শিরোনাম
◈ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের ◈ বেনজীরের বিতর্কিত বক্তব্যে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবাদ (ভিডিও) ◈ হঠাৎ ট্রাম্পকে যে কারণে ‘টোপ’ দিলেন জেলেনস্কি ◈ ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু, মোজাম্মেল হকের বাড়িতে র‌্যাব ◈ আপিল ট্রাইব্যুনালে জয়ী পুলিশ সদস্যদের চাকুরীতে পুনর্বহালের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে ◈ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার গায়েবানা জানাজা পড়লেন বৈষম্যবিরোধীর নেতাকর্মীরা ◈ সেদিন গাজীপুরে কি ঘটেছিল? আহতদের মুখে ঘটনার বর্ণনা ◈ টিউলিপের নামে গাজীপুরে বাংলো, যা বলছে লেবার পার্টি ◈ ফরিদপুরের সালথায় চার কৃষকের ১০ ঘরে আগুন, সব পুড়ে ছাই ◈ অযথা সময়ক্ষেপণ করে ক্ষমতায় থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই সরকারের: আসিফ নজরুল

প্রকাশিত : ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১২:৪১ রাত
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০২:৪৪ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সেদিন গাজীপুরে কি ঘটেছিল? আহতদের মুখে ঘটনার বর্ণনা

শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। গাজীপুর চৌরাস্তা মোড়ের চান্দিনা টাওয়ারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের একটি অফিস উদ্বোধনের কাজ চলছিল। হঠাৎ একটি ফোন কল আসে। বলা হয়- গাজীপুরের ধীরাশ্রম মন্দিরবাড়ী এলাকায় সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজ্জামেল হকের বাড়িতে কিছু লোক ভাঙচুর-লুটপাট চালাচ্ছে। এই খবর পেয়ে আমরা ৪০ থেকে ৫০জন শিক্ষার্থী ৪টা ইজিবাইকে করে সেখানে যায়। তারা সেখানে গিয়ে দেখেন কয়েকজন মোজ্জামেল হকের বাড়ির ভেতরে ভাঙচুর করছে। শিক্ষার্থীদের একটি দল ভেতরে প্রবেশ করে। আরেক গ্রুপ বাইরে ছিল। এ সময় হঠাৎ বাড়ির সামনের মসজিদের মাইকে জয় বাংলা বলে ঘোষণা করা হয়- বলা হয় এলাকায় ডাকাত ঢুকেছে। সব লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আপনারা সবাই যার যা আছে নিয়ে বের হয়ে আসুন। এরপর এলাকাটির প্রায় সবক’টি মসজিদে একই ঘোষণা দেয়া হয়। ঘোষণার পরপরই এলাকাটির প্রায় এক-দেড়শ’ মানুষ ধারালো অস্ত্র, লাঠি-সোটা নিয়ে বের হয়ে মোজাম্মেল হকের বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলে। তারা এসেই প্রথমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের মারধর করে। পরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে শিক্ষার্থীদের আটকে রেখে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। তখন তাদের কেউ কেউ দুইতলা থেকে নিচে লাফ দেন। ১০ থেকে ১৫ জন জীবন বাঁচাতে বাড়িটির ছাদে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেন। তারা ছাদের দরজা ভেঙে ছাদে গিয়েও হামলা করে। গাজীপুরের ধীরাশ্রমে শুক্রবার রাতে হামলার এমনই বর্ণনা দিয়েছেন আহতরা। সরজমিন ঘুরে স্থানীয়দের কাছ থেকেও এমন বর্ণনা মিলেছে। যদিও ঘটনার পর থেকে এলাকায় পুরুষদের খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকেও কেউ ঘটনার বিষয়ে কথা বলছেন না। হামলার শিকার হয়ে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১২তলার কেবিনে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন চান্দিনা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের ওপর পরিকল্পনা করেই হামলা হয়। তারা মাথা লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। একটা কোপ এসে লাগে আমার বাম চোখের পাশে। আমি নিচে লুটিয়ে পড়লে তারা আমাকে মৃত ভেবে চলে যাচ্চিল। তখন একজন লাইট মেরে বলে- শালা মরেনি। ওদের ধরে নিয়ে চল। আজকে সবক’টাকে একদম শেষ করে দেবো। তখন আমাদেরকে ধরে বাড়ির সামনের মসজিদে নিয়ে গিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে আবারো মারধর করে। আমার সামনেই একজনের পায়ের রগ কেটে দেয়। আমাকেও বলা হয়- ভিডিওতে মাফ চা, বল কোনোদিন আর এসব করবি না। না হলে তোরও পায়ের রগ কেটে দেয়া হবে। পরে আমি তাদের কাছে মাফ চেয়ে জীবনটা রক্ষা করি। 

