মধ্যপ্রাচ্যে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়বে ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে প্রতিবেশী বাংলাদেশকেও। প্রভাবশালী ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকনোমিকস টাইমসের বুধবার (২ অক্টোবর) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিজস্ব চাহিদার সিংহভাগ জ্বালানি তেল এবং গ্যাস আমদানি করে ভারত।
ইরানের ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জেরে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বুধবার (২ অক্টোবর) পাল্টা হামলার ঘোষণা দেয় ইসরায়েল ও এর ঘনিষ্ঠমিত্র যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ৩ শতাংশ লাফিয়ে উঠে। আরও বেশি সংখ্যক ইসরায়েলি সেনা দক্ষিণ লেবাননে মোতায়েনের ঘোষণা দেয়ার পর চলমান সংঘাত আরও তীব্রতর হয়ে উঠে। সেই সঙ্গে সংঘাত নিরসনের পথ কঠিন হয়ে উঠে।
এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম সর্বোচ্চ ৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি দাঁড়ায় ৭৫ দশমিক ৮২ ডলার। ডব্লিউটিআই ক্রুড-এর দাম ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ বেড়ে হয় ৭২ দশমিক ২২ ডলার। এই দুই ধরনের জ্বালানির দাম শুরুতে ৫ শতাংশ বাড়লেও দিন শেষে তা হয় ২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
এই উচ্চ মূল্য তেল ও গ্যাস আমদানি করলে ভারতের মুদ্রাস্ফীতি আরও তীব্রতর হবে সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়বে। জ্বালানি চাহিদার একটি বড় অংশ রাশিয়া থেকে মেটালেও এখনও ভারতের আমদানি মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর।
আগস্টের হিসাব অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানিকৃত জ্বালানি মোট আমদানির ৪৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর রাশিয়া থেকে আনা হয় ৩৬ শতাংশ।
বাংলাদেশে যেভাবে প্রভাব পড়তে পারে: ভারতে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছানোর পর প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের ডিজেলের দামে বড় ধরনের ফারাক তৈরি হয়। এর ফলে সীমান্ত এলাকায় ডিজেলের চোরাচালান আচমকাই বেড়ে যায়। এমন চিত্র গত দশকে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে।
সম্প্রতি, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ যদিও দাবি করে ডিজেল পাচারের ঘটনা এখনও ততটা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন কিন্তু এই চোরাচালানের ফলে এর মধ্যেই বিপুল রাজস্ব হারাতে শুরু করেছে - এবং সীমান্ত এলাকার পেট্রোল পাম্পগুলোতে তারা মনিটরিংও শুরু করেছে। ভারতেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারত যতদিন না জ্বালানি তেলে শুল্ক ও করের পরিমাণ কমাবে ততদিন এই পাচারের সমস্যা থেকেই যাবে।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি মাসে বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ করে সরকার। তারপরও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দামের বিশাল ব্যবধান থেকে যায়। গত মাসের হিসেবে ভারতের কলকাতা ও বাংলাদেশের মধ্যে ডিজেল-পেট্রল লিটারপ্রতি পার্থক্য ২২ থেকে ২৫ টাকা। দামের এই বিশাল পার্থক্যের কারণেই বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা জ্বালানি তেল অবাধে পাচার হয় ভারতে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে, দুই দেশের দামের পার্থক্য পাঁচ টাকার মধ্যে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতে ডিজেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। এমন পরিস্থিতিতে চোরাচালান বাড়াটাই স্বাভাবিক। তাই দুই দেশের মধ্যে তেলের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। এতে তেল পাচারের ঝুঁকিও কমবে।
এদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধাবস্থার কারণে সুদূর বাংলাদেশেও জ্বালানি নিরাপত্তা ভেস্তে যেতে পারে। সেইসঙ্গে ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে, এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) সমকালে প্রকাশিত তার বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ 'ঝুঁকি বাড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে' তিনি এমন শঙ্কার কথা তুলে ধরেন। এর কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, বাংলাদেশ তার মোট চাহিদার সিংহভাগ জ্বালানি তেল মধ্যপ্রাচ্য থেকেই সংগ্রহ করে থাকে। যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান থাকায় তেলবাহী জাহাজগুলো সহজেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এতে তেল পরিবহনে দেশগুলোকে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হবে। ফলে তেল আমদানির খরচ বেড়ে যাবে। আর দীর্ঘ সময় ধরে এ যুদ্ধ চললে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এছাড়া যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে এবং ওই অঞ্চলের বাকিরা এতে যোগ দিলে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে। এমনিতেই ইয়েমেনের হুতিরা ভূমধ্যসাগর দিয়ে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ওপর প্রায়ই আক্রমণ করে থাকে। এখন তারাও এ যুদ্ধে যোগ দিতে পারে। নতুন করে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারে প্রভাব পড়বে। কারণ বাংলাদেশের রপ্তানির বড় বাজার হচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়া। আর পণ্য পরিবহনের পথ হচ্ছে ভূমধ্যসাগর। এ কারণে রপ্তানি খরচ বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে আমদানি খরচেও প্রভাব পড়বে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য সংকট যদি বিস্তৃত ও দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে অর্থনীতিতে।
মধ্যপ্রাচ্যের এ যুদ্ধ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে এবং দীর্ঘায়িত না হয়, তা নিয়ে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বিশ্ব নেতারা। উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। যুদ্ধ যাতে না ছড়িয়ে পড়ে এর জন্য পশ্চিমারা উদ্যোগী হচ্ছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রীও জি৭ বৈঠক ডাকার কথা বলেছেন।
তবে এখন পর্যন্ত হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধ বন্ধে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও তাতে সফলতা আসেনি। তবে ইরান এ যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে আঞ্চলিক যুদ্ধের একটা আশঙ্কা বেড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আশা করা হচ্ছে, বিশ্বনেতারা এমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবেন যাতে যুদ্ধ ছড়িয়ে না পড়ে। উৎস: চ্যানেল২৪
আপনার মতামত লিখুন :