শিরোনাম

প্রকাশিত : ২৯ জানুয়ারী, ২০২৫, ১২:১২ রাত
আপডেট : ৩০ জানুয়ারী, ২০২৫, ১২:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন ডন!

আমার দেশ প্রতিবেদন: রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিয়ন্ত্রণ পেতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। শুধু ডনদের পরিবর্তন হয়েছে, বাকি সব ঠিকই আছে। আধিপত্য নিতে রক্ত ঝরিয়ে মহড়া দিচ্ছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ। পালিয়ে বিদেশে থেকেও কেউ কেউ ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। আগে যেখানে যোসেফ-হারিছ-মানিক-জিসানরা নিয়ন্ত্রণ করত, এখন সেখানে পিচ্চি হেলাল-ইমন-মুরাদসহ অনেকের নাম যুক্ত হয়েছে।

চাঁদাবাজি, ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ইন্টারনেট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাত-লেগুনা ও বাস টার্মিনালের তোলাবাজি ঠিকই চলছে। কোথাও কোথাও এতদিন যারা আওয়ামী লীগের হয়ে নানা অপকর্ম করত, এখন শুধু আওয়ামী লীগের জায়গায় অন্য কোনো দলের নাম জুড়ে দিচ্ছে। বিনা ভোটের কাউন্সিলরদের জায়গা দখল করেছে অন্য কোনো দলের স্থানীয় পাতিনেতারা।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্ডারওয়ার্ল্ডের যেসব ডন জামিনে ছাড়া পেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেই বেশিরভাগ অভিযোগ আছে।

এদিকে অপরাধ জগতের ডনরা নিজেদের আধিপত্য জিইয়ে রাখতে অবৈধ অস্ত্র-গুলির জোগান দিয়ে নতুন বাহিনী গড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। দলের নতুন সদস্যদের দিয়ে অবাধ্য পুরোনো সহযোগীদের ক্ষমতা কেড়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

নয়া এ মেরুকরণে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় অস্ত্রবাজি ও খুনোখুনি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি ঘটায় সাধারণ মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়েছে।

এসব ব্যাপারে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান আমার দেশকে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ওপরও পুলিশের নজরদারি রয়েছে। আধিপত্য নিয়ে তারা বিরোধে জড়াচ্ছে। নানা অপকর্মে জড়ানোর তথ্য পাচ্ছি। রেকর্ড হচ্ছে, মামলা হচ্ছে। আমরা পেলেই ধরে ফেলব। কাউকে ছাড় দেব না।

আপাতত আমরা তাদের জামিন বাতিলের আবেদন করব। শীর্ষ সন্ত্রাসী হোক বা যে-ই হোক, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। তাদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে জনগণেরও সহযোগিতা দরকার। কেউ যদি কোনো সন্ত্রাসীর নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি বা কোনো অপরাধ করে, তা যেন পুলিশকে জানিয়ে দেওয়া হয়।

ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করত সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের দুই ভাই হারিছ ও যোসেফ। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করে যারা যা কিছু উপার্জন করত, তার ফিফটিন পার্সেন্ট ঘরে বসেই নিয়ে নিত যোসেফ-হারিছ।

এমনকি রাজনৈতিক যেসব সন্ত্রাসী ছিল, তাদের কাছ থেকেও ভাগ নিত এ দুই ভাই। আওয়ামী লীগের পতনের পর যোসেফ-হারিছসহ অনেক ডনই এখন লাপাত্তা। তবে সেই স্থানটি দখল করে নিয়েছে ৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে মুক্ত হওয়া অনেক সন্ত্রাসী।

গত ৫ আগস্টের পর আন্ডারওয়ার্ল্ডের বেশ কজন সন্ত্রাসী জেল থেকে মুক্তি পায়। এর মধ্যে একজন হলো মোহাম্মদপুরের পিচ্চি হেলাল। পিচ্চি হেলাল এখন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুরসহ ঢাকার পশ্চিমের এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে পিচ্চি হেলাল বাহিনী হাত দেয়নি। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে পালিয়েছে। ওসবের প্রতিটি এখন পিচ্চি হেলালের কব্জায়।

জেল থেকে বের হওয়ার পরই বেশ কয়েকটি খুনের সঙ্গে নাম জড়িয়ে পড়ে এই পিচ্চি হেলালের। গত তিন মাসে অন্তত দুই ডজন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করেছে বিদেশে অবস্থান করা এই সন্ত্রাসী কখনো নিজে ফোন করে, আবার কখনো সহযোগীদের পাঠিয়ে চাঁদা দেওয়ার তাগাদা দিচ্ছে; দিচ্ছে হত্যার হুমকি, ফলে আতঙ্কে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