শুক্রবার রাতে হামলার সময় মোজাম্মেল হকের বাড়ির ২য় তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়ে একই কেবিনে ভর্তি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের গাজীপুর শাখার সদস্য টঙ্গী চেরাগ আলী এলাকার বাসিন্দা মো. আকাশ (১৯) বলেন, যখন চারপাশ থেকে এসে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমাদেরকে কোপানো শুরু করে তখন জীবনের ভয়ে আমিসহ কয়েকজন ২য়তলা থেকে নিচে ঝাঁপ দিই। তিনি বলেন, এটা একটা ট্র্যাপ (চক্রান্ত) ছিল। চক্রান্ত করেই বাড়ি ভাঙচুরের খবর দিয়ে আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ আমাদের ওপর যখন হামলা চলছিল তখন যারা আগেই ওই বাড়িতে ভাঙচুর চালাচ্ছিল তারাও স্থানীয়দের সঙ্গে যোগ দেয়। তারা ওদেরই লোক ছিল। আমরা যখন প্রথমে গিয়ে তাদের ফোন চেক করেছিলাম, তখন তাদের ফোনে আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবি ও পোস্ট ছিল।  তিনি বলেন, এ ঘটনায় আমাদের অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন।

এদিকে সরজমিন গাজীপুরের ধীরাশ্রম মন্দির বাড়ি এলাকায় সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, আধুনিক কারুকার্যের দুইতলা বিশিষ্ট বাড়িটির প্রতিটা রুমেই ভাঙচুর চালানো হয়েছে। চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে জানালার কাঁচ ভাঙচুর করা হয়েছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বাড়িটির মালামাল আসবাবপত্র। আলিশান বাড়িটির উঠানে রয়েছে সুইমিংপুল, পাকা বসার জায়গা। বাড়ির সামনে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, ফুলের বাগান। পাশেই মসজিদ। যেই মসজিদ থেকেই প্রথম ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দেন মোজাম্মেল হকের বাড়ি দেখাশোনা করা ও ওই মসজিদের ইমাম। মসজিদের দেওয়াল ও মেঝেতে রক্তের দাগ দেখা যায়। মসজিদের দেওয়ালে রক্তের দাগ দেখে বোঝা যায়- মসজিদের বারান্দায় আহত কাউকে বসিয়ে রাখায় তাদের মাথা থেকে দেওয়ালে লেগেছে এই রক্ত। পুরো এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শুক্রবার রাতে ও সকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নারী-পুরুষসহ কয়েকজনকে পুলিশ থানায় নিয়ে যাওয়ায় ভয়ে মুখ খুলছে না কেউ। 

