শিরোনাম
◈ ভারতে শেখ হাসিনার ৭ মাস, যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে জনগণ ◈ যে কারণে সামরিক ফ্লাইট স্থগিত করল ট্রাম্প প্রশাসন ◈ গত কয়েক দিন ধরে বেড়েছে অগ্নিদুর্ঘটনা, যে সতর্কবার্তা দিল সেনাবাহিনী ◈ লন্ডনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের ওপর হামলার চেষ্টা (ভিডিও) ◈ নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২০ দিন করা হচ্ছে: শ্রম উপদেষ্টা ◈ চাঁদপুরে রমজান উপলক্ষে কার্ড ছাড়াই দেয়া হচ্ছে টিসিবির পন্য ◈ অপরাধ বৃদ্ধিতে তরুণদের মনে ক্ষোভ ও বিস্ময়! ◈ সরকারি যানবাহনের চালকরা আইন অমান্য করলেই ব্যবস্থা: গণবিজ্ঞপ্তি ◈ এবার মুশফিককে নিয়ে মাশরাফির আবেগঘন পোস্ট ◈ টাকা আদায়ে ড. ইউনূসকে চিঠি দেবেন আফ্রিদি, যা বললেন বিসিবিপ্রধান

প্রকাশিত : ০৬ মার্চ, ২০২৫, ১২:০০ রাত
আপডেট : ০৬ মার্চ, ২০২৫, ০৩:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : মনজুর এ আজিজ

প্রতিদিন চুরি হচ্ছে ৩২৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস!

মনজুর এ আজিজ : চাহিদা অনুযায়ী প্রতিনিয়ত গ্যাস দিতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রেট্রোবাংলাসহ সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানিগুলো। তবে এর মধ্যেও থেমে নেই গ্যাস চুরি। এক হিসেবে দেখা গেছে প্রতিদিন অন্তত ৩২৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চুরি হচ্ছে। অনুপাতের দিকে থেকে চুরির শীর্ষে রয়েছে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। আর পরিমাণের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করা হয়েছে ১৭০০ মিলিয়ন ঘনমিটার (১৯ কার্গো)। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্য বলছে, একই সময়ে সিস্টেম লস হয়েছে ১৯৮৫ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস। অর্থাৎ স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানি করা গ্যাসের চেয়েও বেশি অপচয় হয়েছে।

পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা ১৯ কার্গো এলএনজির দাম পড়েছে ১০৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ চুরি ঠেকানো গেলে স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি না করলেও প্রকৃত সরবরাহ অপরিবর্তিত থাকার কথা। কিন্তু গ্যাস চুরি কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না, দিন দিন বেড়েই চলছে। যা সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) গ্যাসের সামগ্রিক সিস্টেম লস আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাসের সিস্টেম লস ছিল ৮.৪৩ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে হয়েছে ১৩.৫৩ শতাংশ।

এদিকে সবচেয়ে বৃহৎ বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাসের গত ডিসেম্বর মাসের জোন ভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ভৈরব এরিয়ায় সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস রয়েছে। ডিসেম্বর মাসে ৪০.৭০ শতাংশ গ্যাসই চুরি হয়ে গেছে। ভৈরব জোনে ডিসেম্বর মাসে ৩.৯৮ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ করা হয়, আর প্রকৃত গ্রাহকরা পেয়েছে মাত্র ২.৩৬ মিলিয়ন। ভৈরবের পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লোকসান দিয়েছে কিশোরগঞ্জ জোন। ওই জোনে ২৭ শতাংশ সিস্টেম লস দেখা গেছে।

সূত্র মতে, গ্যাস সঙ্কটে দেশীয় উৎপাদন কমে আসছে, অন্যদিকে বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি সামাল দিকে বেসামাল অবস্থা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের। অনুমোদিত লোডের অর্ধেকের কম সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে বিশাল ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে দিনদিন আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ঘাটতিও বেড়ে যাচ্ছে। পেট্রোবাংলা তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরে (২০২৫ সালে) ১৬ থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। যে কারণে প্রবল আপত্তির মুখে নতুন শিল্পের জন্য ১৫২ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই প্রস্তাবের উপর ২৬ ফেব্রুয়ারি শুনানি গ্রহণ করেছে বিইআরসি।

