ঢাকা-রাজশাহী রুটে মধ্যরাতে ডাকাতির শিকার হওয়া বাসটি প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে ডাকাতদের দখলে ছিল। এ সময় নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ করেন বাসটিতে থাকা যাত্রীরা।
এই ঘটনায় যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে নাটোর পুলিশ ওই বাসের চালক, চালকের সহকারী ও সুপারভাইজারকে আটক করে আদালতে সোপর্দ করেছে। সেখান থেকে তারা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।
গত সোমবার (১৭ই ফেব্রুয়ারি) রাতে যেসব যাত্রী বাসটিতে ছিলেন, তাদের মধ্যে দুইজনের সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। তারা অভিযোগ করছেন, বাসটিতে অন্তত একজনকে ধর্ষণ করা হয়েছে সেই রাতে।
বাসটি যেহেতু চলমান অবস্থায় ছিল, তাই এই ঘটনায় একাধিক স্থানের নাম উঠে আসছে। সেগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো, নাটোরের বড়াইগ্রাম ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানা।
ওই দুই থানার পুলিশেরই ভাষ্য– সেই রাতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এমন তথ্য তারা জানে না। তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কোনও মামলা করা হয়নি।
যাত্রীদের বর্ণনায় সেই রাত
২২ বছর বয়সী সোহাগ হাসান পেশায় ব্যবসায়ী। তার বাড়ি বড়াইগ্রামেই। ব্যবসার কাজে এই গ্রামেরই ওমর আলী এবং তিনি একসাথে ঢাকায় গিয়েছিলেন।
সেদিন কাজ শেষ করতে দেরি হয়ে গেলে তাড়াহুড়ো করে তারা ওই বাসেই উঠে পড়েন।
তিনি বলছিলেন, গাড়ি যাত্রী বোঝাই থাকলেও গাড়ির চালক ও তার সহযোগীরা আরও সাত-আটজনকে মাঝপথে গাড়িতে তুলে এবং তারপর গাড়ির চালকের আসনে তাদেরই একজন বসে পড়ে।
ওই দলের বাকিরা তখন যাত্রীদের কাছে চলে আসে এবং গলায় চাকু ধরে। তারা বাসের আলো জ্বালাতে নিষেধ করেছিলো, বলছিলেন তিনি।
"আর সবচেয়ে বড় কথা, সবার সামনে ওরা চাকু নিয়ে দাঁড়ায়ে ছিল। পাঁচ-ছয়জনকে ছুরিও মারে ওরা। এই ভয়ে কেউ কোনও কথা বলেনি। সবার মাথা নিচু করে ছিল। ওরা বলছিলো, চোখ বন্ধ কইরা থাকবি। তাকাইলে কানা করে দিবো," তিনি যোগ করেন।
সোহাগ হাসান ও ওমর আলীর কাছে এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা ছিল। ডাকাতরা চাইলে তারা শুরুতে ২০ হাজার টাকা দেয়। কিন্তু গাড়ির চালক-সহযোগীরা ডাকাতদেরকে "দেখিয়ে দেয়" যে তাদের কাছে আরও টাকা আছে, দাবি মি. হাসানের।
"আমি টাকা দিতে চাইনি বলে ওরা আমায় নিচে ফেলে আমার বুকের ওপর পাড়া দিয়ে রাখছে, টাকা না দেওয়া পর্যন্ত। আর ওরা বাস থেকে না নামা পর্যন্ত আমায় নিচেই রাখছে।"
এসময় তারা কথা বলতে পারছিলেন না, মাথা উঁচু করতে পারছিলেন না, চোখ খুলতে পারছিলেন না। শুধুই বাসের দুই নারী যাত্রীর চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ শুনছিলেন।
"ওই দুইজনের সিট ছিল বাসের মাঝামাঝি। তাদের মাঝে একজন হিন্দু, তার সাথে তার স্বামীও ছিলেন," বলছিলেন মি. হাসান।
ডাকাতরা প্রথমে ওই নারীর কাছে যা যা ছিল, সব নিয়ে নেয়।
"এরপর চিকন করে একজন ছেলে আমাদের সামনেই ওই মহিলাকে টানতে টানতে জোর করে পেছনের সিটে নিয়ে চলে যায়। ওর স্বামী বাধা দিতে গেলে স্বামীকে অনেক মারধর করে," বলেন সোহাগ হাসান।
"এরা যে পরিমাণ... উনি ধর্ষণেরও শিকার হয়েছে। পিছে নিয়ে গেলে উনি অনেক চিৎকার করছিলো। ওদিকে আমাদের যেতে দিচ্ছিলো না। আমরা শুধু চিৎকারের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। জোরে জোরে কাঁদতেছিলো। কিন্তু ওখানে আমাদের কিছুই করার ছিল না।"