নাসিমা বেগম, ইয়াসিন সরকারসহ নাম না প্রকাশের শর্তে আরও কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যার পর আমরা সবাই বাড়িতে ছিলাম। হঠাৎ মসজিদের মাইকে ডাকাতের হামলার ঘোষণা শুনে বাইরে এসে দেখি অনেক লোক। মন্ত্রীর বাড়ির মধ্যে ঢুকে ভাঙচুর করছে। এরমধ্যেই এলাকার লোকজনের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। কেউ কেউ দৌড়ে পালিয়ে যায়। কয়েকজনকে আটকে রাখা হয়। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা এসে তাদেরকে নিয়ে যায়। তারা বলেন, এটা সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের পৈতৃক নিবাস। তিনি এখানে সবসময় থাকতেন না। মাঝে মধ্যে সময় কাটাতে আসতেন। তার শহরের ওপর বাড়ি আছে। বেশির ভাগ সময়ই তিনি ঢাকায় থাকতেন। সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। এই বাড়িতে মসজিদের ইমাম তার বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকেন। এই বাড়ি দেখাশোনার জন্য তাকে ময়মনসিংহ থেকে এনে বেতনভুক্ত রাখা হয়েছে। তারা বলেন, ওই ঘটনার পর রাতে পুলিশ এসে বাড়িতে বাড়িতে গিয়েছেন। খোঁজ নিয়েছে- কোন বাড়িতে নারীরা আছে আর কোন বাড়িতে পুরুষ আছে। পুরুষ মানুষ পেলেই তাকে তুলে নিয়ে গেছে। শনিবার সকালেও অনেকজনকে থানায় নিয়ে গেছে। এই পাশের মার্কেট মসজিদের ইমামকে না পেয়ে তার স্ত্রী ও মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। ভয়ে এখন পুরুষশূন্য পুরো এলাকা। 

অপরদিকে সেদিন রাতে ওই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের মোজাম্মেলের বাড়িতে বহন করে নিয়ে যাওয়া ৪ ইজিবাইকের মধ্যে থাকা এক চালক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, শুক্রবার রাতে আমি কাজ শেষে বাড়িতে যাবো। চৌরাস্তায় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এর মাঝেই ছাত্ররা ডাক দিলো। আমরা একসঙ্গে ৪টা ইজিবাইকে তাদেরকে নিয়ে রওনা করি। তারা সবাই খালি হাতে ছিল। কোনো লাঠিসোটা ছিল না। তবে তারা খুব মারমুখী ছিল। গাড়ি থেকে নেমে তারা দুটো ইজিবাইকের ভাড়া ১৫০ করে মোট ৩০০ টাকা দিলেও আমাদের দুটোর ভাড়া বাকি ছিল। আমরা দু’জনেই তাই গাড়ি নিয়ে ভাড়ার অপেক্ষায় ছিলাম। দেখলাম ছাত্ররা গেটে লাথি মেরে চিল্লাচিল্লি করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। এরপরই এক হুজুর দৌড়ে গিয়ে মাইকে ডাকাত বলে ঘোষণা করলেন। এরপর আশপাশের মসজিদেও ডাকাতের ঘোষণা করা হয়। এলাকার সবাই তখন দা, সাবল নিয়ে দৌড়ে আশে। তখন আমি আর আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক ইজিবাইকচালক দু’জনে দুইদিকে গাড়ি চালিয়ে বের হয়ে যায়। ভাড়া না পাওয়ায় আমি জয়দেবপুর যাওয়ার মেইন রোডে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরইমধ্যে দুইজন শিক্ষার্থী আমার কাছে এসে অনুরোধ করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আগে ভাড়ার টাকা না পাওয়ায় আমি তখন তাদেরকে বলি ভাড়া না দিলে আমি যাবো না। তখন একটি শিক্ষার্থী তার পকেটে হাত দিয়ে বলে- আমার সব নিয়ে গেছে। ফোন নিয়ে গেছে। তবে মানিব্যাগটা আছে। এই বলে সে ৫শ’ টাকার একটি নোট আমার হাতে তুলে দেয়। আমি তখন তাদেরকে নিয়ে তাজউদ্দীন মেডিকেলে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, আমিই প্রথম আহত দু’জনকে আমার ইজিবাইকে করে হাসপাতালে পৌঁছে দিই। এরপর শুনি এত ঘটনা।     

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গাজীপুরের মুখ্য সংগঠক মো. রবিউল হাসান ও  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা মো. নয়ন দেওয়ান বলেন, কিছু লোক গাজীপুর মহানগরের ধীরাশ্রম এলাকায় সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের গ্রামের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে, এমন খবর পেয়ে আমাদের লোকজন ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলাকাবাসী আমাদের লোকজনের ওপর হামলা চালায়।

