বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। ভারতের শেয়ার বাজারে সোমবার ধসের প্রভাব থেকে রেহাই পায়নি প্রায় কোনও সংস্থাই। এই তালিকায় রয়েছে আদানি, আম্বানি থেকে শুরু করে টাটা গোষ্ঠীর অন্তর্গত কোম্পানির শেয়ারও।
শেয়ার বাজারে অস্থিরতার কারণে 'ম্যাসিভ সেল অফ' বা সর্বাত্মক শেয়ার বিক্রি হতে থাকে। অর্থাৎ লোকসানের ভয়ে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন। ফলে সোমবার সর্বাত্মকভাবে ধসে পড়ে শেয়ার বাজার।
ভারতে ছবিটা অবশ্য মঙ্গলবার একটু অন্যরকম, আগের তুলনায় ভালো। তবে সোমবারের চিত্রটা ইতোমধ্যে আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে।
'ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ'-এর 'নিফটি'-তে (ভারতীয় স্টক মার্কেট সূচক) সোয়া তিন শতাংশ পতন লক্ষ্য করা যায় সোমবার। ওই একইদিনে প্রায় তিন শতাংশ পতন দেখা যায় 'সেনসেক্সে'-এ।
বস্তুত বাজারের এই পতনের নেপথ্যে রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক সংক্রান্ত ঘোষণা। বহু দেশের উপরই রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা করেন তিনি। যার অর্থ হলো, মার্কিন পণ্য আমদানির উপর যে দেশ যেমন শুল্ক আরোপ করবে, তার উপর ভিত্তি করে সেই দেশের উপর শুল্ক চাপাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তার সাম্প্রতিক পদক্ষেপের পরই চীনসহ একাধিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নতুন করে শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেয়। ফলস্বরূপ, এই শুল্কের বিষয়টা আপাতত 'যুদ্ধের' আকার নিয়েছে। ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে শেয়ার বাজারে। শুল্ক সংক্রান্ত এই যুদ্ধের পরিণতি গুরুতর হতে পারে এই আশঙ্কায় ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, 'ফেডারেল রিজার্ভ'ও আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য নেতিবাচক হয়ে দাঁড়াতে পারে। শুধু তাই নয়, মার্কিন অর্থনীতিও মন্দার কবলেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ওই প্রতিষ্ঠান।
এদিকে এই 'অস্থির' পরিস্থিতিতে ভারতে সোমবার, শেয়ার বাজার খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপক পরিমাণে শেয়ার 'সেল অফ' বা নির্বিকারে সর্বাত্মকভাবে শেয়ার বিক্রি হতে থাকে। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব দেখা যায় আইটি কোম্পানি অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলোতে।
পাশাপাশি, মেটাল স্টক এবং ফিনান্সিয়াল স্টককেও এর ফলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। বস্তুত পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, বাজারের অস্থিরতা মাপার সূচক 'ইন্ডিয়া ভিআইএক্স'ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
শেয়ার বাজারের ওঠা-নামা পরিমাপের একটা সূচক হলো 'ইন্ডিয়া ভিআইএক্স'। এটা এমন এক ধরনের সূচক যা ভারতীয় শেয়ার বাজারের আগামী ৩০ দিনের অস্থিরতা অনুমান করে তার পূর্বাভাস দেয়। এই সূচক গণনা করা হয়, 'নিফটি ৫০-র' বিকল্পের 'বিড-আস্ক' মূল্যের উপর ভিত্তি করে।
যদি 'ইন্ডিয়া ভিআইএক্স' বেশি হয় তবে তার মানে দাঁড়ায় বাজারে 'ভয়' এবং 'অনিশ্চয়তা' বেশি রয়েছে। আর যদি 'ইন্ডিয়া ভিআইএক্স' কম হয়, তবে তার অর্থ বাজার 'স্থিতিশীল' রয়েছে।
এই আবহে, ভারতের শেয়ার বাজারে বড়সড় ধস লক্ষ্য করা গিয়েছিল সোমবার। এর নেপথ্যে থাকা পাঁচটা বড় কারণ দেখে নেওয়া যাক।
গ্লোবাল সেল অফ
