নির্মাণকাজ শেষে দাশেরকান্দি পয়োবর্জ্য শোধনাগার চালু হয় ২০২৩ সালের জুলাইয়ে। চীনা এক্সিম ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় বাস্তবায়িত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা।
নির্মাণকাজ শেষে দাশেরকান্দি পয়োবর্জ্য শোধনাগার চালু হয় ২০২৩ সালের জুলাইয়ে। চীনা এক্সিম ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় বাস্তবায়িত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশের কাছাকাছি নির্বাহ হয়েছে এ ঋণ সহায়তার ভিত্তিতে। বিপুল অংকের ঋণে নির্মাণ হলেও দেশে চীনা ঋণে বাস্তবায়িত অন্যান্য প্রকল্পের মতো দাশেরকান্দি প্রকল্পটি থেকেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না। সংযোগ লাইন নির্মাণ না হওয়ায় এর আওতাভুক্ত এলাকার সিংহভাগেরই পয়োবর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব হচ্ছে না।
ঢাকা ওয়াসা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম পয়োবর্জ্য পরিশোধনাগারটি আওতাভুক্ত এলাকার মাত্র ২৫ শতাংশের বর্জ্য পরিশোধন করতে পারছে। সে অনুযায়ী, লক্ষ্যমাত্রার অধীন ৭৫ শতাংশ এলাকার পয়োবর্জ্য পরিশোধনে কোনো কাজেই আসছে না এটি।
রাজধানীর পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে ২০১৩ সালে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে ঢাকা ওয়াসা। এ মহাপরিকল্পনায় ঢাকার আশপাশের নদ-নদীগুলোর দূষণ রোধে পাঁচটি পয়োবর্জ্য পরিশোধনাগার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে হাতিরঝিল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে আফতাবনগরের কাছে দাশেরকান্দিতে পরিশোধনাগার প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। ঢাকা ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পটিতে চীনা এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ। সরকারের ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। আর ঢাকা ওয়াসার ব্যয় ১০ কোটি। পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ প্রকল্পটির ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০ বছর। প্রকল্পের সুদহার ২ শতাংশ। ২০২৭ সালে এ ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে।
দেশের প্রথম আধুনিক সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (এসটিপি) দাশেরকান্দি। আশপাশের মোট ৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকার বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে এটির। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা ডিওএইচএস, বসুন্ধরা, বাড্ডা, ভাটারা, বনশ্রী, কুড়িল, সংসদ ভবন এলাকা, শুক্রাবাদ, ফার্মগেট, তেজগাঁও, আফতাবনগর, নিকেতন, সাঁতারকুল ও হাতিরঝিল এলাকার সৃষ্ট পয়োবর্জ্য পরিশোধন করে বালু নদে নিষ্কাশনের মাধ্যমে পানি ও পরিবেশ দূষণ রোধের লক্ষ্যে প্লান্টটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে ২০ বর্গকিলোমিটারেরও কম এলাকার বর্জ্য পরিশোধন হচ্ছে প্লান্টটির মাধ্যমে। আওতাভুক্ত এলাকাগুলোর পয়োবর্জ্য দাশেরকান্দি পর্যন্ত নেয়ার মতো সংযোগ লাইন নির্মাণ না করায় ৭৫ শতাংশেরও বেশি এলাকার বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমানও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দাশেরকান্দি প্লান্টের জন্য পৃথক কোনো সংযোগ লাইন নেই। এটাকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করার জন্য সংযোগ লাইন নির্মাণের বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। আর পয়ঃসংযোগ না করেই এত বিপুল বিনিয়োগের প্লান্ট নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। আমরা পুরো প্রকল্পটিই রিভিউ করছি। এখানে কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে সেটা কীভাবে পূরণ করা যায় তা বের করছি।’
ওয়াসার দাবি অনুযায়ী, বর্তমানে কেবল হাতিরঝিলের দুই পাশের এলাকাগুলো থেকে বর্জ্য যাচ্ছে দাশেরকান্দিতে। মগবাজার, ইস্কাটন, নয়াটোলা, মৌচাক, মহানগর হাউজিং, কলাবাগান, ধানমন্ডির একাংশ, তেঁজগাও ও নাখালপাড়া এলাকার পয়োবর্জ্য এখানে পরিশোধন হচ্ছে।
যদিও নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ওয়াসার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কাগজে-কলমে এসব এলাকার নাম বলা হলেও বাস্তবে আরো কম এলাকার বর্জ্য যাচ্ছে দাশেরকান্দিতে। মূলত দুই দশক আগে মগবাজার ও তেজগাঁওসংলগ্ন এলাকায় নির্মিত সুয়ারেজ লাইনের অল্প কিছু পয়োবর্জ্য যাচ্ছে সেখানে। আবার এ লাইনগুলোও এখন নতুন করে স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
৬২ দশমিক ২ একর জমির ওপর নির্মিত দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের প্রতিদিন ৫০ লাখ টন পয়োবর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এটি উদ্বোধন করা হয়।
ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, মগবাজার ও তেজগাঁওয়ের সংশ্লিষ্ট এলাকার পয়োবর্জ্য পরিশোধনের জন্য প্রতি বছর ব্যয় হচ্ছে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১৭২ কোটি টাকা, যেখানে ব্যয় হয়েছে ১৪০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে প্লান্টটি চালানোর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৯৬ কোটি টাকা। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়েও সক্ষমতার মাত্র ২৫ শতাংশ এলাকার বর্জ্য শোধনের বিষয়টি ওয়াসার অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের পরিণাম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও প্লান্ট-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, সামনের বছর থেকে খরচের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার মতো কমে আসবে। পাশাপাশি ২০৩৫ সালে প্লান্টের সক্ষমতার পুরোটাই ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
