সরকারের ব্যাংকঋণ অর্থবছরের শুরুতে কম থাকলেও ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস না যেতেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি নিট ঋণ নিয়েছে সরকার। আগামী তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) সরকারের ব্যাংকঋণ নেওয়ার গতি আরও বাড়বে। এ সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার।
এই ঋণের সিংহভাগই স্বল্পমেয়াদি, যার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ত্রৈমাসিক অকশন ক্যালেন্ডার থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ওই অকশন ক্যালেন্ডার চিঠি আকারে ব্যাংকগুলোর কাছে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার সঞ্চয়পত্র থেকেও তেমন ঋণ পাচ্ছে না সরকার। রাজস্ব আদায়েও গতি নেই। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে।
এর অংশ হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ থেকে এই তিন মাসের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের অকশনের তারিখ ও ঋণের পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে। তবে আলোচ্য তিন মাসে আগে নেওয়া ঋণের একটা বড় অংশ মেয়াদপূর্তিতে পরিশোধও হবে। ফলে সমন্বয়ের পর নিট ব্যাংকঋণের পরিমাণ কমে অর্ধেকের নিচে নেমে আসবে।
চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। সরকারের অকশন ক্যালেন্ডারের তথ্য বলছে, আগামী তিন মাসে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের অকশন করে সরকার মোট ব্যাংকঋণ নেবে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৩৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
বাজেটে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের লক্ষ্য বেশি দেওয়ার পরও সরকার স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি নিচ্ছে। এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হার কম। এ কারণে সুদব্যয় কমাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। তাছাড়া ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট রয়েছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে তহবিল বিনিয়োগ করতে ব্যাংকগুলোরও অনীহা রয়েছে। জানা যায়, বর্তমানে ট্রেজারি বিলের সর্বোচ্চ সুদের হার দাঁড়িয়েছে ১১.৮৯ শতাংশ। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের সুদের হার সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
কোন মাসে কত ঋণ নেবে সরকার: অকশন ক্যালেন্ডারের তথ্য বলছে, অক্টোবর মাসে স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলের চারটি অকশন করে মোট ৩৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেবে সরকার। নভেম্বর মাসেও ৪টি অকশন করে নেওয়া হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর ডিসেম্বর মাসে ৫টি অকশন করে নেওয়া হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই তিন মাসে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বিপরীতে ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি, ১৮২ দিন ট্রেজারি বিলের বিপরীতে ৩২ হাজার ৫০০ কোটি ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বিপরীতে ২৬ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
অন্যদিকে অক্টোবর মাসে ৫টি অকশন করে দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের বিপরীতে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা নেওয়া হবে। পরের মাস নভেম্বরে ৪টি অকশন করে নেওয়া হবে ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বর মাসেও ৪টি অকশন করে নেওয়া হবে ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই তিন মাসে ২ বছর মেয়াদি বন্ডের বিপরীতে ১২ হাজার কোটি, ৩ বছর মেয়াদি বন্ডের বিপরীতে ৯০০ কোটি, ৫ বছর মেয়াদি বন্ডের বিপরীতে ৯ হাজার ৫০০ কোটি, ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের বিপরীতে ৮ হাজার কোটি, ১৫ বছর মেয়াদি বন্ডের বিপরীতে ৪ হাজার কোটি ও ২০ বছর বন্ডের বিপরীতে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার।
প্রথম তিন মাসেও ব্যাংকঋণ ঊর্ধ্বমুখী: বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থবছরের জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। যা চলতি বছর ২৩ সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস ২৩ দিনে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরের ২৩ দিনে নেওয়া হয়েছে ১৭ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। আর গত আগস্টে নেওয়া হয় ২৩ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। আর অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে নেওয়া হয় মাত্র ৫ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাস ২৩ দিনে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। সে হিসেবে এবার ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। তবে একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়নি সরকার। উল্টো আগের নেওয়া ঋণের ৪১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা পরিশোধ দেখিয়েছে। ফলে সরকারের নিট ব্যাংকঋণ ৫৭০ কোটি টাকা ঋণাত্মক রয়েছে।
সাধারণত অর্থবছরের প্রথম জুলাইয়ে সরকার বেশি ঋণ করে থাকে। তবে এবার জুলাই মাসে তুলনামূলক কম ঋণ নেওয়া হয়। মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে ওই মাসে কিছুদিন ব্যাংকও বন্ধ রাখ হয়। ফলে সরকারের ঋণ নেওয়ার নিয়মিত অকশন হয়নি। তবে বরাবরই বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে যতটা সম্ভব কম ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ এতে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। তা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে তারল্য সংকটে ভুগছে অনেক ব্যাংক। এতে উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, যা অর্থনীতির জন্য ভালো নয় বলে মনে করেন তারা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়ায় তারল্যে এক ধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে, তাতে কল মানির রেটও ৮.৫০ শতাংশ থেকে ৯.৫০ শতাংশে উঠছে। রপ্তানি কম হওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদা কম ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, তাই এই প্রভাবটা (সরকারের ঋণ গ্রহণ) সেভাবে বোঝা যায়নি। ব্যাংকগুলো নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ হিসাবে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড বেছে নিচ্ছে। কারণ সরকার টাকা নিলে সেই টাকা নিরাপদ ও সুদের হারও বেশি। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার আগে বেশি ছিল না। কিন্তু গত দেড়-দুই বছরের মধ্যে সুদের হার সর্বোচ্চ হয়েছে।
জানা যায়, গত অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে ১২.৬৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ঢুকেছে। এসবের প্রভাবে অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে। তবে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে।