শিরোনাম
◈ সিলেটকে হারিয়ে বিপিএলের প্লে-অফে খেলার পথে দুর্বার রাজশাহী ◈ গ্যাসের দাম বাড়ালে পোশাক খাতে খরচ বাড়বে ১৮ হাজার কোটি টাকা ◈ পাকিস্তানের মাটিতে ৩৪ বছর পর টেস্ট জয় করলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ◈ কারাগারে সাবেক বিচারপতি মানিকের মৃত্যুর খবর নিয়ে যা জানা গেল ◈ রংপুরের হয়ে খেলতে আসছেন টিম ডেভিড, সুনিল নারাইন ও ডেভিড ওয়ার্নার  ◈ বান্দরবানে সেনাবাহিনীর বিশেষ অভিযানে কেএনএফের দুই সন্ত্রাসী আটক ◈ এবার আল্টিমেটাম দিয়ে নিউমার্কেট থানা ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের ◈ বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের ওপর নির্ভরশীলতা বন্ধ করা উচিত: নিক্কেই এশিয়ায় মতামত প্রতিবেদন ◈ সংস্কার  দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কৌশল পরিবর্তন করতে হবে,তহবিলের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার আহ্বান ◈ টেবিলের নিচ দিয়ে টাকা দেওয়া থেকে বাড়তি ভ্যাট ভালো: অর্থ উপদেষ্টা

প্রকাশিত : ২২ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৯:৫১ রাত
আপডেট : ২৭ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৮:০০ রাত

প্রতিবেদক : মাসুদ আলম

বিদেশে বসে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে মরিয়া পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন

মাসুদ আলম: রাজধানীর মিরপুর এলাকার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গত এক মাসে সন্ত্রাসীদের পৃথক ছয়টি গ্রুপ চাঁদা দাবি করে আসছেন। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও ২৭ মামলার আসামি মিরপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান মামুনের পরিচয় দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে ২০ লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করা হয়। তাদের নির্ধারিত টাকা দেওয়া না হলে ওই প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এতে করে তারা আতঙ্কিত । গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরির্তনের পর স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মিথ্যা মামলায় জেলে থাকা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও ছাড়া পান।

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তারা ফের আন্ডারওয়ার্ল্ডে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। একইসঙ্গে পালিয়ে বিদেশ থাকা সন্ত্রাসীরাও সক্রিয় নড়েচড়ে বসেছেন।বিদেশ থেকে প্রতিনিয়ত ফোনে ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা চেয়ে হুমকি দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে  শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন এখন মিরপুর ও পল্লবী  এলাকার আতঙ্ক। মামুন নিজেকে পল্লবী এলাকার  বিএনপির নেতা পরিচয় দেয়। বিদেশি একটি নম্বর থেকে ব্যবসায়ীদের নিজে ফোন করে চাঁদা দাবি করেন। আবার কারও কারও কাছে সহযোগীদের পাঠিয়ে চাঁদা দেওয়ার তাগাদা দিচ্ছেন। এলাকাবাসী ও ভূক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে মামুনের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে এলাকায় গোপনে সক্রিয় মাসুদ। মূলত ইয়াবা ব্যবসার দেখভাল করছে মাসুদ। ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে তার অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে কিবরিয়া, মাইজ্যা দুলাল, মিরপুর-১২ নম্বরের বালুর মাঠ এলাকার তানিম মোরল, বাঘা মনির ও সাগর ।

লরেন ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। মিরপুর এলাকায় তার অন্তত কয়েক ডজন সহযোগী রয়েছে। চাঁদার টাকা তুলে তারাই মামুনের কাছে পাঠান। ২০২০ সালে পল্লবী এলাকার দুই রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার জন্য ভাড়ায় খাটছিলেন গ্রেফতার রফিকুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম ও মোশাররফ হোসেন। তাদের প্রত্যেকেই মামুন-জামিলের অন্যতম ক্যাডার। রিমান্ডে তারা জানিয়েছিলেন, প্রাণ বাঁচাতে ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিক, কাউন্সিলর, এমনকি মাদককারবারিরও তার লোকদের হাতে চাঁদা তুলে দিতেন। অন্যথায় টার্গেট ব্যক্তিকে খুন করিয়ে ফেলতেন মামুন। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্লবী এলাকার সহকারী কমিশনার শাহিদুল ইসলাম বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে মাঝেমধ্যেই বেনামি নম্বর থেকে বিভিন্নজনের ফোনকল আসে। চাঁদার জন্য কোথাও কোথাও হামলা হয়। তবে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের পর দেখা যায়, তাঁরা খুবই সাধারণ মানুষ। টাকার বিনিময়ে তাঁদের ভাড়া করা হয়েছে।

ছিঁচকে চাঁদাবাজ থেকে যেভাবে উত্থান মামুনের
এক সময়ের ফেনসিডিলের স্বর্গ হিসেবে চিহ্নিত ছিল পল্লবীর ধ-ব্লক ও সাংবাদিক কলোনি এলাকার মাদক সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন মামুন। মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম, সাহাদাত, তাজগীরের রামরাজত্বের মধ্যেই নাটকীয় উত্থান ঘটে মামুনের। ১৯৯৫ সালেও ছিঁচকে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত মামুনের শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার নাটকীয় ঘটনাটি ঘটে ২০০২ সালে। সে সময় পুলিশের হাতে আটক এক মাদককারবারিকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় পল্লবী থানায় সশস্ত্র হামলা চালান মামুন ও তার বাহিনী। প্রায় দুই ঘণ্টা বন্দুকযুদ্ধের পর অস্ত্রসহ ধরা পড়েন মামুন। দুই পক্ষের গোলাগুলিতে আহত হন তার এক সহযোগী ।

