শিরোনাম
◈ দুই-একজন অপকর্ম করছে, তাদেরকে কোনভাবেই দলে রাখতে পারব না : ইশরাক ◈ রাজধানীতে বাড়তি নিরাপত্তা জোরদার, গ্রেফতার ১৪৮ ◈ দেশে এই প্রথম বিরাট অঙ্কের ভার্চুয়াল মুদ্রা জব্দ ◈ ঈদের আগে আবারও বাড়লো  স্বর্ণের দাম, সোমবার থেকে কার্যকর ◈ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে চীনের সৌর প্যানেল জায়ান্ট ‘লংগি’: চীনা রাষ্ট্রদূত ◈ 'ধর্ষণ’ শব্দ নিয়ে ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ◈ আগামী বছর থেকে কর্পোরেট রিটার্নও অনলাইনে: এনবিআর ◈ বিএনপি ক্ষমতায় এলে বিগত সরকারের সময়ে হওয়া সব হত্যার বিচার করা হবে: তারেক রহমান  ◈ ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে না, সত্য নয়: প্রেস উইং ◈ নির্বাচন দেরি হলে ফ্যাসিস্ট শক্তি ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে: মির্জা ফখরুল 

প্রকাশিত : ১৬ মার্চ, ২০২৫, ০৫:৫১ বিকাল
আপডেট : ১৭ মার্চ, ২০২৫, ১২:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সংকটাপন্ন ১১ ব্যাংকের ৬টি যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, পাঁচটি ব্যাংক এখনও কেন ঝুঁকির মুখে?

দুর্নীতির কারণে প্রায় ধসের মুখে থাকা ১১টি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের মধ্যে ছয়টি ইতোমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত ছয় মাসে আমানত সংগ্রহ ও গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে এসব ব্যাংক এ অগ্রগতি অর্জন করেছে।

গত বছরের আগস্টে গভর্নর আহসান এচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটির তারল্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ৩০ হাজার কোটি টাকা নতুন অর্থ সরবরাহ করে এ পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করে।

ঘুরে দাঁড়ানো ছয়টি ব্যাংক হলো—ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), এক্সিম ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আইএফআইসি ব্যাংক ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক।

এসব ব্যাংকের বেশিরভাগই এখন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল নয়। সময়োপযোগী হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতি সহায়তার ফলে এগুলো তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।

তবে নতুন উদ্বেগের বিষয় হলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। আগে গোপন থাকা বিপুল পরিমাণ মন্দ সম্পদ (ঋণ) এখন প্রকাশ পাচ্ছে, যা ব্যাংকগুলোর লাভজনকতায় বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারিত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে প্রভিশন ফরবিয়ারেন্স সহায়তা বিবেচনা করবে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংকগুলোর প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন যে, শিল্পখাতে গড় খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছালেও প্রকৃত চিত্র গোপন করা যাবে না।

পাঁচটি ব্যাংকের সংকট কাটানোর সম্ভাবনা কম
এদিকে, বাকি পাঁচটি ব্যাংক এখনো আমানতকারীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে এবং আমানত উত্তোলনের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নতুন টাকা ছাপানো বন্ধ করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ তারল্য সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ পাঁচটি ব্যাংক এখনো প্রতিদিন তারল্য সহায়তার জন্য আবেদন করে যাচ্ছে।

এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর তারল্য সহায়তা কর্মসূচিও কার্যকারিতা হারিয়েছে, কারণ এ কর্মসূচির আওতায় ঋণ নেওয়া কিছু ব্যাংক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে গ্যারান্টি প্রকল্পের অধীনে সাতটি সংকটাপন্ন ব্যাংককে ২৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে এখনো ৭ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।

ফলে গ্যারান্টি প্রকল্পের আওতায় অন্য কোনো ব্যাংক এখন এসব সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংককে ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ইতোমধ্যে এ প্রকল্প বন্ধের পরামর্শ দিয়েছে, কারণ এটি ব্যাংক খাতকে উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পাঁচটি ব্যাংকের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলে মনে করছে।

ঋণ কার্যক্রম স্থগিত থাকায় এসব ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আমানত উত্তোলন পরিচালনার জন্য এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থের ওপর নির্ভর করছে, কারণ এ ব্যাংকগুলো এখনো গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।

সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর জন্য 'ব্যাংক রেজোলিউশন আইন'
এমন পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ সহজ করতে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে 'ব্যাংক রেজোলিউশন আইন' চূড়ান্ত করার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।

'ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ', ২০২৫-এর চূড়ান্ত খসড়া ইতোমধ্যে অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

এ অধ্যাদেশ বাংলাদেশ ব্যাংককে অকার্যকর ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেবে। এর আওতায় অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ, নতুন বা বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ, তৃতীয় পক্ষের কাছে শেয়ার, সম্পদ ও দায় হস্তান্তর, গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি সেতু ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং ব্যর্থ ব্যাংক বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গভর্নর মন্তব্য করেন, 'সব ব্যাংক টিকে থাকবে না।'

তিনি আরও বলেন, 'কিছু ব্যাংকের টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। কিছু ক্ষেত্রে, ব্যাংকের ৮৭ শতাংশ আমানত মাত্র একটি পরিবারের কাছে দেওয়া হয়েছে।'

এ পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে চারটি আগে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এসব ব্যাংকের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত, কারণ এগুলোর ৮০ শতাংশেরও বেশি আমানত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কাছে কেন্দ্রীভূত ছিল।

এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ওরফে এস আলম বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলো পাওনা আদায়ের জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।

ইসলামী ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ ১৭ হাজার কোটি টাকা
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ সরে যাওয়ার পর দেশের বৃহত্তম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।

পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ব্যাংকটি গত ছয় মাসে ১৭ হাজার কোটি টাকা নতুন আমানত সংগ্রহ করেছে।

গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাপক আমানত উত্তোলনের চাপে পড়েছিল ব্যাংকটি, যার ফলে গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তারল্য সহায়তা নিতে হয়। তবে, বর্তমানে এ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, কারণ রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকটি পুনরায় স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা পায়। তবে, আমানতের ধারাবাহিক প্রবাহ বজায় থাকায় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যাংকটির আর তারল্য সহায়তার প্রয়োজন হয়নি।

এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যাংক মুক্ত হওয়ার পর চেয়ারম্যান নিযুক্ত ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ জানান, গত ছয় মাসে ব্যাংকটিতে সাড়ে ১২ লাখ নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।

তিনি ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন। তিনি আরও জানান, ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার মূল্যায়নের জন্য একটি অডিট ফার্ম নিয়োগ করা হয়েছে এবং অতীতের অনিয়মের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

আইএফআইসি ব্যাংক ৪,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে
পূর্বে শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রিত আইএফআইসি ব্যাংক গত চার মাসে চার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে, যা গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়েছে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা আমানত হারায় ব্যাংকটি। ফলে অক্টোবরে ব্যাংকের মোট আমানত ৪৫ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে, যেখানে জুলাই মাসে এটি ছিল ৫০ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা।

বিপুল পরিমাণ আমানত উত্তোলনের ফলে তারল্য সংকট দেখা দেয় এবং ব্যাংক আমানতকারীদের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। তবে, চেয়ারম্যান মো. মেহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে নবনিযুক্ত পরিচালনা পর্ষদ গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধারকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় আমানতের প্রবাহ আবার বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সারাদেশে ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখা পরিদর্শন করেছেন এবং কর্মকর্তাদের আমানত সংগ্রহের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

তিনি ব্যাংকের তারল্য সংকট সমাধানে ব্যাপক আমানত সংগ্রহ অভিযানের কৃতিত্ব দেন এবং জানান যে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আইএফআইসি ব্যাংকের আর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তারল্য সহায়তা নিতে হয়নি।

'তারল্যের অবস্থার উন্নতির কারণে ব্যাংকটি এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সীমিত পরিসরে ঋণ বিতরণ পুনরায় শুরু করেছে,' বলেন তিনি।

ইউসিবির ২,৪০০ কোটি টাকার নিট আমানত প্রবাহ
পূর্বে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পর আমানত উত্তোলনের চাপ কাটিয়ে উঠেছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমানত প্রবাহ বাড়ায় ব্যাংকটি নিজস্ব তারল্য দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ব্যাংকটি দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। তবে, আমানত ক্ষয় বন্ধ হওয়ায় গ্রাহকেরা এখন আবার তাদের তহবিল ফিরিয়ে দিচ্ছেন।

গত ছয় মাসে ব্যাংকটি দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা নিট আমানত সংগ্রহ করেছে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশ এসেছে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে।

টিবিএস-এর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইউসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মামদুদুর রশিদ জানান, জুলাই আন্দোলনের পর তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তারল্য সহায়তা নেননি।

তিনি বলেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী অস্থির সময়ের কারণে ব্যাংক কিছু কর্পোরেট আমানত প্রত্যাহারের সম্মুখীন হয়েছিল।

সেপ্টেম্বরে ব্যাংকে যোগদানের পরপরই রশিদ ২৮০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চার দিনের একটি আমানত সংগ্রহ অভিযান শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত এটি ৪০৯ কোটি টাকা সংগ্রহ করে ফেলে।

যদিও জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকটি কিছুটা আমানত হ্রাসের সম্মুখীন হয়েছিল, ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ৩৩০ কোটি টাকা এবং মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে এক হাজার ২৪০ কোটি টাকা নিট আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে।

ব্যাংকটি ইতোমধ্যেই তারল্যের চাপ কাটিয়ে নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) এবং বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর)-এর ঘাটতি পূরণ করেছে।

রশিদ বলেন, 'ব্যাংকের জন্য এখন আর তারল্য সংকট উদ্বেগের বিষয় নয়, তবে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। আমরা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছি এবং উচ্চমানের সম্পদ বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি।'

এসআইবিএল স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেছে
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, যা আগে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল, জুলাই অভ্যুত্থানের পর সাত হাজার কোটি টাকা আমানত উত্তোলনের মুখে পড়েছিল। তবে তারল্য সংকট কাটিয়ে ওঠার পর ব্যাংকটি এখন স্বাভাবিক নগদ প্রবাহ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) সংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করায় ব্যাংকটির বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যক্রম পুনরায় সচল হয়েছে। তবে, এস আলম গ্রুপের সময় খোলা এলসির বিপরীতে বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার কারণে ব্যাংকটি এখনো কিছুটা তারল্য সংকটে রয়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটি নতুন করে ৯০০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে। এছাড়া, ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত চার হাজার কোটি টাকা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।

টিবিএস-এর সঙ্গে আলাপকালে ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুস সাদাত বলেন, 'অস্বাভাবিক আমানত উত্তোলন বন্ধ হওয়ায় সব শাখায় নগদ প্রবাহ এখন স্বাভাবিক রয়েছে।'

তিনি আরও জানান, গ্রাহকেরা ব্যাংকের স্বাভাবিক লেনদেনে ফিরে আসছেন এবং নতুন আমানত জমা দিচ্ছেন। পাশাপাশি, বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের পর আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও গতি এসেছে, যার ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। এছাড়া, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ সংক্রান্ত সেবাগুলো পুনরায় চালু হওয়ায় নগদ প্রবাহ আরও স্থিতিশীল হয়েছে।

তিনি বলেন, ব্যাংকটি বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনও স্বাভাবিক করেছে এবং আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত সেবা চালু রেখেছে।

তবে, ঈদের আগে আমানত উত্তোলনের চাপ সামলাতে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দেড় হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তার আবেদন করে। ঈদের আগে এ ধরনের সহায়তা চাওয়া অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত সহায়তা প্রদান করেছে।

এক্সিম ও আল-আরাফাহ ব্যাংকেও স্বাভাবিক কার্যক্রম
এক্সিম ব্যাংক ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রমও বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে এবং আমানত উত্তোলনের চাপ কমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, এক্সিম ব্যাংক ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া তারল্য সহায়তার একটি বড় অংশ পরিশোধ করেছে। বর্তমানে এ দুটি ব্যাংক আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তার ওপর নির্ভর করছে না।

কেন পাঁচটি ব্যাংক এখনও ঝুঁকির মুখে?
ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে চারটি আগে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত। এসব ব্যাংক হলো—বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক।

পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পরও ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হতে সময় লাগছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এস আলম ব্যাংকটির আমানতের ৮০ শতাংশ বেনিফিশিয়ারি।

ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান দুর্নীতির মাত্রা ব্যাখ্যা করে বলেন, যে ঋণগ্রহীতা ১০০ টাকা পরিশোধের সক্ষমতা রাখেন না, তাকেই ৩০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল।

তিনি আরও জানান, এসব ঋণগ্রহীতাদের অনেকেরই অস্তিত্ব নেই, কারণ একই গোষ্ঠী একাধিক ভুয়া পরিচয়ে ঋণ নিয়েছিল।

ব্যাংকটি বর্তমানে নতুন আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। ব্যাংকটি এখনো তারল্য সহায়তা গ্রহণ করে টিকে আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি এক হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা অনুমোদন করেছে।

অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিনটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকের জন্য তারল্য সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ এগুলোর পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, এ ব্যাংকগুলোর আমানত ভাণ্ডার তুলনামূলক ছোট হওয়ায় এগুলো বড় দুর্নীতির ধাক্কা সামলাতে পারছে না।

গত ১৫ বছর ধরে সিকদার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে লড়াই করছে। দীর্ঘদিন ধরে লুটপাট চলতে থাকলেও অতীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

পরবর্তীকালে নতুন সরকারের আমলে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে ব্যাংকটি সিকদার পরিবারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়। তবে, ততদিনে সংকট অনেক গভীর হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকটির মোট আমানত ৩৫ হাজার কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে, যা গত বছর ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি ছিল।

তারল্য সংকটের চাপের মধ্যে পড়ে ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে পদত্যাগের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদত্যাগ করেছেন, এবং ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হতাশ হয়ে পদত্যাগের কথা ভাবছেন।

পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পর আব্দুল আউয়াল মিন্টুকে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালালেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে নগদ প্রবাহ বৃদ্ধি করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। উৎস: বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়