আহতদের মুখে ঘটনার বর্ণনা: উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী ওমর হামজা (২২)। শুক্রবার সন্ধ্যার পর বন্ধুদের সঙ্গেই ছিলেন গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায়। তিনি এবং তার বন্ধুরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। তিনি নিজে গাজীপুর জেলার সংগঠক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। আড্ডা দেয়ার সময়ই তাদের এক সিনিয়র ভাইয়ের মোবাইলে ফোন আসে সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে ভাঙচুর চালাচ্ছে দুষ্কৃতকারীরা। তাই প্রতিহতের জন্য তারা সবাই সেখানে চলে যান। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর বাড়ির মেইন গেট বন্ধ করে তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করা হয়। পরে তাদেরকে উদ্ধার করে নেয়া হয় প্রথমে গাজীপুরের শহীদ তাজ উদ্দিন হাসপাতালে। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হামলায় যারা আহত হয়েছেন তাদেরই একজন ওমর হামজা।  

তিনি একটি জাীয় দৈনিককে বলেন, ৭টা ৩৫ মিনিটের দিকে ফোন আসে। আমরা অনেকেই একসঙ্গে ছিলাম। ঘটনাস্থল থেকে আমরা ৩০ থেকে ৩৫ মিনিটের দূরত্বে ছিলাম। গত কিছুদিন ধরে কিছু ঘটনায় আমাদের জড়িয়ে সমালোচনা হচ্ছিল। তাই আমরা প্রতিহত করার জন্যই একসঙ্গে যাই। সেখানে পৌঁছানোর পর আমরা দেখি ৫/৭ জন ব্যক্তি সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। 

যিনি ফোন করেছেন তিনি সেখানে ছিলেন। আনুমানিক ২২ বছর বয়সী এই যুবক নিজেকে শিক্ষার্থী বলে জানায়। আমরা প্রায় ৩৮ জন ছিলাম। যাওয়ার পরপরই আমাদের বলা হয় দোতলায় ভাঙচুর হয়েছে। তখন আমরা দেখতে পাই কয়েকটি থাই গ্লাস ভাঙ্গা। দোতলায় ভাঙচুর করা হয়েছে বলেও আমাদের জানানো হয়। আমরা যখন দোতলায় উঠি তখন বাইরে থেকে ভবনের প্রবেশপথের গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। নিচতলার একপাশে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। মেইন গেট আটকিয়ে দেয়ার পর এলাকার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাসায় ডাকাতির উদ্দেশ্য দুষ্কৃতকারীরা ঢুকেছে। আপনারা সবাই আসুন। যখন তারা আগুন ধরিয়ে দেয় আমরা তখন বাঁচার জন্য ছাদের দিকে যাই। মাইকিংয়ের পরপরই এলাকার মানুষ আগুন নিভিয়ে দরজা ভেঙে উপরে উঠে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। যারা হামলা চালিয়েছে তাদের সবার হাতেই লোহার পাইপ, রড, লাঠি ছিল। যখন পরিচয় দিয়েছি আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। তখন তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে হামলা চালিয়েছে। আমরা তাদেরকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি আমরা শিক্ষার্থী। কিন্তু তারা উল্টো বলতে থাকে তোরা ডাকাতি করতে আসছিস, তোদেরকে মেরে ফেলবো। এসব বলতে বলতে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। তারা আমাদেরকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে আমাদের সবার মাথায় আঘাত করেছে। তিনি বলেন, আমাদের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। কারণ শুরুতে তারা ৫/৭ জন ছিল। কিন্তু ১০ মিনিটের ভেতরে কীভাবে তারা ৭০০/৮০০ অস্ত্রধারী হয়ে যায়। তারা পরিকল্পিতভাবে আমাদের ওপর হামলা করেছে। কমিটি নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব না থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, দ্বন্দ্ব থাকলে সেখানে শুধু শিক্ষার্থীরাই আসতো। কিন্তু সেখানে ৪০ ও ৫০ বছরের ঊর্ধ্বের কেউ থাকার কথা না। অবশ্যই সুপরিকল্পিতভাবে হামলা হয়েছে। ফোনকলের সত্যতা যাচাই না করে চলে যাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, এর আগেও দুই জায়গায় ভাঙচুর হয়েছে। সেখানেও আমাদের নাম জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা মনে করেছি সেখানে গিয়ে আমাদের প্রতিরোধ করা উচিত। যেন আমাদের নামে দুর্নাম না ছড়ায়। সে কারণে তাৎক্ষণিক ডিশিসন নিয়ে আমরা বের হয়ে পড়ি। হামলায় আমাদের যুগ্ম আহ্বায়কও আহত হয়েছেন। তারা আমার মাথায় ব্যাপক আঘাত করেছে। কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করেছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে বড় জখম রয়েছে। 

