মনজুর এ আজিজ : যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্কারোপ কার্যকর হওয়ায় প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য তৃতীয় দেশে পাঠানোর জন্য দীর্ঘদিনের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। ভারতের এ পদক্ষেপে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করছেন, এ সিদ্ধান্ত দেশের বাণিজ্যিক পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের চাপের মধ্যে থাকা ব্যবসায়ীদের জন্য আরও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে। এতে বাংলাদেশকে ব্যয়বহুল, দীর্ঘ ও অনিশ্চিত পরিবহন ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপীয় বাজারে পণ্য পাঠাতে এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
বাংলাদেশি পণ্য কার্গো বিমান ব্যবহার করে ভারত থেকে তৃতীয় কোন দেশে রপ্তানির ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ করায় গতকাল থেকে রপ্তানির উদ্দেশ্যে আসা গার্মেন্টস পণ্যবাহী ট্রাক ফেরত যাচ্ছে বেনাপোল বন্দর থেকে। এর আগে গত ৮ এপ্রিল ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি মেঘা বানচাল সাক্ষরিক পত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে বিভিন্ন বন্দরে চিঠি ইস্যু করা হয়।
এদিকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে সাময়িক ক্ষতি হলেও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, রপ্তানি বাণিজ্যে তেমন কোন বিরূপ প্রভাব পড়বে না। তবে এ নিষেধাজ্ঞা ভারত দ্রুত প্রত্যাহার করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অটুট রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।
বাণিজ্যিক সংশিষ্টরা জানান, এক সময় বাংলাদেশ আমদানি বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল হলেও বর্তমান পেক্ষাপট ভিন্ন। বাংলাদেশি পণ্যের গুনগত মান ভাল হওয়ায় আমদানি বাণিজ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভারতে পণ্য রপ্তানি। যেসব পণ্য ভারতে রপ্তানি হয় তার মধ্যে কিছু পণ্য ভারতের ভুখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল, ভুটান, বার্মা ও মায়ানমার যায়। আবার কিছু পণ্য ভারতের কার্গো বিমান ব্যবহার হয়ে ইউরোপসহ বাইরের কয়েকটি দেশে যায়।
প্রতিদিন বেনাপোল বন্দর দিয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক পণ্য ভারতে রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ৪০ শতাংস ভারতের ভুখণ্ড ব্যবহার করে চলে যায় নেপার, ভুটান ও মায়ানমারে এবং ৫ শতাংশ কার্গো বিমান সুবিধায় যায় ইউরোপসহ বাইরের দেশে। কিন্তু হঠাৎ করে গত মঙ্গলবার ভারত সরকার কার্গো বিমান ব্যবহার করে তৃতীয় বিশ্বে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানির সুযোগ বন্ধ করে দেয়। এতে ভারতে ঢুকতে না পেরে এ ধরনের পণ্য চালান বেনাপোল বন্দর থেকে ফিরে যাচ্ছে। এতে ভারতের কার্গোবিমান ব্যাবহার করে দ্রুত ও স্বল্প খরচে বাণিজ্যের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে গতকাল বেনাপোল বন্দর থেকে রপ্তানিকারক ডিএসভি এয়ার এন্ড সি লি. প্রতিষ্টানের গার্মেন্টস সামগ্রীর ৪টি ট্রাক ফেরত যায়।
পণ্যবাহী ট্রাক চালক আরিফ হোসেন জানান, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে কার্গো বিমান সুবিধার পণ্যবাহী ট্রাক ভারতে ঢুকতে পারছেনা। কয়েকটি ট্রাক বন্দরে আসার পর ফিরে গেছে। এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হলে ভাল হয়।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এ্যাসোসিয়েশন দপ্তর সম্পাদক মোস্তাফিজ্জোহা সেলিম বলেন, ভারতের ট্রানজিট সুবিধা বাতিলে রপ্তানি বাণিজ্যে তেমন কোন বিরুপ প্রভাব পড়বে না। কারণ ভারত হয়ে এ ধরনের পণ্য ইউরোপসহ বাইরের দেশে যাওয়ার সংখ্যা খুব কম।
যদি ভারতের ভুখণ্ড ব্যবহার করে নেপার, ভুটান,বার্মা বা মায়ানমারে যেতে নিষেধাজ্ঞা দিত তবে ক্ষতি হতো। এর পরও আমরা আশা করছি ভারত নিণেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বাণিজ্য সম্পর্ক্য পূর্বের মত অটুট রাখতে সহযোগিতা করবে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার জানান, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে কার্গো বিমান সুবিধা নিয়ে বাইরের দেশের উদ্দেশ্য আসা পণ্যবাহী ট্রাক ভারতে ঢুকতে পারছেনা। তবে ভারতের ভুখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল, ভুটানে রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন জানিয়েছেন, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে বাংলাদেশের সমস্যা হবে না। ভারতের হঠাৎ করে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করায় বাংলাদেশের তেমন সমস্যা হবে না। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আমাদের সংকট কাটাতে চেষ্টা করা হবে, একইসঙ্গে বাণিজ্যিক সক্ষমতাও বাড়ানো হবে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। সেখানে ক্রেতারাও উপস্থিত ছিলেন। আমরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংকট কাটাতে চেষ্টা করব। নিজস্ব সক্ষমতায় প্রতিযোগিতায় যেন কোনো ঘাটতি না হয় সেটা নিয়ে কাজ করছি।
তিনি বলেন, সমস্যা মসাধানে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিছু অবকাঠামোগত বিষয়, কিছু খরচ বৃদ্ধি, এসব নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি, সমস্যা কাটিয়ে উঠব।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাল্টা ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট বাতিল করা যায় কিনা, এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, সেটা আমার বিষয় না। আমার বিষয় হচ্ছে সক্ষমতা বৃদ্ধি।
ভারতকে কোনো চিঠি দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, এই মুহূর্তে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছি না।
উল্লেখ্য, ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় দেশে যাওয়ার জন্য ২০২০ সালের ২৯ জুন একটি আদেশ জারি করেছিল ভারত। ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) মঙ্গলবার সেই আদেশ বাতিল করে।