বিপুল অর্থ ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পটি বৃহদংশে অকার্যকর হয়ে পড়ার পেছনে অনিয়ম ও বাস্তবায়নে ভুল পদ্ধতিকে দায়ী করছেন স্থপতি ও নগরবিদ ইকবাল হাবিব। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ওয়াসা পয়ঃশোধনাগার করেছে কিন্তু পয়োবর্জ্য যে প্লান্ট পর্যন্ত যাবে সে সংযোগ লাইন করেনি। হাতিরঝিলের আশপাশের কয়েকটি এলাকার পয়োবর্জ্য পরিশোধন হচ্ছে বলে তারা দাবি করছে। কিন্তু সেটিও সঠিক নয়। কারণ প্লান্টটিতে কেবল পয়োবর্জ্যই শোধন করার কথা। কিন্তু সেখানে এখন পয়োবর্জ্যের সঙ্গে ড্রেনের পানি, বৃষ্টির পানি, গৃহস্থালি ব্যবহার্য পানিও যাচ্ছে। এতে দাশেরকান্দি ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। সরকারকে অতিদ্রুত পৃথক পয়োবর্জ্য লাইন নির্মাণ করতে হবে। তাহলেই দাশেরকান্দি পয়ঃপ্লান্টটি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের কাছ থেকে নেয়া বিপুল পরিমাণ ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্প কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ার এটিই প্রথম নজির নয়। গত দেড় দশকে চীনের কাছ থেকে নেয়া ঋণের ভিত্তিতে বেশকিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। প্রকল্পগুলো নেয়ার সময় এগুলোর মুনাফাযোগ্যতা ও উপযোগিতার নানা তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছিল। যদিও বাস্তবায়ন শেষে প্রকল্পগুলো চালু হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র। চালু হওয়ার পর থেকে অধিকাংশ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এগুলোর আয় দিয়ে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ও উঠছে না। যদিও এসব প্রকল্পের সুদসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। চীনা ঋণে নেয়া এসব প্রকল্পের সুদহারও তুলনামূলক বেশি।
এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্পটি হলো পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। প্রকল্পটি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও এর ঋণ পরিশোধ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণের পরিমাণ ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। ইআরডির তথ্য বলছে, ডলারের অংকে প্রকল্পে চীনা ঋণ দাঁড়ায় ২৬৬ কোটি ৭৯ লাখে। ছয় বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ২০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ ঋণের আসল পরিশোধে বাংলাদেশ সময় পাচ্ছে ১৪ বছর। এ হিসাবে বার্ষিক গড় ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। ঋণের সুদহার ২ শতাংশ। সার্ভিস চার্জ আরো দশমিক ২৫ শতাংশ।
পটুয়াখালী জেলার পায়রায় আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ হয়েছে বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে। চালুর পর থেকেই নানামুখী সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে। বিগত সরকারের আমলে প্রকল্পটির ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের বিপাকে পড়ার নজিরও রয়েছে। ডলার সংকটে জ্বালানি সংস্থান বন্ধ হয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অলস বসিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চ্যালেঞ্জগুলোকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে এর অবস্থান। আবার রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্য সংকটের কারণে গভীর সাগরের মাদার ভেসেল থেকে কেন্দ্রটির জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা আনতে হচ্ছে লাইটারেজে করে। এতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ আরো ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, মেগা প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়িত পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল অর্থায়নকারী দেশ চীন। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২৪১ কোটি ডলার। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণ আছে প্রায় ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি।
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে চীন। ইআরডির হিসাবে, ডলারের অংকে এর পরিমাণ ৭০ কোটি ৫৮ লাখ। চুক্তি অনুযায়ী ঋণ পরিশোধে ১৫ বছর সময় পাবে বাংলাদেশ। এ হিসাবে সুদ ব্যতীত বার্ষিক গড় ঋণের পরিমাণ ৪০৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। লাভের বদলে প্রকল্পটিতে প্রতি বছর বিপুল অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, চালুর পর ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে টানেল থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা। বিপরীতে অবকাঠামোটি পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় হচ্ছে বছরে ১৩৬ কোটি টাকার বেশি।
মূলত যথাযথ পরিকল্পনার অভাবেই দাশেরকান্দির মতো চীনা ঋণে নেয়া প্রকল্পগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে দাশেরকান্দির মতো প্রকল্প নেয়ার আগে উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তার জায়গাগুলো ভালোমতো নির্ণয় করে নেয়া প্রয়োজন ছিল বলে অভিমত তাদের।
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজধানীর সুয়ারেজ সংযোগ না দিয়ে এত বিপুল বিনিয়োগে পয়ঃশোধনাগার বানানো ঠিক হয়নি। তবে এখন যেহেতু হয়ে গেছে, এটিকেই কীভাবে টেকসইভাবে ব্যবহার করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। ঢাকার জন্য এ ধরনের অবকাঠামোর প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেটি সঠিক গাইডলাইন মেনে হয়নি। পরেরটি আগে হয়ে গেছে। এখন আগেরটা পরে করতে হবে। আর এজন্য নগরবাসীর ভোগান্তি আরো বাড়বে। তার পরও এখন এটা তো আর ভেঙে ফেলা যাবে না। ওয়াসাকে এখন এর ব্যবহারযোগ্যতা ও পুরো সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নগরবাসীকে স্বস্তি দেয়ার পথ খুঁজতে হবে। আর এজন্য খুব বেশি সময় নেয়া উচিত হবে না।’ উৎস: বণিকবার্তা।
আপনার মতামত লিখুন :