আরেক ভুক্তভোগী আহত এসএসসি পরীক্ষার্থী আব্দুর রহমান ইমন (১৭) বলেন, আমি তখন আমাদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছিলাম। তখন যুগ্ম আহ্বায়ক হিমেল ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বলেন সাবেক মন্ত্রীর বাসায় ঝামেলা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি সেখানে যেতে হবে। আমি তখন ফোন পেয়েই বের হয়ে যাই। আমরা সবাই মিলে বাড়িতে প্রবেশ করার পরেই আমাদের ঘেরাও করে ফেলে গেট বন্ধ করে দেয়। মসজিদের মাইকে তখন ডাকাত প্রবেশ করছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। কিছুক্ষণের ভেতরে লাঠিসোটা, রড নিয়ে আরও কয়েকশ’ মানুষ সেখানে জড়ো হয়ে আমাদের ওপর হামলা করে। সবাইকে এলোপাতাড়ি  কোপানো হয়। আমি মাথায় আঘাত পেয়েছি। হাতেও কোপ লেগেছে। প্রাণ বাঁচাতে সেখান থেকে আমি পালিয়ে আসি। নিজেই একটা রিকশা নিয়ে গাজীপুর সরকারি হাসপাতালে যাই। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর আমাকে এম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। আমার মাথায় ৯টি এবং হাতে ৬টি সেলাই দেয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী আহত সাব্বির খান মিলন (২২) বলেন, গাজীপুর চৌরাস্তা থাকাকালীন খবর আসে ঝামেলা হচ্ছে আমাদের সবাইকে সেখানে যেতে হবে। সবার সঙ্গে আমিও রওয়ানা দেই। কিন্তু সেখানে গিয়ে  কয়েকজন ছাড়া কাউকে দেখতে পাইনি। যখন তারা আমাদেরকে ভেতরে রেখে গেট আটকে দিয়ে মাইকে ঘোষণা দেয় তখন শ’ শ’ লোক রড, চাপাতি, পাইপ, লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে আসে। আমরা তাদের অনেক বুঝিয়েছি আমরা শিক্ষার্থী। আমরা ডাকাতির জন্য নয় বরং প্রতিহত করার জন্য এসেছি। কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথা শুনেনি। যখন বলছি আমরা শিক্ষার্থী তখন তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালায়। চাপাতি দিয়ে আমাদের ইচ্ছেমতো কুপিয়েছে। সবার মাথায় আঘাত করেছে। আমরা ছাদে গিয়েও রক্ষা পাইনি। পরিকল্পিতভাবে আমাদের ফাঁদে ফেলে হামলা চালানো হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদেরকে মেরে ফেলা। 

