে আরও অবশিষ্ট আছে কমবেশি ৬.৪৬ টিসিএফ গ্যাস।
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, মূলত পার্বত্য এলাকাকে টার্গেট করে অনসোর পিএসসি করা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে করতে। গ্যাসের প্রাইস কতো ধরা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, এখনই নির্ধারিত প্রাইস বলা যাচ্ছে না। তবে অফসোর পিএসসির চেয়ে কম হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ অবশ্যই ক্যাপিং করা যাবে। কারণ এনার্জির আন্তর্জাতিক বাজার খুবই অস্থিতিশীল। কোন কারণে দাম বেশি বেড়ে গেলে যাতে চাপ না পড়ে। আবার অনেক কমে গেলে যাতে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে।