শিরোনাম
◈ জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ: দলে যোগ দিচ্ছেন ছাত্র-জনতা (ভিডিও) ◈ জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ ১০ নেতা চূড়ান্ত, থাকছেন যাঁরা ◈ নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যাচ্ছে বিএনপির প্রতিনিধি দল ◈ ১৪০১ জন 'জুলাই যোদ্ধার' তালিকার গেজেট প্রকাশ ◈ শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ডের কারণ ও মৃত্যু সংখ্যা নিয়ে যা জানালেন প্রেস সচিব (ভিডিও) ◈ থানা থেকে গ্রেফতার হলেন ভাঙ্গা থানার ওসি ◈ আখতার হোসেন ও নাহিদ ইসলামকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে যা বললেন আসিফ নজরুল ◈ জাতীয় নাগরিক পার্টিতে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব কতটা গভীর, কীভাবে ঐক্য ধরে রাখবে এই নতুন দল? ◈ নতুন দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ আত্মপ্রকাশ বিকেলে, শীর্ষ নেতৃত্বে যারা থাকছেন ◈ বরেন্দ্র অঞ্চলে স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির সাফল্য: নেদারল্যান্ডের ‘ভ্যালেন্সিয়া’ আলু চাষে কৃষকদের বিপ্লব

প্রকাশিত : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১২:০৯ দুপুর
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০৪:২৩ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ফুলবাড়ীতে ৮৩ বিলিয়ন ডলারের মজুদ রয়েছে কয়লা, বিনিয়োগ প্রয়োজন ১৫ বিলিয়ন ডলারের

বণিক বার্তা: দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কয়লা খনিতে কয়লা মজুদ রয়েছে বর্তমানে ৫৭২ মিলিয়ন টন। জ্বালানি বিভাগের হাইড্রোকার্বন ইউনিটের এক হিসাব অনুযায়ী, মূলধন ও পরিচালন ব্যয় মিলিয়ে ফুলবাড়ী খনি উন্নয়ন কার্যক্রমে অর্থ প্রয়োজন পড়বে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বিনিময় হার অনুযায়ী প্রতি ডলারে ১২২ টাকা ধরে বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। এ বিনিয়োগ করা গেলে এখান থেকে কয়লা তোলা যাবে প্রায় ৮৩ বিলিয়ন ডলারের (বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম বিবেচনায়)। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০ লাখ ১২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে এরই মধ্যে বেশকিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেছে হাইড্রোকার্বন ইউনিট।

তবে অন্তর্বর্তী সরকার এখনই এসব সুপারিশের ভিত্তিতে ফুলবাড়ী থেকে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না বলে জানিয়েছেন দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারকরা। তাদের ভাষ্যমতে, পরবর্তী সরকার এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে হাইড্রোকার্বন ইউনিটের এসব সুপারিশ সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

ফুলবাড়ী থেকে কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে এর বিরোধিতা সবচেয়ে বেশি। ২০০৬ সালে ফুলবাড়ী খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়। হতাহত হয়েছেন বহু মানুষ। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য হলো ফুলবাড়ী থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা আহরণ করা হলে তা এখানকার জীবন-জীবিকা ও বাসস্থান এবং স্থানীয় প্রাণ-প্রকৃতি প্রতিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে। সে সময় ফুলবাড়ী থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা আহরণ করা হবে না বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল সরকার।

জ্বালানি বিভাগের ভাষ্যমতে, দেশের মোট কয়লা মজুদের প্রায় ৭ শতাংশ আছে ফুলবাড়ীতে। এ খনি উন্নয়ন করা গেলে বছরে ১৫ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে, যা দেশের মোট কয়লা চাহিদার ৫০ শতাংশ। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা গেলে দুই বছরের মধ্যে উত্তোলন শুরু করা যাবে বলে দাবি জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্টদের।

বিদ্যুৎ ভবনে গতকাল ‘বাংলাদেশের কয়লাসম্পদের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এক হাইড্রোকার্বন ইউনিট বিভাগের পরিচালক (অনুসন্ধান ও উৎপাদন) ড. অরূপ কুমার বিশ্বাস উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে এসব বক্তব্য উঠে আসে।

এতে দাবি করা হয়, ফুলবাড়ীতে ১২৪টি ড্রিলিং করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বড়পুকুরিয়া লিজ এলাকার ভেতরে। ফুলবাড়ী এলাকার লিথিওলজি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পানিবাহী স্তরটি বিভিন্ন জায়গায় কয়লা স্তরের প্রায় সংলগ্ন। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে খনন করলে কোনো কারণে উপরিভাগে ফাটলের সৃষ্টি হলে সমগ্র খনি এলাকা প্লাবিত হতে পারে। তাই ফুলবাড়ী কয়লা খনি ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে খনন করা সম্ভব নয়। কয়লা উত্তোলনে খনিটি উন্মুক্ত পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই।

হাইড্রোকার্বন ইউনিটের ভাষ্য অনুযায়ী, ফুলবাড়ী থেকে কয়লা উত্তোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ১০-১২ বছর ধরে চলবে। এডিবির পুনর্বাসন নীতিমালা অনুসারে প্রকল্পের পুনর্বাসন পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন সহায়তা নিষ্পত্তির আগে কোনো স্থানান্তর করা হবে না। খনি সন্নিহিত এলাকায় যাবতীয় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত গ্রাম তৈরি, প্লট বরাদ্দ ও মডেল টাউন তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। অধিগ্রহণকৃত জমি খনি ব্যবহারের আগে কৃষি উৎপাদন ব্যবহারের সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রকল্পের পুনর্বাসন বাস্তবায়ন ব্যয় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে।

