আগে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে পান্তাভাত আর আলুভর্তার সঙ্গে খাবারের তালিকায় ইলিশ মাছ ভাজা রাখতেন বরিশালের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম। তবে গত কয়েক বছর ধরে সেখান থেকে ধীরে ধীরে সরে এসেছেন। গত বছর ইলিশের পরিবর্তে ডিম ভাজা খেয়েছেন। এবারও পান্তাভাত আর আলুভর্তার সঙ্গে ডিম ভাজা এবং মরিচভর্তা দিয়ে বৈশাখ উদযাপন করবেন বলে জানিয়েছেন জাহিদুল। খবর: বাংলাট্রিবিউন।
তার মতো পহেলা বৈশাখের আয়োজনে ইলিশ নিয়ে মাতামাতি কমেছে মানুষ এবং বিক্রেতাদের। একইসঙ্গে বিক্রি ও চাহিদা কমেছে। এর প্রধান কারণ ইলিশের দাম অনেকটাই ক্রেতার নাগালের বাইরে।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ইলিশের দাম এতোটাই চড়া যে, এখন স্বাভাবিক দিনগুলোতেও কেনা যাচ্ছে না। সেখানে পহেলা বৈশাখে পাওয়া তো দুষ্কর। যেভাবে দিন দিন দাম বাড়ছে, তাতে করে এক সময় ইলিশ খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। আগেরবারের মতো এবারও বৈশাখে ইলিশ কিনবো না। পান্তাভাত, আলুভর্তা, ডিম ভাজা এবং মরিচভর্তা দিয়ে এবার বৈশাখ উদযাপন করবো।’
বরিশাল নগরের অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র পোর্ট রোডের মৎস্য আড়ত, যেটি ইলিশের মোকাম হিসেবে পরিচিত। আগের বছরের মতো এবারও বৈশাখ উদযাপনে ইলিশ নিয়ে তেমন মাতামাতি নেই। পোর্ট রোড বাজার থেকে ইলিশ যাচ্ছে না কোথাও। বিগত বছরগুলোতে যেখানে দাম কোনও বিষয় ছিল না, সেখানে এ বছর আগাম কোনও অর্ডার পাননি আড়তদাররা। তারা বলছেন, আগের বছরও একই অবস্থা চলেছিল।
এদিকে, প্রথমবারের মতো বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় ৬৫ দিন মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পুনর্বিন্যাস করেছে সরকার। এতে সময়সীমা কমিয়ে ৫৮ দিন নির্ধারণ করার পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার সময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রায় একই সময়ে করা হয়েছে। গত ১৭ মার্চ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে মৎস্য গবেষক, জেলে ও ব্যবসায়ীরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
সরকার মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পুনর্বিন্যাস করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তাতে প্রতি বছর ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা থাকবে বঙ্গোপসাগরের ভারতের জলসীমায়ও। এক্ষেত্রে ভারতের নিষেধাজ্ঞো বলবৎ থাকার দুদিন আগে বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়ে যাবে। মন্ত্রণালয়ের সামুদ্রিক মৎস্য-২ শাখার উপসচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখার রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন। এই হিসেবে পহেলা বৈশাখের পরদিন থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে।
বর্তমানে বরিশালের পোর্ট রোডের মৎস্য আড়তে পাইকারিতে এক হাজার ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ বিক্রি হয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা, হিসাবে কেজি পড়ছে তিন হাজার টাকা। এক কেজি ওজনের ইলিশের মণ এক লাখ পাঁচ হাজার, হিসাবে কেজি পড়ছে দুই হাজার ৬২৫ টাকা। ৬০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ ৯৫ হাজার, হিসাবে কেজি পড়ছে দুই হাজার ৩৭৫ টাকা। ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ ৬৫ হাজার, হিসাবে কেজি পড়ছে এক হাজার ৬২৫ টাকা। খুচরা বাজারে এই ইলিশ ২০০-৩০০ টাকা বেশিতে কেজি দরে বিক্রি হয়।
পোর্ট রোডের আড়তদার জহির সিকদার বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে এপ্রিল মাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এই মোকাম থেকে ইলিশ যেতো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। এজন্য বড় সাইজের ইলিশের চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। দামের কোনও সমস্যা ছিল না। আড়তদাররা এক কেজি থেকে শুরু করে যত বড় ইলিশ আসতো তা বরফ দিয়ে রেখে দিতেন। এরপর ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পাঠিয়ে দিতাম আমরা। ওই সময়ে সাগরে নিষেধাজ্ঞা চললেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী জেলেদের দিয়ে ইলিশ শিকার করাতো। এভাবে চলে আসছিল বছরের পর বছর। আগের বছরগুলোতে ১ এপ্রিল থেকে ১২ ও ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৫০ মণের বেশি ইলিশ যেতো দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু গত বছর থেকে দাম বাড়ায় চাহিদা কমেছে। এবার অর্ডার একেবারে নেই বললেই চলে।’