একটু থেমে তিনি আরও বলেন, "ধর্ষণ না করলে কেউ এ্ররকম চিৎকার করবে না।"
গুড় ব্যবসায়ী ৭৩ বছর বয়সী মজনু আকন্দও সেদিন ওই বাসে ছিলেন। তিনিও বলেন, "ওই রাতে আমরা যে চিল্লাচিল্লি শুনছি... তাতে মা-বোনের ইজ্জতের...গাড়ির ভেতরে আমাদের কোনও ভাষা ছিল না। ওনাদের মানসম্মানের ক্ষতি করছে, ধস্তাধস্তি করছে।"
তিনিও বলছিলেন যে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন দুইজন নারী। একজনের বয়স ছিল আনুমানিক ২০ বছর, আরেকজনের ২৫-৩০ বছর।
ওই দুই নারী থানায় "ধর্ষণের অভিযোগ করছে কি না জানি না" উল্লেখ করে তিনি বলেন, "গাড়ির মাঝে দুইজন যে নির্যাতিত হইছে, সেটা আমরা জানি।"
দ্বিতীয় যে নারীর কথা বলা হচ্ছে, তার বিষয়ে সোহাগ হাসান বলেন, "আরেকজন মহিলা, ২৫-৩০ বছর বয়স হবে। ওনার সবকিছুই নিয়ে নিছে। উনি আমাদের দুই সিট সামনে ছিল। আমাদের তাকাইতে দিচ্ছিলো না। ওনার গায়ের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিচ্ছিলো। আমরা যখন বারবার প্রতিবাদ করতে যাচ্ছি, তখন আমাদের মারতে চেষ্টা করে...পেছনে শুধু হিন্দু মেয়েটাকেই নিয়ে যায়। আর ওনার সাথে সিটের ওখানে বসেই জোরজবরদস্তি করে।"
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
পুলিশ এবং ইউনিক রোড রয়েলস পরিবহনের সেই বাসের যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি আনুমানিক রাত সাড়ে ১১টায় বাসটিস গাবতলী থেকে ঢাকা ছেড়ে আসে।
ছাড়ার সময় বাসটি যাত্রীতে ভরপুর ছিল। ওইদিন যারা ওই বাসে ভ্রমণ করেছিলেন, তাদের দুইজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, সেদিন বাসে ৬০-৬৫ জন যাত্রী ছিল।
অর্থাৎ, সিটের তুলনায় যাত্রীদের সংখ্যা বেশি ছিল। ফলে অনেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
কিন্তু বড়াইগ্রাম থানার পুলিশ বলছে, বাসটি ৩০-৪০ জন যাত্রী নিয়ে রওনা দিয়েছিলো সেদিন।
বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, "দুইটার দিকে গাজীপুর বা টাঙ্গাইল থেকে গাড়িতে ডাকাত গাড়িতে উঠে। যাত্রীদের কাছ থেকে তারা সব নিয়ে নেয়। পরে ভোর পাঁচটার দিকে কোথাও নেমে যায়, টাঙ্গাইল বা গাজীপুরে।"
ডাকাতরা বাস থেকে নেমে গেলে ১৮ই ফেব্রুয়ারি ভোর ছয়টার দিকে যাত্রীরা মির্জাপুর থানায় গিয়ে মৌখিক অভিযোগ করে আড়াইটার দিকে বড়াইগ্রামে আসেন বলেও তিনি জানান।
"যাত্রীরা বাস আটক করে বলে যে ড্রাইভার-হেল্পাররা জড়িত এই ঘটনায়। তাদের যাত্রীদেরকে ওদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পরে আমরা গিয়ে ওদের আটক করি," বলেন তিনি।
এই ঘটনায় তারা মামলা নেয়া হয়নি উল্লেখ করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তারা যাত্রীদেরকে মির্জাপুর বা টাঙ্গাইল বা গাজীপুরে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ ঘটনা সেখানে ঘটেছে।
এদিকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার ওসি মোশাররফ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় বাসটি এলে সাত-আটজনের ডাকাত দল গাড়িতে উঠে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয়। মির্জাপুর সীমানায় এটা ঘটেনি। আর এ ব্যাপারে মির্জাপুর থানায় কেউ অভিযোগ করেনি।"
ডাকাতরা ডাকাতি শেষে নন্দন পার্কের পাশে এসে নেমে যায় বলেও তিনি জানান।
যাত্রীদের কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো যে 'ডাকাতরা' কোথা থেকে উঠেছিলো বাসে। তারা সুনির্দিষ্ট কোনও উত্তর দিতে পারেনি। কারণ তখন অন্ধকারে স্থান বোঝা যাচ্ছিলো না।