১৬ আগস্ট রাতে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার-৪ থেকে জামিনে মুক্তি পায় শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকার অন্যতম ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল। এছাড়াও ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, তেজগাঁওয়ের শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসুও কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে।

রাজধানীর মিরপুর এলাকার একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গত এক মাসে সন্ত্রাসীদের পৃথক ছয়টি গ্রুপ চাঁদা দাবি করে আসছে। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও মিরপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান মামুনের পরিচয় দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে ২০ লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করা হয়।

পল্লবী থানা বিএনপির ৯১ নম্বর ওয়ার্ড (সাংগঠনিক ওয়ার্ড) কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন এখন মিরপুর এলাকার আতঙ্ক। বিদেশি একটি নম্বর থেকে ব্যবসায়ীদের নিজে ফোন করে চাঁদা দাবি করে সে। আবার কারো কারো কাছে সহযোগীদের পাঠিয়ে চাঁদা দেওয়ার তাগাদা দিচ্ছে। মিরপুর এলাকায় তার কয়েক ডজন সহযোগী রয়েছে। চাঁদার টাকা তুলে তারাই মামুনের কাছে পাঠায়।

২০২০ সালে পল্লবী এলাকার বিএনপির দুই রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার জন্য ভাড়ায় খাটছিল গ্রেপ্তার রফিকুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম ও মোশাররফ হোসেন। তাদের প্রত্যেকেই মামুন-জামিলের অন্যতম ক্যাডার। রিমান্ডে তারা জানিয়েছিল, প্রাণ বাঁচাতে ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিক, কাউন্সিলর, এমনকি মাদক কারবারিরাও তার লোকদের হাতে চাঁদা তুলে দিত। অন্যথায় টার্গেট ব্যক্তিকে খুন করে ফেলত মামুন।

১৯৯৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মামুনের বিরুদ্ধে পল্লবী ও মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা হয়। সন্ত্রাসী মামুন ও তার বাহিনী সর্বশেষ আলোচনায় আসে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পল্লবী-১২ নম্বর সেকশনের বি-ব্লকে ৯/২ নম্বর সড়কের ১৫২/১৬ নম্বর বাড়িটি দখলের মধ্য দিয়ে।

পুলিশ জানায়, ২০০১ সালে কিছুদিন কারাভোগের পর ২০০৪ সালে ভারতে পালিয়ে যায় মামুন। মামুনের আপন বড় ভাই মজিবর রহমান জামিল পলাতক আরেক হেভিওয়েট সন্ত্রাসী। ছোট ভাই মশিউর রহমান মশু ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। তিন ভাই মিলে দীর্ঘদিন ধরে ভারতে অবস্থান করে মিরপুরের আন্ডারওয়ার্ল্ডের বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণের ছক করে। মামুন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় আসে এক রাজনৈতিক নেতাকে কিলিংয়ের মিশন নিয়ে ।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পল্লবীর বাইতুন নুর জামে মসজিদ এলাকা থেকে মামুনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, আটক ব্যক্তি শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন মর্মে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, খুন, মাদক, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও ডাকাতির অভিযোগে পল্লবী থানায় ২৭টি মামলা, ১৫টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও দুটি সাজা পরোয়ানার তথ্য পাওয়া যায়।

কাইল্যা খোকন সবুজবাগ-বাসাবো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। ফিনল্যান্ড থেকে ১০ আগস্ট কাইল্যা খোকন দেশে আসে। এরপর থেকে পুরো এলাকায় তাণ্ডব শুরু করে। খিলগাঁও, পল্লীমা সংসদ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে মাদক সম্রাট মকবুল। কদিন আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি টিম ওই এলাকায় অভিযান চালালেও মকবুলকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

রাজধানীর মগবাজার থেকে শাহজাহানপুর বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে মুরাদ। ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্তি পেয়ে জেল থেকে বের হয়েই এই মুরাদ তার বাহিনীকে সংঘবদ্ধ করে বেপরোয়াভাবে মাঠে নেমেছে। শেল্টার নিয়েছে সাবেক এক কাউন্সিলরের।

সাবেক ওই কাউন্সিলর দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে সম্প্রতি ঢাকায় এসেছে। মুরাদ জেল থেকে বের হয়েই কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের চাঁদা হাতিয়ে নিয়েছে। মতিঝিল এলাকার নিয়ন্ত্রণ যুবলীগের হাত থেকে সাবেক এক কাউন্সিলরের হাতে গেছে। তবে যুবলীগ নেতারা চাঁদার একটি ভাগ নিয়মিত পাচ্ছে। মিল্কী হত্যার আসামি ওই যুবলীগ নেতারা এখনো বহালতবিয়তেই রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়