শিরোনাম

প্রকাশিত : ১৭ আগস্ট, ২০২৪, ০১:৩৩ রাত
আপডেট : ২৪ অক্টোবর, ২০২৪, ০৪:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

৭ ব্যাংকে সালমান এফ রহমানের ঋণ ৩৬ হাজার কোটি, কোন ব্যাংকে কত (ভিডিও)

নানা রকমের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি ও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার পাশাপাশি রপ্তানি করে দেশে টাকা না আনার অভিযোগও রয়েছে তার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে। গত ৩১ বছরে শেয়ারবাজারে এমন কোনো বড় কেলেঙ্কারি হয়নি যার সঙ্গে সালমান এফ রহমানের সম্পৃক্ততা নেই। তিনি গত ৩ বছরে দৃশ্যমানভাবেই বাজার থেকে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন। এসব অপরাধ জেনেও চুপ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই এসব ঋণ এখন ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। অধিকাংশ ঋণই খেলাপির ঝুঁকি রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।

জনতা ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ

সালমান এফ রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ বের করেছেন। এই ব্যাংকে বেশিরভাগ ঋণই ছিল তার বেনামি। এতদিন তার নামে জনতা ব্যাংকে থাকা ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা দেখিয়ে আসছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তার ২৯ প্রতিষ্ঠানে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ২১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার ঋণের তথ্য বেরিয়ে আসে। ২০২৩ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটিতে সালমান এফ রহমানের দুই প্রতিষ্ঠানে ২৩ হাজার ৭০ কোটি টাকার ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ২০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। ফান্ডেড ২০ হাজার ২০৮ কোটি এবং নন-ফান্ডেড ৫৪৪ কোটি টাকা। বেক্সিমকো লিমিটেডে ফান্ডেড ১ হাজার ৯৯৪ কোটি ও নন-ফান্ডেড ৩২৪ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, একক গ্রাহককে মূলধনের ২৫ শতাংশের (ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড) বেশি ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই। তবে জনতা ব্যাংক একটি গ্রুপকেই ব্যাংকের মূলধনের ৯৪৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ ঋণ সুবিধা দিয়েছে।

আইএফআইসি থেকেও নামে-বেনামে ঋণ

সালমান এফ রহমান নিজের মালিকানাধীন আইএফআইসি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শ্রীপুর টাউনশিপ প্রতিষ্ঠানের নামে নন-ফান্ডেড ১ হাজার ২০ কোটি টাকা, সানস্টার বিজনেসের নামে ৬১৫ কোটি, ফারেস্ট বিজনেসের নামে ৬১৪ কোটি, কসমস কমোডিটিস লিমিটেডের নামে ৬১২ কোটি, অ্যাপোলো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে ৪৫৫ কোটি, আল্ট্রন ট্রেডিং লিমিটেডের নামে ৪৪৯ কোটি, নর্থস্টোন কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের নামে ৪২১ কোটি, আলফা এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের নামে ৫৬৯ কোটি ও অ্যাবসলিউট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের নামে ৪৬৩ কোটি টাকার ঋণ নেন। এরমধ্যে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বেনামি।

ন্যাশনাল ব্যাংক

বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক থেকেও সালমান এফ রহমান নামে-বেনামে ঋণ বের করে নিয়েছেন। ব্যাংকটি থেকে এসব ঋণ বহু বছর আগের। কোনো অর্থ পরিশোধ না করেই নিয়মিত থেকে যাচ্ছেন। জানা যায়, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ফান্ডেড ৮৩৬ কোটি টাকা, বেক্সিমকো গ্রুপের অনুকূলে ফান্ডেড ৮২৩ কোটি, বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট ১ ও ২ অনুকূলে ফান্ডেড ১ হাজার ২৩৪ ও নন-ফান্ডেড ৫৯ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন।

সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে দীর্ঘদিনের ঋণ

তথ্য অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো লিমিটেডের ফান্ডেড ৬৬৩ কোটি টাকা, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড নিয়েছে ফান্ডেড ৩৭৫ কোটি টাকা এবং বেক্সিমকো কমিউনিকেশন লিমিটেড ফান্ডেড ৩০০ কোটি ও নন-ফান্ডেড ৭১ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। রূপালী ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো লিমিটেডে ৯৬৫ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে পুনর্গঠিত ঋণ ১ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। এসব ঋণ পরিশোধ না করার পরও নিয়মিত রয়েছে। অথচ পুনর্গঠিত ঋণের দুই কিস্তি পরিশোধ না করলেই ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার কথা।