সপ্তাহান্তে ছুটির পর সোমবার যখন ভারতীয় শেয়ার বাজার খোলে, তখন সারা বিশ্ব থেকে পাওয়া সংকেত এটা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে এদিন বাজারে ব্যাপক পতন দেখা যাবে। সেই আশঙ্কাই বাস্তবায়িত হয়। তবে শুধুমাত্র ভারতেই যে এমনটা দেখা গিয়েছে তা নয়, সোমবার ইউরোপ এবং এশিয়ার শেয়ার বাজারেও ধস দেখা গিয়েছে।
অস্থির পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। লোকসানের ভয়ে নির্বিচারে তাদের হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন। শেয়ারের এই বড় আকারের বিক্রয়কে 'সেল অফ' বলা হয়।
সাংহাই হোক, টোকিও বা হংকং- সর্বত্র শেয়ার বাজারে একইভাবে ধস লক্ষ্য করা গিয়েছে। শেয়ার বাজারের এমন পতন কিন্তু দীর্ঘদিন দেখা যায়নি। বিশ্বের অন্যান্য শেয়ার বাজারেও চিত্রটা একই ছিল।
শুল্কের দিক থেকে কোনও দেশকেই রেহাই দেওয়ার কোনওরকম ইঙ্গিত দেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুল্ক আরোপের বিষয়কে তিনি 'ওষুধ'-এর সঙ্গে তুলনা করে সোমবার বলেছিলেন কিছু জিনিস 'ঠিক করতে হলে ওষুধ খেতে হবে'। পাশাপাশি এটাও জানিয়েছিলেন যে বিশ্ব শেয়ার বাজারে লোকসান নিয়ে তিনি কিন্তু চিন্তিত নন।
তাইওয়ানে সোমবার বাজারে প্রায় ১০ শতাংশ পতন লক্ষ্য করা গিয়েছে এবং জাপানে নিক্কেই সূচকের পতন হয়েছে সাত শতাংশ। অন্যদিকে, শুক্রবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সূচক 'এসঅ্যান্ডপি ৫০০'-র প্রায় ছয় শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। বিশ্ববাজারে এই ধসের প্রভাব দেখা গিয়েছে দেশীয় বাজারগুলোতেও।
ট্রাম্পের বার্তা ও তার প্রভাব
শুল্ক আরোপ নিয়ে মি. ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্যের কারণে বিনিয়োগকারীরা মনে করেন যে আলোচনার মাধ্যমে এই মুহূর্তে কোনওরকম ইতিবাচক ফল মিলবে না।
ব্রোকারেজ ফার্ম এমকে গ্লোবাল জানিয়েছে, "চলতি অর্থবছরের প্রথম কোয়ার্টারে আমরা বাজার নিম্নমুখী হতে দেখছি।"
বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ভ্যানগার্ডের প্রধান অর্থনীতিবিদ কিয়ান ওয়াং বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের তরফে আরোপিত শুল্ক বৃদ্ধির কারণে এশিয়া সঙ্কটের মুখে পড়েছে।"
"শুল্ক নিয়ে এখনও আলোচনার জায়গা থাকলেও তার (শুল্কের) হার যে উচ্চই থাকবে, সেটা বোঝা গিয়েছে।"
একইসঙ্গে এশিয়ার অর্থনীতিতেও আশঙ্কার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। শুল্ক আরোপ নিয়ে এই 'যুদ্ধের' কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
এমনকি তা অর্থনৈতিক মন্দার দিকেও নিয়ে যেতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি এবং এই পরিস্থিতিতে এশিয়ার রফতানিকারকদের আরও বেশি পরিমাণে সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার আশঙ্কা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের ফলে জিনিসের দাম বাড়বে এবং কোম্পানিগুলোর আয় ও মুনাফার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যেহেতু এক অর্থে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অর্থনৈতিক অক্ষ, তাই উৎপাদন কতটা রাখতে হবে তা মূল্যায়ন করতে সময় লাগবে কোম্পানিগুলোর। মানে, সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েই যাচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের তরফে দোসরা এপ্রিল পাল্টা শুল্ক আরোপ সংক্রান্ত ঘোষণার পরই, চীনও মার্কিন পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করে। এর অর্থ হলো চীন 'কোনও রকম চুক্তির' জন্য প্রস্তুত নয়। সাম্প্রতিক আবহকে মাথায় রাখলে এই বিষয়টা এটা মনে হতে পারে যে বিশ্ব বাণিজ্য আপাতত শুল্ককে ঘিরে 'যুদ্ধের' মাঝে এসে পড়ছে।