অর্ডার একেবারেই কমে যাওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে জহির সিকদার বলেন, ‘এবার ইলিশের দাম আগের বছরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ মাছের আমদানি অনেক কম। আগে দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারি ব্যবসায়ীরা ইলিশের জন্য এই মোকামে আসতেন। পহেলা বৈশাখ উদযাপনে বেশি দামে বিক্রি করতে কিনে নিয়ে যেতেন। কিন্তু এবার পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র। ঢাকাসহ দেশের কোনও স্থান থেকে অর্ডার পাওয়া যায়নি। পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তাদের কাছেও ইলিশের অর্ডার আসেনি। এজন্য মোকামে আসেননি তারা। ফলে বিক্রি নেই বললেই চলে।’
পোর্ট রোডের মেসার্স আক্তার মৎস্য আড়তের স্বত্বাধিকারী মো. ইউসুফ বলেন, ‘বর্তমানে জাটকা শিকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ইলিশ বাজারে খুব কম। তাই দামে আগুন। ঈদের পর থেকে পোর্ট রোড বাজারে ৫০ মণও উঠেনি। সর্বশেষ গত বুধবার এক কেজি ২০০ গ্রাম সাইজের মণ এক লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক কেজির ইলিশের মণ এক লাখ পাঁচ হাজার, ৬০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ ৯৫ হাজার, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ ৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে এবার বৈশাখে ইলিশ নিয়ে মাতামাতি নেই।’
পোর্ট রোডের আড়তদার হেমায়েত উদ্দিন ও মো. সাজু মিয়া জানিয়েছেন, জাটকা বড় হলে ইলিশে রূপ নেয়। কিন্তু সেই জাটকা শিকার করছে এক শ্রেণির অসাধু জেলেরা। এ কারণে প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন কমছে। জাটকা শিকার বন্ধ করতে পারলে নদী ও সাগরে ইলিশ বেড়ে যাবে। তখন দামও কমে যাবে।
ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবার জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ (৮-১৪ এপ্রিল) ঘোষণা করেছে সরকার। এই সময়ে সব ধরনের ইলিশ সংগ্রহ ও বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে হেমায়েত উদ্দিন বলেন, ‘সাগরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকির প্রয়োজন নেই। অবৈধ জাল উৎপাদন হচ্ছে যেখানে সেখানে অভিযান চালিয়ে জাল উৎপাদন বন্ধ করতে হবে সবার আগে। এটি সম্ভব হলে ইলিশ রক্ষায় সরকারের খরচ কমে আসবে। জেলেরা নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ শিকার করতে পারবে না। কারণ যে জাল দিয়ে ধরা হয়, তা না থাকলে কোনও জেলেই শিকারে নামবে না। এজন্য সরকারের কাছে অবৈধ জাল উৎপাদন বন্ধে কঠোর অভিযানের দাবি জানাচ্ছি আমরা।’
পোর্ট রোডের আরেক আড়তদার আবুল কালাম বলেন, ‘আগের বছরগুলোতে এই সময়ে জাটকা ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রতিদিন ৪০০-৫০০ মণ ইলিশ আসতো পোর্ট রোড আড়তে। কিন্তু এখন দিনে ৫০ মণও আসে না। এতে বোঝা যায়, সাগরে মাছ নেই। উৎপাদন কমে গেছে। এ অবস্থার পরিবর্তনে অবৈধ জাল উৎপাদন কারখানা এবং কারেন্ট জাল বন্ধ করে দিতে হবে। তাহলে উৎপাদন বেড়ে যাবে।’
তবে উৎপাদন কমেছে আড়তদারদের এমন দাবির সঙ্গে একমত নন বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদফতরের উপপরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আগের বছরগুলোর চেয়ে উৎপাদন কমেনি বরং বেড়েছে। এখন জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ চলছে। কঠোরভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে। জেলেদের সাগরে নামতে দেখলেই জেল-জরিমানা করা হয়। এজন্য মোকামে জাটকা যাচ্ছে না। এবার প্রথমবারের মতো ভারতের সঙ্গে মিলিয়ে সাগরে জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় কেউ ইলিশ শিকার করতে পারবে না। নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন জেলেদের খাদ্য সরবরাহের সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অভয়াশ্রম থেকে শুরু করে যেসব এলাকায় ইলিশের প্রজনন বেশি সেসব এলাকায় রাতদিন পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে জেলেদের সচেতন করার কাজও করছি আমরা।’