বছরখানেক কারাভোগের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতার যোগসাজশে এক দিনে সাতটি মামলায় জামিন নিয়ে ২০০৪ সালে তিনি পাড়ি জমান ভারতে। চাঁদা না পেয়ে ২০০৮ সালে পল্লবীতে নজরুল ইসলাম চৌধুরী মন্টু নামে এক ঝুট ব্যবসায়ীকে খুন করার মামলায় অন্যতম আসামি মামুন । ২০১২ সালে তার বাহিনীর হাতে খুন হন গার্মেন্ট কাপড় ব্যবসায়ী রমজান। এ হত্যা মামলায় মামুনকে প্রধান আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মামুনের বিরুদ্ধে পল্লবী ও মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা হয়। সন্ত্রাসী মামুন ও তার বাহিনী সর্বশেষ আলোচনায় আসেন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পল্লবী-১২ নম্বর সেকশনের বি-ব্লকে ৯/২ নম্বর সড়কের ১৫২/১৬ নম্বর বাড়িটি দখলের মধ্য দিয়ে।

পুলিশ জানায়, ২০০১ সালে কিছুদিন কারাভোগের পর ২০০৪ সালে ভারতে পালিয়ে যান। মামুনের আপন বড় ভাই মজিবর রহমান জামিল পলাতক আরেক হেভিওয়েট সন্ত্রাসী । ছোট ভাই মশিউর রহমান মশু গাজীপুরের সাবেক সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ হত্যা মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। তিন ভাই মিলে দীর্ঘদিন ধরে ভারতে অবস্থান করে মিরপুরের আন্ডারওয়ার্ল্ডের বড় একটা অংশ নিয়ন্ত্রণের ছক করেন। ভারতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে ত্রিপুরায় তখনকার ক্ষমতাসীন দলের এক এমএলএ'র ভাইয়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে গোপনে তার বোনকে বিয়ে করেন। ভারতীয় পরিচয় নিয়ে একটি পাসপোর্ট তৈরি করে নিয়মিত ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও নেপাল ভ্রমণ করেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ওই এমএলএ মামুনকে অবৈধ অনুপ্রবেশসহ আরেকটি অপরাধের সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের জেল থেকে মুক্ত হয়ে পালিয়ে যান নেপাল। সেখানে আশ্রয় নেন ধানমন্ডি-হাজারীবাগ এলাকার পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী লেদার লিটনের কাছে। ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীর পরামর্শেই মামুন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় আসে এক রাজনৈতিক নেতাকে কিলিংয়ের মিশন নিয়ে । কেউ কেউ বলছেন, ওই সন্ত্রাসীর ফাঁদে পা দেওয়াই কাল হয় মামুনের।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সকাল পৌনে ৭টায় রাজধানীর পল্লবীর বাইতুন নুর জামে মসজিদ এলাকা থেকে মামুনকে গ্রেপ্তার করে। রাষ্ট্রবিরোধী একটি সন্ত্রাসী চক্র টার্গেট কিলিং ও ব্যাপক সহিংসতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশে চোরাবাজার থেকে অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছে-এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযানে গিয়ে পল্লবীর বাইতুন নুর জামে মসজিদের পাশের রাস্তা থেকে সন্দেহজনক হিসেবে মফিজুর রহমান মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পুলিশ।

তাকে গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, আটক ব্যক্তি শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন মর্মে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, খুন, মাদক, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও ডাকাতির অভিযোগে পল্লবী থানায় ২৭টি মামলা, ১৫টি গ্রেফতারি পরোয়ানা ও দুটি সাজা পরোয়ানার তথ্য পাওয়া
যায়।

পল্লবী থানায় কাগজপত্র পর্যালোচনা করে জানা যায়, ২০০৫ সালে ৫ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় দায়েরকৃত মামলায় তার ৫ বছরের জেল, ২০০৭ সালের ১০ অক্টোবর পল্লবী থানার দায়েরকৃত মামলায় যাবজ্জীবন এবং পল্লবী থানায় দায়েরকৃত ১৯৯৬ সালের ৬ এপ্রিল দায়েরকৃত মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি মামুন। ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতারের মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় জামিনে মুক্ত হয়ে পালিয়ে ভারতে পাড়ি জমান মামুন।

জানা গেছে, পলাতক থেকেও ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা চালিয়ে আসছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন। রবরব পরিবহনে তার ১০টির মতো বাস চলছে। রয়েছে একাধিক বাড়িও। ব্যবসা ও চাঁদাবাজি থেকে মামুনের মাসে অর্ধকোটি টাকা আয় ছিল বলে সিটিটিসির জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিলেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন চাঁদাবাজির টাকায় দুই সন্তানকে অস্ট্রেলিয়ায় পড়িয়েছেন। তার মেয়ে তাসনিম রহমান ও ছেলে রেদোয়ান আহমেদ দুজনই অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। স্ত্রী রীনাও মাঝে মধ্যেই ঢাকা-অস্ট্রেলিয়া যাতায়াত করেন। তবে রীনা বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। ঢাকার আন্ডারওয়াল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান মামুনকে সহযোগিতা করছেন আহসান উল্লাহ হাসান নামে এক ব্যক্তি। দেশে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছেন মামুন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়