৩১তম বিসিএস সমবায়ের কর্মকর্তা আবুল খায়ের হিরু। বছর পাঁচেক আগেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের কাছে আবুল খায়ের হিরুর নামটি খুব একটা পরিচিত ছিল না। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই শেয়ারবাজারে রীতিমতো অঘোষিত ‘হিরো’ বনে যান তিনি। শেয়ার কারসাজি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, গড়েছেন প্রভাবশালীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক। বিত্তশালী অনেকের তহবিল তিনি নিজে পরিচালনা করে টাকা বানিয়ে দিয়েছেন। হিরু যে শেয়ারেই হাত দিয়েছেন, সেই শেয়ারের দাম বেড়ে গেছে রাতারাতি। শেয়ার কারসাজি নিয়ে করা তদন্তে আবুল খায়ের হিরুর সম্পৃক্ততার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলেও রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে বড় কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি; নামমাত্র জরিমানা করে দেওয়া হয়েছে দায়মুক্তি।
জানা গেছে, ২০১০ সালে দেশের শেয়ারবাজারে ধসের পর ড. ইব্রাহীম খালেদের সুপারিশে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করে তৎকালীন সরকার। পুনর্গঠিত বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্সের অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন। তিনি প্রায় দশ বছর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু আলোচ্য সময়ে তিনি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেননি। পরে করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শাটডাউনের সময় প্রায় দুই মাস পুঁজিবাজার বন্ধ থাকে। এরপর রুগ্ন শেয়ারবাজার পুনরুদ্ধারে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তিনি দায়িত্ব নিয়েই দরকারি সব সংস্কার ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিলে সাময়িকভাবে শেয়ারদরের কিছুটা উত্থান হয়। ঢাকা এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০০ শতাংশের বেশি বেড়ে ৭ হাজার ৩০০ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা এক সময় পরিষ্কার হয়ে যান যে, ছোট মূলধন সীমার খাতগুলোর অস্বাভাবিক উত্থানের পেছনে কাজ করছে শিবলীরই সমর্থিত একটি চক্র, তখনই উত্থান থেমে যায়। ওই সময়ে বাজারে সক্রিয় থাকা বিনিয়োগকারীদের অন্য জোটগুলোও দেখে যে, শিবলী শুধু তার ঘনিষ্ঠ চক্রগুলোকেই নানান সুবিধা ও ছাড় দেন। অর্থাৎ শিবলী নিজেই শেয়ারবাজারে জুয়াড়ি তৈরি করছেন এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দিচ্ছেন। ফলে যারা এর বাইরে ছিলেন তাদের বাজার প্রভাবিত করার ক্ষমতা একেবারেই কমে যায়। এ সময় আলাদিনের প্রদীপ নিয়ে হাজির হন পুঁজিবাজারের আলোচিত বিনিয়োগকারী হিরু ও তার সহযোগীরা। তারা পুঁজিবাজার থেকে কারসাজির মাধ্যমে বিশাল অংকের টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তা হিরুর কাছে অনেক প্রভাবশালীর পোর্টফোলিও ‘ম্যানেজের’ দায়িত্বও ছিল।
জানা গেছে, হিরু শেয়ার ব্যবসায় আসেন ২০০৬ সালে। তবে ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দিয়ে কারসাজিতে তার হাতেখড়ি। আর ‘হিরো’ হয়েছেন মূলত ২০২০ সালের জুলাই থেকে একের পর এক বীমা কোম্পানির দর আকাশচুম্বী করে। কারসাজি করেই ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ১০৬ কোটি টাকা রিয়েলাইজড গেইন করেন তিনি।
সেই সময় এক দফায় বীমা খাতের, বিশেষ করে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরে উল্লম্ফন ঘটে। সেবারই প্রথম একজন বড় বিনিয়োগকারী হিসেবে তার নাম সামনে আসে। এর পর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যে শেয়ারেই তিনি হাত দিয়েছেন, সেটিরই দাম বেড়েছে।
জানা গেছে, বেশকিছু কারসাজির ঘটনায় হিরু ও তার সহযোগীদের জরিমানা করা হলেও তারা বাজার থেকে এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ তুলে নিয়েছেন। আবার অন্যান্য ক্ষেত্রে একক ব্যক্তির বিরুদ্ধে জরিমানা আদেশ দেওয়া হলেও হিরুর ক্ষেত্রে এককভাবে জরিমানার আদেশ দেওয়া হয়নি। বরং সম্মিলিতভাবে জরিমানা করা হয়। সরকারি চাকরিজীবী হিরুর যাতে চাকরির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্যই এভাবে জরিমানা করা হয় বলে অভিযোগ। এমনকি তার সঙ্গে বিএসইসির শীর্ষকর্তাদের দহরম-মহরমও ভালো চোখে দেখেননি বাজারসংশ্লিষ্টরা।
হিরু নিজের পাশাপাশি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকেও তার কারসাজির অংশীদার করেন। হিরু ও সাকিবের প্রতিষ্ঠান মোনার্ক হোল্ডিংসকে ব্রোকারেজ লাইসেন্স দেয় বিএসইসি। এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আরেক বিতর্কিত বিনিয়োগকারী জাভেদ এ মতিন। তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। এমনকি মিলিয়ন ডলার জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত একটি ব্যাংক হিসাব থেকে শিবলী রুবাইয়াতের কাছে অর্থ এসেছে বলে অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের (ওসিসিআরপি) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জাভেদ মতিনের নাম পাওয়া গেছে এবং তিনি শিবলী রুবাইয়াতের বন্ধু বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
মতিন-হিরু ছাড়াও পুঁজিবাজারের একশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারী শিবলী কমিশনের প্রশ্রয়ের কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে বড় অংকের অর্থ হাতিয়েছেন।