জ্বালানি বিভাগ দাবি করছে, ফুলবাড়ী কয়লা খনিকে ঘিরে ইকোনেমিক গ্রোথ সেন্টার গড়ে উঠবে, যা দেশের জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখবে। এছাড়া খনিসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে কর্মসংস্থান হবে ১৭ হাজার মানুষের। আর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে ৫০ হাজার মানুষের। খনি থেকে কয়লার পাশাপাশি কয়লা স্তরের উপরিভাগের প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের কাচবালি, সাদামাটি, নুড়িপাথর, নির্মাণ বালি আহরণ সম্ভব হবে।

সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধে আরো দাবি করা হয়, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হলে এখান থেকে ৯০ শতাংশের বেশি কয়লা উত্তোলন সম্ভব। স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিম্নতম। ভূমির ব্যবহার তুলনামূলক বেশি এবং দুই-তিন বছরের মধ্যে খনি নির্মাণ করা যায়। অন্যদিকে, ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে উৎপাদন খরচ বেশি, স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি উচ্চমাত্রায়, মাইনিং জটিলতা, ভূমির অবনমন এবং এ ধরনের খনি থেকে কয়লা পেতে ৮-১০ বছর সময় লেগে যায়।

জ্বালানি বিভাগের গতকালের সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, ‘পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের জন্য কয়লা উত্তোলনের রোডম্যাপ তৈরি করে যেতে চাই। তারা কয়লা উত্তোলনে যাবেন কিনা, সেটি তাদের সিদ্ধান্ত। আমরা কেবল বিভিন্ন পন্থা নিয়ে সুপারিশ দিতে চাই।’

হাইড্রোকার্বন ইউনিটের এ সুপারিশ নিয়ে আপত্তি তুলে জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে ২০০৬ সালের ওই আন্দোলনের বিষয়টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে যাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের সঙ্গে স্থানীয়দের চুক্তি নিয়েও এতে কিছু বলা হয়নি। আবার এখানে বেশকিছু দাবি অতিরঞ্জিত আকারে এসেছে।

বাংলাদেশের কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘২০০৬ সালে এশিয়া এনার্জির উন্মুক্ত কয়লা খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ফুলবাড়ী আন্দোলন সম্পর্কে এ উপস্থাপনায় কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এ আন্দোলনে তিন স্থানীয় নাগরিক নিহত ও শত শত মানুষ আহত হয়েছেন। এছাড়া সরকার ও ফুলবাড়ীর জনগণের মধ্যে একটি চুক্তি রয়েছে যে তারা উন্মুক্ত কয়লা খনির জন্য যাবেন না। তাহলে এখন এ চুক্তির ভাগ্য কী হবে?’

দেশের ক্রমবর্ধমান প্রাথমিক জ্বালানি চাহিদা পূরণ, আমদানিনির্ভরতা হ্রাস ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের জন্য স্থানীয়ভাবে কয়লা উত্তোলন বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে দেশের অভ্যন্তরে এসব খনি যেসব এলাকায় অবস্থিত, সেখানে বিপুলসংখ্যক জনবসতি ও কৃষিনির্ভরতার কারণে কয়লা উত্তোলন নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বিষয়টি নিয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের কয়লা খনি, কয়লা উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে বেশ কয়েকটি কমিটি হয়েছে। এগুলো সম্পর্কে না জেনে এ ধরনের বিষয়ে কোনো কার্যক্রম হাতে নেয়া উচিত নয়। বিশেষত ফুলবাড়ীর কয়লা উত্তোলন করলে কী ধরনের ক্ষতি হবে তা বিগত সময়ের রিপোর্টে বলা হয়েছে। কোনো কমিটির রিপোর্টে ফুলবাড়ীর কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তোলনের অনুমতি দেয়া হয়নি। এশিয়া এনার্জি বাংলাদেশের কয়লা দেখিয়ে লন্ডনের শেয়ারবাজারে ব্যবসা করছে। এশিয়া এনার্জি এ কয়লা খনি দেখিয়ে শেয়ারবাজারে কীভাবে ব্যবসা করছে, সেটা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এসব বেআইনি তৎপরতা বন্ধ করা। বরং কয়লার চেয়ে অনেক সহজ-সুলভ ও পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত এ সরকারের।’

দেশে বর্তমানে সাত হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। দৈনিক এসব কেন্দ্রে কয়লার প্রয়োজন ৫৮ হাজার টন। বছরে ২১ মিলিয়ন টন কয়লার প্রয়োজন হয়, যার আনুমানিক মূল্য ২ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। সবগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ হলে এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে। আমদানি হ্রাস করতে দেশের কয়লা উত্তোলন নিয়ে আগামীতে কী ধরনের কাজ করা যায় তারই আলোকে মূলত কয়লাসম্পদের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। মূলত কয়লার পলিসি, রোডম্যাপ কী হবে—সেগুলোর বিষয়ে একটা পথনির্দেশনা দেয়া হয়েছে এ উপস্থাপনায়। আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নেব না। পরবর্তী সরকার কয়লাসম্পদ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে যাতে সহায়ক হয়, সেই পরিকল্পনা থেকেই আলোচনাটি উপস্থাপিত হয়েছে।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়