তবে যাত্রীদের বর্ণনায়, বাসটি প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা ডাকাতদের দখলে ছিল এবং এই সময়ের মাঝে ডাকাতরা বাসটিকে বারবার ঘুরাতে থাকে। পরে রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে বাস থেকে নেমে যায় ডাকাতরা।
এদিকে যাত্রীরা বলছেন, সেদিন রাতে ওই বাসে অন্তত একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বড়াইগ্রাম ও মির্জাপুর, দুই থানার ওসি-ই বলছেন যে তারা এমন কিছু জানেন না।
বড়াইগ্রামের ওসি সিরাজুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, "ধর্ষণের কোনও বিষয় আমি পাইনি। এরকম কোনও ঘটনা আমায় কেউ বলেনি বা আমি সাক্ষী পাইনি।"
আর মি. ইসলামকে উদ্ধৃত করে মির্জাপুরের ওসির ভাষ্য, "ধর্ষণের বিষয়ে অনেকে বলছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কিছু জানা নাই আমার। বড়াইগ্রামের ওসি বলেছেন, এই ধরনের কিছু ঘটেনি।"
পুলিশের সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায় অমিল
বড়াইগ্রামের পুলিশ যদিও বলছে যে ধর্ষণের বিষয়ে তারা কিছুই জানে না, কেউ কিছু বলেনি।
কিন্তু মজনু আকন্দ ও সোহাগ হাসান, দু'জনেই বলছেন যে ওই নারীরা সবার সাথে বড়াইগ্রামেই নেমেছিলো এবং পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছিলো।
সোহাগ হাসানের ভাষায়, "উনি (হিন্দু নারী) বাস থেকে নামার পর ওনার কান্নাকাটি দেখে আমরা সবাই ভেঙে পড়ি। উনি পুলিশের সামনে মান-সম্মানের পরোয়া না করে যতটুকু বলা যায়, বলছে। থানায় যা বলেছিলো... আর ভেঙে বলার দরকার নাই, আমরা তো কিছুটা বুঝি...।"
"ওই দুই নারী বড়াইগ্রামেই নেমে পুলিশের কাছে মুখে মুখে জবানবন্দি দিয়ে অন্য বাসে করে নিজ নিজ বাসায় চলে গেছে। মেয়ে দুইটা আমার ফোন থেকে বাসায়ও কল দিছিলো। কিন্তু ওইদিন আমার ফোন থেকে ৪০ জনের বেশি কল দিছে," বলছিলেন তিনি।
অনেকে একই দিনে ফোন করায় এবং তার ফোনের ডিসপ্লে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনি নাম্বার দু'টো চিহ্নিত করতে পারছেন না বলেও জানান।
"পুরো বাসে আমার এই একটা ফোন-ই শুধু বাঁচছিলো। আমায় যখন ওরা নিচে ফেলে, ফোনটা আমার পিঠের নিচে পড়ে গেছিল, নিতে পারে নাই তাই।"
পরে ডাকাতরা নেমে যাওয়ার পর তিনি প্রথম তারা মামাকে কল দিয়ে ঘটনা সম্বন্ধে জানান এবং বাসকে বড়াইগ্রাম পর্যন্ত এনে পুলিশে ধরিয়ে দেন, এমনটা বলছিলেন মি. হাসান।
এদিকে স্থানীয় সাংবাদিক হালিম খান যাত্রীদের বরাতে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "যাত্রীরা বলছে যে দুইজন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নারী যাত্রী যারা ছিল, সবাই শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে। যেভাবে যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো হয়, তা হয়েছে। এটা বলা যায়।"
"কিন্তু ধর্ষণের ব্যাপারে তারা বলছে যে পেছনের দিকে দু'জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়... ওই নারীদেরকে তো পাওয়া যায়নি। হয়তো তারা পথে নেমে গিয়েছে। এটার তো ডকুমেন্টারি কিছু নাই। তবে শ্লীলতাহানি হয়েছে ভয়াবহ। সরাসরি ধর্ষণের কথা বলতে পারছি না, কারণ ভিকটিমও পাওয়া যায়নি। পুলিশ রেকর্ডেও তা উল্লেখ নাই," যোগ করেন তিনি।
বাসের চালক, সহযোগী ও সুপারভাইজারকে ৫৪ ধারায় আটক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, "থানায় একটা রেফারেন্স করেছে। কারণ কোনও ভিকটিম যদি মামলা করে, তাহলে এই রেকর্ড সেই মামলার সাপোর্টে কাজ করবে। পুলিশ বলছে, মামলা হবে গাজীপুর বা টাঙ্গাইলে।"
বুধবার সন্ধ্যায় আটককৃতরা জামিন পেয়েছে বলে জানা গেছে।
আপনার মতামত লিখুন :