শুনানিতে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ পেট্রোবাংলা, বিইআরসি ও বিতরণ কোম্পানিগুলোকে তুলোধুনো করে। তারা সকলেই চুরি ঠেকানোর পরামর্শ দেন। তারা বলেন, চুরি ঠেকানো গেলে বিশাল রাজস্ব বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না।

সম্প্রতি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির অবৈধ উচ্ছেদ অভিযানে গতি দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিনই অভিযানের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, আমরা সিস্টেম লস কমিয়ে আনার জন্য রোডম্যাপ তৈরি করেছি। প্রত্যেক মাসে দশমিক ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে কমিয়ে আনবো। ডিসেম্বরে লস ১০ থাকলে ফেব্রুয়ারিতে ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য কাজ চলছে।

কিছু লিকেজ জনিত সিস্টেম লস রয়েছে। সেগুলো মেরামত করার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। মিটার টেম্পারিং পাওয়া যাচ্ছে, সেই অভিযানও জোরদার করা হয়েছে। প্রতি দিনেই আপনারা দেখতে পাচ্ছেন অভিযান। এখানে কোন রকম ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল ২০২২ গণশুনানিতে বলেছিলেন, গ্যাসের আদর্শ সিস্টেম লস ২ শতাংশের নিচে। বিশ্বের কোথাও ২ শতাংশের উপরে সিস্টেম লস নেই। ওই সময়ে থাকা সাড়ে ৮ শতাংশ সিস্টেম লস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই মাত্রা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।
বিইআরসি সামগ্রিক সিস্টেম লস ১.১২ শতাংশ নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয় তখন। এর পরের বছর সিস্টেম লস কিছুটা কমলেও আবার বেড়ে সামগ্রিক সিস্টেম লস হয়েছে ১৩.৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ ১২ শতাংশ গ্যাস চুরিকে সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বর্তমানে দৈনিক কমবেশি ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে পাইপলাইনে। সে হিসেবে দৈনিক ৩২৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চুরি হয়ে যাচ্ছে লাইন থেকে। অন্যদিকে স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানি করা ১ কার্গো এলএনজির (৩ হাজার মিলিয়ন) বর্তমান দাম পড়ছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।

গ্যাস চুরির অন্যতম দিকটি হচ্ছে- আবাসিকের মিটার বিহীন ৩০ লাখ গ্রাহক। মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকের নির্ধারিত পরিমাণ গ্যাসের বিল আদায় করা হয়। গ্রাহক ব্যবহার করুক, না করুক অথবা বেশি ব্যবহার করলেও নির্ধারিত বিলেই তাকে দিতে হয়। প্রিপেইড গ্রাহকের ব্যবহারের পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে আব্দুল জলিল কমিশন ২০২২ সালের ৫ জুন দেওয়া আদেশে এক চুলা ৭৩.৪১ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৭৭.৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করে দেয়।

সম্প্রতি গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় দিনের অনেক সময় গ্যাস পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। অনেকে ইলেকট্রিক হিটার, কেউ এলপিজি, আবার কেউ কেউ হোটেল থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন। এতে মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকদের প্রকৃত ব্যবহার ৩০ ঘনমিটারের নিচে নেমে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই হিসাব যোগ করলে সিস্টেম লসের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে তৎকালীন বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই এলাহী চৌধুরী বলেছেন, এখানেতো রকেট সায়েন্স ঘাটার দরকার হয় না। পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি যদি সিস্টেম গেইন করে, সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানিসহ অন্যান্য কোম্পানির যদি লোকসান না থাকে তাহলে তিতাস, বাখরাবাদ ও কর্ণফুলীর লস কেনো হবে। নিশ্চয় কোথাও সমস্যা রয়েছে তাদের। সে কারণে সিস্টেম লস কমিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিইআরসি সদস্য (গ্যাস) মিজানুর রহমান বলেন, সিস্টেম লস কেনো কমছে না সে বিষয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিইআরসি। এদিকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় গ্যাস চুরি ঠেকাতে ব্যর্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি ফৌজদারী মামলা দায়ের এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে রিপোর্ট করার নির্দেশনা দিয়েছেন।

সচিব নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জোনভিত্তিক দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। তারা মিটার অনুযায়ী গ্যাস বুঝিয়ে দেবে। জোন ভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ ও সিস্টেম লস কমাতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বার্ষিক বোনাস বন্ধ করা হবে। আর যারা সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়