এবি ব্যাংকে রয়েছে চার প্রতিষ্ঠানের ঋণ

এবি ব্যাংকে সালমান এফ রহমানের চার প্রতিষ্ঠান ঋণ রয়েছে। সবগুলো ঋণই পুনর্গঠিত। এ ব্যাংকের ঋণও বছরের পর বছর পরিশোধ করা হয়নি। ঋণগুলো ২০১৫ সালে পুনর্গঠিত করা হয়। বর্তমানে চার প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেডের ১২০ কোটি। একই প্রতিষ্ঠানে আরও ৫৫ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলের ৮৩ কোটি এবং নিউ ঢাক্কা ইন্ডাস্ট্রিজের ৩৪৫ কোটি টাকা। ব্যাংকাররা জানান, যে কোনো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জামানতের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের ক্যাশ ফ্লো বিবেচনায় নেওয়া হয়। মূলত ঋণ কীভাবে ফেরত আসবে বা ঋণ শোধের ম্যাকানিজম হিসেবে ক্যাশ ফ্লো আছে কি না, সেটি দেখা হয়। এরপর ওই ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সহায়ক জামানত নেওয়া হয়। তবে সহায়ক জামানতের বিষয়টি যাদের ‘আমি চিনি না’, তাদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য হয়। আবার বড়দের সবাই ঋণ দিতে এতই আগ্রহী থাকে যে, সহায়ক জামানত চাওয়ার সুযোগও থাকে না। এ ক্ষেত্রে এসব ঋণ ফেরত পাওয়া নিয়েও শঙ্কা বেশি থাকে।

বিধ্বস্ত ডিবেঞ্চার মার্কেট

নব্বইয়ের দশকে সংগৃহীত প্রায় ১০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করায় বাংলাদেশের ঋণপত্র বাজার ধ্বংস করার অভিযোগ এখনো রয়েছে সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে। ডিবেঞ্চার এক ধরনের ঋণ বিন্যাস, যা বৃহৎ কোম্পানিগুলো অর্থ ধার করার জন্য ব্যবহার করে। বেক্সিমকো ১৯৯৪-৯৫ সালে ১০ বছর মেয়াদে চারটি ডিবেঞ্চার ইস্যু করে। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে তাদের মেয়াদ শেষ হলেও ২০২১ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। ওই বছর তিন হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের জন্য সুকুক ইস্যু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বেক্সিমকো। এ অবস্থায় বেক্সিমকোর ঋণখেলাপি ইস্যু সমালোচনার মুখে পড়ে এবং কোম্পানিটিকে পাওনা পরিশোধের নির্দেশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। নির্ধারিত সময়ের ১৫ বছর পর ওই টাকা পরিশোধ করেছে সংস্থাটি।

বন্ড বাজার

সালমানের বেক্সিমকো ২০২১ সালে দেশের সবচেয়ে বড় সুকুক ইস্যু করে, যার মাধ্যমে তিন হাজার কোটি টাকা আয় করে। তবে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা বন্ড বিক্রির জন্য তার রাজনৈতিক সুবিধা ব্যবহার করেছিলেন। কোনো ব্যাংক ও নন-ব্যাংক এই বন্ডে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ছিল না। সালমান তার সুকুকে বিনিয়োগের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের চাপ দেন। তা সত্ত্বেও অনেক ব্যাংক স্বল্প পরিমাণ তহবিল বিনিয়োগ করেছে। তাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে অন্তত দুইবার বিনিয়োগের সময় বাড়াতে হয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে তার সুকুকে বিনিয়োগ করতে পারে, সেজন্য তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা পরিবর্তন করেছেন। পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি তহবিল গঠন করে এবং ব্যাংকগুলোকে শুধু শেয়ারবাজারের জন্য পরিকল্পিত তহবিল থেকে ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সালমান এফ রহমান ব্যাংকগুলোকে সুকুকে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়ে সার্কুলার জারি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাধ্য করেন। এরপর সালমান কয়েকটি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তার কোম্পানির সুকুকে বিনিয়োগ করতে বলেন।

কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গণমাধ্যমকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে, কিস্তি পরিশোধ না করলেও তাদের কিছু বলা যেত না। বাংলাদেশ ব্যাংকও জেনে চুপচাপ ছিল। তাই এসব ঋণ দীর্ঘদিন আদায় ছাড়াই পড়ে আছে। এসব ঋণের অধিকাংশই খেলাপি যোগ্য। ঋণগুলো পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া দেওয়ার কারণে টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তারা আরো বলেন, সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এখন যদি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, তাহলে কিছু টাকা হলেও উদ্ধার করা যাবে। তাই সরকারের উচিত হবে এসব ঋণের ব্যাপারে নজর দেয়া।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি যে শুধু ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন এমন নয়, তার বিরুদ্ধে শেয়ার মার্কেটে কারসাজিসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে। এসবের নথি (ডকুমেন্ট) রয়েছে। এতদিন তারা প্রভাবশালী থাকার কারণে ওইসব ডকুমেন্ট প্রকাশ হয়নি। এখন তার বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করে যেসব অপরাধ তিনি করেছেন তার শাস্তিসহ আর্থিক পেনাল্টির (জরিমানা) ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সে ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে তার যেসব সম্পদ রয়েছে, সেগুলো বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। সালমান এফ রহমানের বিষয়ে যে মামলা এখন দেওয়া হয়েছে, সেটি রাজনৈতিক। এর আগেও যাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা দেয়া হয়েছে, তারা পার পেয়ে গেছেন। সেটি থেকে শিক্ষা নিয়ে সালমান এফ রহমানের ডকুমেন্টে অপরাধগুলো ধরে মামলা করে তাকে বিচারের আওতায় আনা দরকার। সূত্র : ভোরের কাগজ, এটিন নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়