রয়টার্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেপি মরগান বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ওই সংস্থার মতে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার কবলে পড়ার সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে তা ৪০ শতাংশ বলে অনুমান করা হয়েছিল।
জেপি মরগানের প্রধান অর্থনীতিবিদ ব্রুস কাসম্যান বলেন, "যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্য নীতি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, তবে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য কোনওটার পক্ষেই ভালো নয়। অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়তে পারে।"
বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস জানিয়েছে, আগামী ১২ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মন্দার কবলে পড়ার সম্ভাবনা ৪৫ শতাংশ। একই সঙ্গে ওয়াল স্ট্রিটের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও মি. ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্র মন্দার দিকে যাচ্ছে বলে তাদের যে পূর্ববর্তী অনুমান ছিল, সেখানে সংশোধন করেছে।
যদিও বলা হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের নয়া শুল্কনীতির প্রভাব ভারতে কম পড়বে, তবে যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা দেখা দিলে ভারতীয় অর্থনীতি কিন্তু তার ছোঁয়া থেকে বাঁচতে পারবে না।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের উপর ২৬ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেছেন। এরপর গোল্ডম্যান স্যাকস ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬.৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.১ শতাংশ করেছে।
ব্রোকারেজ ফার্ম, 'সিটি'-র তরফে অনুমান করা হচ্ছে যে মি. ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ৪০ বেসিস পয়েন্ট প্রভাবিত করতে পারে। আবার অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণা সংস্থা কোয়ান্টইকো-র পূর্বাভাস বলছে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ৩০ বেসিস পয়েন্ট পতনের সম্ভাবনা রয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের 'সেল অফ' এর প্রবণতা
ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টরদের অনেকেই নভেম্বর থেকে ভারতীয় বাজারে ব্যাপক পরিমাণে শেয়ার 'সেল অফ' করা শুরু করেছিল। গত মাসে তারা নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করে এবং ভারতীয় শেয়ার কেনা শুরু করে।
কিন্তু মি. ট্রাম্পের এই সাম্প্রতিক ঘোষণা তাদের কৌশল আবার বদলাতে বাধ্য করেছে।
শুক্রবার পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ১৩ হাজার ৭৩০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুল্ক নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ভারত শিগগিরই কোনও চুক্তিতে পৌঁছাতে না পারলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এই সর্বাত্মক শেয়ার বিক্রি হার আরও বৃদ্ধি পাবে।
কোম্পানিগুলোর 'খারাপ' ফলাফলের আশঙ্কা
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলোর জন্য একের পর এক দুঃসংবাদ এসে চলেছে। চলতি অর্থবর্ষের প্রথম প্রান্তিকেও কোম্পানিগুলোর খারাপ ফলাফলের ধারা অব্যাহত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়া সুদের হার নিয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। নয়ই এপ্রিল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের ঋণ নীতি নিয়ে পর্যালোচনা করার কথা রয়েছে। এই বৈঠকে সুদের হার কিছু কমানোর কথা ঘোষণা করা হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।