জানা গেছে, ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে শেয়ারাজারে কারসাজির ১৭টি ঘটনায় ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ২০ কোটি ৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে ১১টি ঘটনাই হিরু সিন্ডিকেটের। ২০২২ সালের ২৯ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার লেনদেনসংক্রান্ত একটি অনুসন্ধান পরিচালনা করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বৃদ্ধি পায় ৬১ শতাংশ। শেয়ার লেনদেন থেকে আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীদের রিয়ালাইজড গেইন ৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। আর আন-রিয়ালাইজড গেইন ১২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। আবুল খায়ের হিরুর রিয়ালাইজড গেইন ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা আর আন-রিয়ালাইডজ গেইন ২ কোটি ৩ লাখ টাকা। হিরুর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানের বিও হিসাব থেকে লেনদেন হওয়া শেয়ারে রিয়ালাইজড গেইন না থাকলেও আন-রিয়ালাইডজ গেইন ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতবরের বিও হিসাব থেকে লেনদেন হওয়া শেয়ারের রিয়ালাইজড গেইন ৪ কোটি ১১ লাখ টাকা আর আন-রিয়ালাইজড গেইন ১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ডিআইটি কো-অপারেটিভ লিমিডেটের রিয়ালাইজড গেইন ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা আর আন-রিয়ালাইজড গেইন ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
আর কনিকা আফরোজের আন-রিয়ালাইডজ গেইন ৩ কোটি ৯ লাখ টাকা। মোহাম্মদ বাসেরের আন-রিয়ালাইজড গেইন ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ডিএসইর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবুল খায়ের ও তার সহযোগী এবং পরিবারের সদস্যদের রিয়ালাইজড গেইন প্রায় ১৩ কোটি টাকা। আর আন-রিয়ালাইজড গেইন প্রায় ২৫ কোটি টাকা।
তবে কমিশন আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীদের জরিমানা করেছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অন্যদিকে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির কারণে আবুল খায়ের হিরুর পিতা আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের জরিমানা করেছে ৩ কোটি টাকা। ডিএসইর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবুল খায়ের মাতবর ও তার সহযোগীদের রিয়ালাইজড গেইন ১৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা আর আন-রিয়ালাইডজ গেইন ১৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
বিডিকমের শেয়ার কেনাবেচা থেকে ডিআইটি কো-অপারেটিভ ও তার সহযোগীদের জরিমানা করা হয়েছে ৫৫ লাখ টাকা। ডিআইটি কো-অপারেটিভ ও তার সহযোগীদের রিয়ালাইজড গেইন ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং আন-রিয়ালাইজড গেইন ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
আবুল খায়ের ও সাদিয়া হাসানের রিয়ালাইজড গেইন ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা আর আনরিয়ালাইজড গেইন ১ কোটি ৫৬ কোটি টাকা। শুধু ডিআইটি কো-অপারেটিভের রিয়ালাইজড গেইন ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা আর আন-রিয়ালাইজড গেইন ২০ লাখ টাকা।
আবুল কালাম মাতবরের আনরিয়ালাইজড গেইন ৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা আর মোনার্ক হোল্ডিংসের আন-রিয়ালাইজড গেইন ৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
ডিএসইর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবুল খায়ের হিরু এবং তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানের গেইন (রিয়ালাইজড ও আন-রিয়ালাইজড) ৩ কোটি ৭ লাখ টাকা ডিআইটি কো-অপারেটিভের গেইন ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, আবুল কালাম মাতবরের গেইন ৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা এবং মোনার্ক হোল্ডিংসের গেইন ৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
ফরচুন সুজের শেয়ার কারসাজিতে আবুল কালাম মাতবর ও তার সহযোগীদের জরিমানা করা হয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যদিও শেয়ার কারসাজি থেকে আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীদের রিয়ালাইজড গেইন ৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা আর আনরিয়ালাইজড গেইন ২৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এনআরবিসির শেয়ার কারসাজিতে কনিকা আফরোজ ও তার সহযোগীদের ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ব্যাংকটির শেয়ার কারসাজিতে আবুল খায়ের ও তার সহযোগীদের রিয়ালাইজড গেইন ১৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আর আনরিয়ালাইজড গেইন ২৩ কোটি ৩৩ কোটি টাকা।
গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে কাজী সাদিয়া হাসান ও তার সহযোগীদের জরিমানা করা হয়েছে ৪২ লাখ টাকা। যদিও এই শেয়ার কারসাজি থেকে রিয়ালাইজড গেইন ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা এবং আনরিয়ালাইজড গেইন ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ঢাকা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতেও ছিলেন আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীরা।
এই কারসাজির কারণে কাজী সাদিয়া হাসান ও তার সহযোগীদের জরিমানা করা হয়েছে ৯৫ লাখ টাকা। যদিও সাদিয়া হাসান ও তার সহযোগীদের রিয়ালাইজড গেইন ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আর আনরিয়ালাইজড গেইন ৯৫ লাখ টাকা।
এহেন বিস্তর অভিযোগের বিষয়ে আবুল খায়ের হিরুর বক্তব্য জানতে তার সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, যারা পুঁজিবাজারে অনিয়ম করেছে, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে কারসাজির মাধ্যমে বাজারকে পূর্বের মতো পরিস্থিতিতে যেন কেউ ফেলতে না পারে, সে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। সূত্র : দৈনিক আমাদের সময়
আপনার মতামত লিখুন :