মনজুর এ আজিজ: বাজারে ভোজ্যতেল নিয়ে তেলেসমতি চলছে। সরকার ভোজ্যতেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে নানাভাবে চেষ্টা করেও সামাল দিতে পারছে না। ভোজ্যতেলের সংকট মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে লিটারপ্রতি ৮ টাকা করে বাড়িয়ে দেওয়া হলেও সংকট থেকে মুক্তি মিলছে না। আরও বেশি দাম দাবি করে তা ক্রেতাদের থেকে আড়াল করে রাখছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন বাজার থেকে উধাও করে ক্রেতাদের নাগালের বাইরে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে আমদানিকারকদের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে দুই দফায় শুল্ক কমিয়েছে সরকার। তারপরও বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়াসহ ডলার সংকট ও বিনিময় মূল্য বৃদ্ধির কারণে সরকার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বাড়ায়। একইভাবে খোলা সয়াবিন তেল, খোলা পাম অয়েলের দামও বাড়ানোর প্রস্তাবও অনুমোদন করে। মূলত মিলগেট থেকে আমদানিকারকরা সরবরাহ কমিয়ে বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরির পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম বাড়াতে সম্মত হয়েছিল। এখন বিশ্ববাজারে দাম না বাড়লেও বাজারে কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে আবারো বাজারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিল মালিকদের বিরুদ্ধে দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। তাদের এমন কারসাজিতে সরকার ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির এক মাসের ব্যবধানে ফের সরবরাহ সংকট দেখিয়ে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এক মাসের ব্যবধানে এরই মধ্যে পাইকারিতে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) দাম ৩০০-৩৫০ টাকা বেড়েছে। ওই হিসাবে কেজিতে প্রায় ১০ টাকা দাম বেড়েছে। সূত্র মতে, সরকারি পর্যায়ে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির অনুমোদনের পর সয়াবিন তেলের পাইকারি দাম মণপ্রতি কমে ৬ হাজার ২৫০ টাকায় নেমে আসলেও এক সপ্তাহ ধরে তা বেড়ে আবার ৬ হাজার ৫৫০ থেকে ৬ হাজার ৬০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
মূলত মিলগেট থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার কারণে পাইকারি বাজারে এ পণ্যের দাম বাড়ছে। আর দেশের বাজারে দাম বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম নিম্নমুখী। গত ডিসেম্বরে বৈশ্বিক বুকিং দর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমেছে। গত মাসে কেনা অপরিশোধিত সয়াবিন তেল জানুয়ারির শেষার্ধে দেশে পৌঁছাবে। কিন্তু পাইকারি বাজারে মিলগেট থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার থেকে বিক্রি হওয়া এসও (সরবরাহ আদেশ) বাই-ব্যাক করায় বাজার দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।
গত অক্টোবরে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের বুকিং দর ছিল ১ হাজার ৯৫ ডলার। নভেম্বরে ৫০ ডলার বেড়ে লেনদেন হয়েছে গড়ে ১ হাজার ১৪৫ ডলারে। কিন্তু ডিসেম্বর জুড়ে সয়াবিন তেলের বুকিং দর ছিল ১ হাজার ৬৪ ডলার। এক মাসের ব্যবধানে ৮১ ডলার কমলেও মিল মালিকরা বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ফের বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ফলে পণ্যটির দাম প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে।
সয়াবিন তেলের স্বাভাবিক সরবরাহ না থাকায় হতাশ ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই। এক্ষেত্রে দোকানিরা বলছেন, কোম্পানি প্রতিনিধিদের বারবার অর্ডার দিলেও চাহিদা অনুযায়ী তেল পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম কিছুটা কমেছে। তারপরও মিল থেকে তেলের সরবরাহ এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
বর্তমানে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটার প্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা। আর পাঁচ লিটারের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল বিক্রি মূল্য ৮৫০-৮৫৫ টাকা। প্রায় দুই মাস আগে সরকার থেকে দাম বাড়লেও সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট চলমান। এখনও বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক নয় বলেই দাবি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। এদিকে খোলা সয়বিন তেল লিটার প্রতি বাড়তি দামে ১৮০-১৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মধুবাগ, রামপুরা ও বনশ্রী মেরাদিয়া বাজার থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে এমন চিত্র দেখা গেছে।
বনশ্রী মেরাদিয়া বাজারের দোকানি আফজাল জানান, গত দুই-তিন মাস ধরেই ডিলাররা তেল সরবরাহ করছে না। অর্ডার দিয়েও তেল পাচ্ছি না। অনেকেই তেল চাচ্ছে কিন্তু দিতে পারছি না। এক দফা দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, তারপরও সরবরাহ স্বাভাবিক নয়। রমজানকে ঘিরে আরেক দফা দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে বড় ব্যবসায়ীরা। বাধ্য হয়ে বর্তমানে খোলা তেল ১৮৫-১৯০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা রহিম জানান, বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট নেই। দাম বৃদ্ধির পর থেকে বাজারে ভোজ্যতেলের স্বাভাবিক সরবরাহ রয়েছে। আমরা চাহিদা অনুসারেই সরবরাহ করতে পারছি। বরং গত সপ্তাহে ব্যারেলপ্রতি সয়াবিন তেলের দাম ১ হাজার টাকার বেশি কমেছে বলে জানি। তবে বোতলজাত তেলে সংকট আছে।
তেল নিতে এসে শরীফ নামের এক ক্রেতা বলেন, বাজারে সয়াবিন তেল নেই। সামনে রমজান মাস, দাম আরও বেশি নেওয়ার আশায় বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট দেখিয়ে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ২ লিটার তেল পেয়েছি, তাও বাড়তি দামে কিনেছি। যদিও এমআরপি ৩৫০ টাকা লেখা ছিল। ক্রেতা হিসেবে বাধ্য হয়ে প্রতিনিয়ত ঠকে যাচ্ছি।
জানা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৮ টাকা বেড়েছে। ফলে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকায়। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৫৭-১৬০ টাকা হয়। খোলা পাম তেলের লিটারও ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৫৭ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম এখন ৮৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৮১৮ টাকা।
সয়াবিন ও পামতেলের সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বাজারে দর বিবেচনায় নিয়ে পবিত্র রমজান মাসে পণ্যটির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার উদ্দেশ্যে অব্যাহতি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সয়াবিন ও পাম তেলের অব্যাহতির মেয়াদ আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
ভোজ্যতেলের ওপর আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ মূসক ব্যতীত অন্য শুল্ক-করাদি প্রত্যাহার করা হয়। গত অক্টোবরে এমন আদেশ জারি করেছিল এনবিআর। আর ১৬ ডিসেম্বর ক্যানোলা ও সানফ্লাওয়ার তেল আমদানিতে আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করার পাশাপাশি মূসক বা ভ্যাট হ্রাস করে প্রতিষ্ঠানটি। তারপরও ভোজ্য তেলের বাজার স্বাভাবিক হয়নি বলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই দাবি করছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মাওলা জানান, সরকার দুই দফায় ভোজ্যতেলের ওপর শুল্ক কমিয়েছে। এরপরও ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে দাম বাড়ানো হয়। এখন ফের দাম বাড়ছে। এক্ষেত্রে সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানিকারক পর্যায়ে মনিটরিং কার্যক্রম বাড়ালে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল থাকবে।
আপনার মতামত লিখুন :