বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত মিঠুর মরদেহ ৯ মাস পর কবর থেকে উত্তোলন
হারুন-অর-রশীদ, ফরিদপুর প্রতিনিধি : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত জেলা বিএনপির সাবেক সম্পাদক জান শরীফ মিঠুর লাশ ৯ মাস পরে ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে উত্তোলন করে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। তবে হাসপাতালে পোর্টেবল এক্সরে না থাকায় ময়নাতদন্ত করতে দেরি হবে বলে ফরেনসিক বিভাগ থেকে জানানো হলে খবর পেয়ে সেখানে জড়ো হন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। পরে তাদের দাবির মুখে বাইরের একটি হাসপাতাল খেকে পোর্টেবল এক্সরে মেশিন সংগ্রহ করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে মিঠুর লাশ পুনরায় দাফনের জন্য বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে ঢাকার সিএমএম আদালতের নির্দেশে বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) সকাল ১০টার দিকে ফরিদপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফজলে রাব্বির উপস্থিতিতে শহরের গোয়ালচামটে জান শরীফ মিঠুর বাসভবনের সামনে দাফন করা তার কবর থেকে লাশ উত্তোলনের কাজ শুরু করা হয়। এসময় ঢাকার রামপুরা থানা থেকে আসা এসআই নেতৃত্বে আসা পুলিশের একটি বিশেষ টিম সহ কোতোয়ালি থানা পুলিশের একটি দল উপস্থিত ছিলেন। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তার লাশ কবর থেকে উত্তোলনের পর দুপুর নাগাদ ময়নাতদন্তের জন্য ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পৌঁছে।
গত জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন দমনে তৎকালীন সরকারি বাহিনীর সশস্ত্র হামলা শুরুর দিকে গত বছরের ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুরে ঢাকার উত্তরার বনশ্রীতে গুলিতে নিহত হন জেলা বিএনপির সাবেক কমিটির সম্পাদক ও শহরের গোয়ালচামটের মোল্লা বাড়ির বাসিন্দা শরীফ সামসুল আলম মন্টুর পুত্র জান শরীফ মিঠু (৪৬)। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া মিঠু ওইদিন দুপুরে বনশ্রী জামে মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে চারপাঁচজন সঙ্গীর সাথে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হলে একটি গুলি তার বুকের কাছ দিয়ে শরীর ভেদ করে পিঠের দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। দ্রুত তাকে বনশ্রী ক্লিনিকে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান তার মৃত্যু হয়েছে।
তবে আন্দোলনে হতাহতদের ব্যাপক আইনি জটিলতার মুখোমুখি হওয়ায় ওই অবস্থায় মিঠুর গুলিবিদ্ধ হওয়া ও মৃত্যুর তথ্য হাসপাতালে নথিভুক্ত না করে, কোনভাবে অ্যাম্বুলেন্সে তার লাশ ফরিদপুরে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়। সেখানে হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসার সাহায্যার্থে উপস্থিত কুষ্টিয়ার এক সাবেক ছাত্রশিবির ছাত্রনেতার মাধ্যমে আইনী জটিলতা এড়িয়ে মিঠুর লাশ তখন দ্রুত হাসপাতাল থেকে বের করে অ্যাম্বুলেন্সে ফরিদপুরে নিয়ে আসা হয়। এরপর ওই রাতেই তাকে বাড়ির প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় গত বছরের ৯ অক্টোবর শেখ হাসিনা সহ ১৪৮ জনের নামোল্লেখ করে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন মিঠুর স্ত্রী রোহেদুন সেজবা ইভা। ওই মামলায় মাস দেড়েক আগে আদালত কবর থেকে জান শরীফ মিঠুর মৃতদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন। তবে সেসময় মিঠুর পরিবার কবর থেকে লাশ উত্তোলনে রাজি না হওয়ায় ময়নাতদন্তের এ কাজ বিলম্বিত হয়।
নিহত মিঠুর স্ত্রী রোহেদুন সেজবা ইভা বলেন, স্বামীর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে আবার কাটাছেঁড়া করা হবে এটি মেনে নেওয়া আমাদের জন্য কষ্টকর ছিল। কিন্তু স্বামী হত্যার বিচার পেতে হলে এছাড়া কোন ভিন্ন উপায় ছিলোনা। তাই সকলের অনুরোধে আমরা রাজি হই। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার পরে বলা হয় আজ আর ময়নাতদন্ত সম্ভব নয়। শনিবার তারা ময়নাতদন্ত শেষে লাশ হস্তান্তর করবেন বলে জানান। এ অবস্থায় বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। একইসাথে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরাও হাসপাতালে পৌঁছেন। পরে বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে আবারো স্বামীর লাশ নিয়ে বাড়িতে ফিরে তাকে পুনরায় দাফন করা হয়েছে।
ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. ইউনুস আলী জানান, এই লাশের ময়নাতদন্ত অন্য সকল লাশের ময়নাতদন্তের মতো নয়। এটির জন্য পোর্টেবল এক্সরে মেশিন দরকার যা আমাদের হাসপাতালে ছিলোনা। পরে এনিয়ে একটু ঝামেলা হলে প্রিন্সিপাল স্যারের উপস্থিতিতে ঝামেলার নিরসন করা হয়। বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফরিদপুর জেলার সদস্য সচিব সোহেল রানা বলেন, দুপুরে আমরা খবর পাই যে, কবর থেকে শহীদ মিঠুর লাশ উত্তোলনের পর হাসপাতালের মর্গে নিয়ে রাখার পর তার পরিবারকে জানানো হয় যে, এই লাশ ময়নাতদন্তের যেই যন্ত্র দরকার তা হাসপাতালে নেই। শুক্রবার সরকারি ছুটি থাকায় শনিবারের আগে লাশের ময়নাতদন্ত সম্ভব নয়। এ খবর পেয়ে আমরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাই এবং কর্তৃপক্ষকে বলি যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়াই তারা কেন কবর থেকে লাশ উত্তোলন করলো? এটি শহীদের লাশের প্রতি অবমাননা। পরে আমাদের দাবির মুখে বাইরের একটি হাসপাতাল থেকে মেশিন এনে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়।
প্রসঙ্গত, জান শরীফ মিঠু সস্ত্রীক ঢাকার উত্তরায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। ২০০৬ সালে নওগাঁর মেয়ে রোহেদুন সেজবা ইভার সাথে বিয়ে হয় মিঠুর। মাহাবী শরীফ জারা নামে তাদের একটি মেয়ে রয়েছে।