মর্নিং সান স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহত শুভ শাহরিয়ারের মা শিরিন বলেন, আমার ছেলেকে তার এক বড় ভাই নিয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রথমে তাকে কিছুই বলেননি। শুধু বলেছেন বিএনপি’র কমিটি দেয়ার জন্য একটা মিলাদ হবে। কিন্তু তাকে নেয়া হয়েছে মোজাম্মেলের বাড়িতে।  শুভ সেখানে গিয়ে দেখে বাড়ি ভাঙচুর চলতেছে। পরে তারা ভেতরে ঢুকলে সবাইকে একটা রুমে আটক করে। কিছুক্ষণ পর মসজিদের মাইকে ডাকাত বলে ঘোষণা করা হয়। তখন তারা রুমের দরজা ভেঙে ছাদে যায়। ছাদের দরজা আটকে দেয়। কিছুক্ষণ পর তারা সবাই উপরে গিয়ে ছাদের দরজা ভেঙে তাদের আটকিয়ে মারধর করে।

আহত ইয়াকুব বলেন, যারা আমাদের ছাত্র প্রতিনিধি পরিচয় দিয়েছিল, তারা বলে যে ভেতরের অবস্থা খুব খারাপ। আপনারা একটু দেখেন। এ কথা বললে আমরা প্রায় ৩০ জন ভেতরে প্রবেশ করি। তারা চালাকি করে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। এরমধ্যে কয়েকশ’ ব্যক্তি আমাদের ওপর আক্রমণ করে। কিছু ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। যাদের তারা ধরতে পারে তাদের মাথায় আঘাত করে, মাথা ফাটিয়ে দেয়। বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তারা আমাদের ওপর হামলা করে। এরপর তারা যাদের ভেতরে আটকিয়ে রেখেছিল, সেই গেট ভেঙে আমাদের ওপর হামলা করে। এ সময় আমরা পালিয়ে ছাদে চলে যাই এবং ছাদের গেট আটকিয়ে দেই। তিনি বলেন, তখন তারা মাইকে ঘোষণা দেয় যে মোজাম্মেল ভাইয়ের বাড়িতে ডাকাত ঢুকেছে। হামলা হয়েছে। মোজাম্মেল ভাইয়ের যত লোক আছেন সবাই এসে ওদের ধরেন। এভাবেই মাইকে একটা ঘোষণা দেয়। এরপর তারা ছাদের গেট ভেঙে আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা প্রত্যেককে দা, চাপাতি দিয়ে কোপানোর চেষ্টা করে। 

তারা প্রায় ঘণ্টাখানেক আমাদের ওপর নির্যাতন চালায়। এর মধ্যেই আমাদের কাছে যে মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ যা ছিল, সব নিয়ে যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের হত্যা করা। তারা আমাদের টর্চার করে চলে যাওয়ার পর লোকজন এসে আমাদের হাসপাতালে পাঠায়। আমাদের একজন প্রতিনিধি আইসিইউতে ভর্তি আছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদিকে, গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। 

গতকাল আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) গিয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। উপদেষ্টা বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি হয় সে ব্যবস্থা করা হবে। এর আগে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ছাত্রদের খোঁজখবর নেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এ সময় তার সঙ্গে আরও ছিলেন আইজিপি বাহারুল আলম ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার সাজ্জাত আলী। শনিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে ঢামেকের অর্থোপেডিক বিভাগ ও বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের ষষ্ঠ তলার ৬১৭নং ওয়ার্ডে আহতদের দেখতে যান উপদেষ্টা। এরপর পৌনে ১১টার দিকে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মেডিলেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান খান। গাজীপুরের ঘটনায় ১৫ জন আহত হন।

 তাদের মধ্যে সাতজনকে ঢামেকে ভর্তি করা হয়েছে। সরজমিন হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ভবনের ষষ্ঠ তলার ৬১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন গাজীপুরে হামলার ঘটনার আহত ৬ জন। সবারই মাথায় রয়েছে ব্যান্ডেজ। চলছে স্যালাইন। আহতদের কেউ কেউ বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। কেউ ঘুমাচ্ছেন। তবে কেউই ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না। আহতরা ৬১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ৬১৮, ৬১৯, ৬২০, ৬২১, ৬২৮ ও ৬২৯ নম্বর বেডে ভর্তি রয়েছেন। উৎস: মানবজমিন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়