মনজুর এ আজিজ : নানামুখী কারণে দেশের শিল্প খাত এখন গভীর সংকটে নিমজ্জিত। তবে এর প্রধানতম প্রতিবন্ধকতা মনে করা হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট। শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস না পাওয়ায় ব্যাপকভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া ব্যাংক ঋণে সুদের হার আগের ৯ শতাংশ থেকে এখন আদায় করা হচ্ছে ১৭-১৮ শতাংশ।
পাশাপাশি রয়েছে মারাত্নক ডলার সংকট। আবার বিগত সরকারের আমলে ন্যাক্কারজনকভাবে টাকার অবমূল্যায়নে ডলার রেটও অনেক বেশি। এর প্রভাবে ইতোমধ্যে কয়েক শ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এরমধ্যে আবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস সংকটে অনেক কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকায় নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ করা সম্ভভ হচ্ছেনা। ৩ মাসের উৎপাদন দিয়ে এক মাসের বেতন হচ্ছে। ফলে বাড়ছে শ্রম অসন্তোষ। এমন পরিস্থিতিতে সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। দেশের এমন পরিস্থিতিতে রোববার রাজধানীতে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, শিল্প খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করলে বিনিয়োগ কমে বাড়বে আমদানিনির্ভরতা। এতে চাপে পড়বে দেশের অর্থনীতি।
প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মূল প্রবন্ধে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, বর্তমান চ্যালেঞ্জিং সময়ে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ বাড়ানো হলে উৎপাদনমুখী খাতে পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে। এতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমবে। নতুন বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সিমেন্ট, ইস্পাত ও সিরামিক খাতে নতুন করে আমদানিনির্ভরতা বাড়বে। আর্থিক খাতের ওপর চাপ পড়বে। অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যাংকে মন্দ ঋণ বাড়তে থাকবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার শিল্পে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ব্যাংকে সুদের হার বেশি। গ্যাসের দামও বাড়তি। তারপরও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস দিতে পারছে না সরকার। এ অবস্থায় ‘সরকার নতুন শিল্পের জন্য ১৫০ শতাংশ এবং সম্প্রসারণ শিল্পের জন্য ৫০ শতাংশ গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। আমরা আর কেউ শিল্প করতে চাই না। তবে বর্তমান শিল্পকে সহায়তা করবেন না, এটা হতে পারে না। দেশের অর্থনীতি ধরে রাখতে হলে গ্যাসের দাম বর্তমানের চেয়ে কমানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।
প্রতিনিয়ত বাড়ছে জনসংখ্যা, বাড়ছে কর্মসংস্থানের চাহিদা। কিন্তু সেই অনুযায়ী বাড়ছে না শিল্প-কারখানা, বাড়ছে না কর্মসংস্থানের সুযোগ। বরং উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে। বিদ্যমান শিল্পগুলোও ধুঁকতে ধুঁকতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে দ্রুত বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার কর্মসংস্থান হবে কিভাবে?
ব্যবসায়ীদের মতে, বর্তমানে শিল্পঘন এলাকাগুলোতে, বিশেষ করে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে অবস্থিত কারখানাগুলোতে গ্যাসসংকটের কারণে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ হারে উৎপাদন কমে গেছে। ফলে কারখানাগুলোর প্রডাকশন শিডিউল ও সরবরাহ চেইন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম এভাবে বাড়ানো হলে তা দেশের শিল্প খাতকে আরো বিপর্যস্ত করবে।
আমরা মনে করি, দেশের শিল্প খাতের উন্নয়নে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, যা শিল্প খাতে বিপর্যয় ডেকে আনে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা রপ্তানি আয়ের প্রধান চালিকা শক্তি দেশের টেক্সটাইল সেক্টর দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এর মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, ডলারের সংকট, ব্যাংক সুদের হার ১৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের শর্তাবলী পূরণের অজুহাতে রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনার অস্বাভাবিক হ্রাস এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের সংকট ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তিনি বলেন, ভারত থেকে বিভিন্ন স্থলবন্দর/কাস্টমস হাউজ ব্যবহার করে ডাম্পিং মূল্যে সুতা ও কাপড় স্থানীয় বাজারে প্রবেশের ফলে দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পের চ্যালেঞ্জে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আমরা যেটুকু সুতা উৎপাদন করছি তা বিক্রি করতে পারছি না। এলসি ও বিনা এলসিতে ভারত থেকে সূতা আসছে। অন্যদিকে ভারত যে দামে সুতা বিক্রি করছে তা ডাম্পিং। ফলে আমাদের উৎপাদিত সুতা গুদামে অবিক্রিত পড়ে আছে। বর্তমানে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার সুতা আমাদের সদস্যদের গুদামে অবিক্রিত পড়ে আছে।
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে গঠিত সরকারের কাছে আমরা সকল বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দেশের স্বার্থে অনতিবিলম্বে দেশীয় টেক্সটাইল খাতের ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে আমাদের দাবিগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার দাবি জানাচ্ছি। সব স্থলবন্দর/কাস্টমস হাউজ ব্যবহার করে সুতা আমদানি বন্ধ করে শুধু সমুদ্র বন্দর দিয়ে সব ধরনের সুতা আমদানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন কর্তৃক গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সাম্প্রতিক উদ্যোগ অবিলম্বে বন্ধ করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক। সেই সঙ্গে অবিলম্বে বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের প্রক্রিয়া স্থগিত করার দাবি জানান বিটিএমএ সভাপতি।