এম আর আমিন, চট্টগ্রাম : কর্ণফুলী নদীর পাড়েই নির্মাণ করা হয়েছে ইনটেক চ্যানেল ও পাম্প স্টেশন। ফেইস ১ ও ফেইস ২ এই দুটি প্রকল্পে দৈনিক ২৮ কোটি ৬০ লাখ লিটার পানি নদী থেকে পরিশোধনের জন্য তোলা হয়। এরপর পানি রিসিভিং ওয়েলে পাঠানো হয়। সেখানে কেমিক্যাল এলাম, লাইম, ক্লোরিন ও পলিমার মেশানো হয় পানির সঙ্গে। তারপর পানি ফ্লোকুলেটর চ্যানেলে ৩০ মিনিট প্রবাহের পর ক্লেরিফায়ার ইউনিটে ঢুকিয়ে ৮০ মিনিট রাখা হয়।
সেখানে পানিতে থাকা কাদা মাটি স্লাগ আকারে ক্লেরিফায়ার ইউনিটের তলানি হিসেবে জমা হয়। যা স্বয়ংক্রিয় স্লাগ কালেক্টরের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হচ্ছে। ক্লেরিফায়ার ইউনিটে পরিশোধিত পানির র্যাপিড স্যান্ড ফিল্টারে ঢোকে। র্যাপিড স্যান্ড ফিল্টারে পরিশোধিত পানি ক্লিয়ার ওয়েল রিজার্ভারে জমা হয়।তারপর ক্লোরিন গ্যাস প্রয়োগের মাধ্যমে পানির জীবাণু ধ্বংস করা হয়। এভাবে কয়েক ধাপে পানি পানযোগ্য করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা।
চট্টগ্রাম মহানগরবাসীকে ঠিকমতো সেবা দিয়েও বছরে ১৩২ কোটি টাকা লাভ করছে চট্টগ্রাম ওয়াসার শেখ হাসিনা পানি শোধনাগারের আওতায় রাগুনীয়ার ২টি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে। রাঙ্গুনীয়ার পোমরা এলাকায় ৪৯৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফেইস ১ ও ফেইস ২ এই দুটি প্রকল্পে দৈনিক ২৮ কোটি ৬০ লাখ লিটার পানি শোধন করছে ওয়াসা। এই পানি ভোক্তা পর্যায়ে পৌছে বছরে আয় করছে প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা। আর এর জন্য ওয়াসার ব্যয় হচ্ছে ৩৩ কোটি টাকা। সকল খরচ বাদ দিয়ে বছরে নিট লাভ করছে প্রায় ১৩২ কোটি টাকা। তবে সিস্টেম লস ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনতে পারলে আরো বেশি লাভ করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ওয়াসা সুত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে পানির সংকট তীব্র হওয়ায় কর্ণফুলী নদীর পানি শোধন করার প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সহযোগিতায় ১ হাজার ৮৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে রাঙ্গুনীয়ার পোমরা এলাকায় প্রথমে নির্মিত হয় শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার ফেইস ১ নামে। যা ২০১৭ সালে উদ্বোধন করা হয়। এই প্রকল্পের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৪ কোটি ৩০ লাখ লিটার।
ফলে ওয়াসার উৎপাদন ক্ষমতা পৌছেছে ৩২ কোটি লিটারে। প্রকল্পটি সফলভাবে চালু হওয়ায় একই স্থানে শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার নামে ফেইস ২ এর প্রকল্প গ্রহণ করে। এটি জাপানের জাইকা, বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম ওয়াসার যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়েছে। এই প্রকল্পে মোট ব্যয় হয় ৪ হাজার ৪৯১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ধরা হলেও ৩০৮২ কোটি টাকায় প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে জাইকা ২২৭৪ কোটি ও বাংলাদেশ সরকার ৮০৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে।
ফেইস ১ ও ফেইস ২ এই দুইটি প্রকল্পের উৎপাদন ক্ষমতা ২৮ কোটি ৬০ লাখ লিটার হলেও গ্রাহক পর্যায়ে পৌছাতে পারছে ২৫ কোটি লিটার। বাকি প্রায় সাড়ে ৩ কোটি লিটার পানি সিস্টেম লস হিসেবে নষ্ট হচ্ছে। এই ২৫ কোটি লিটার পানি বিক্রি করে দৈনিক ৫০ লাখ টাকা হিসেবে বছরে ১৬৫ কোটি টাকা আয় করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এরমধ্যে মাসে ২ কোটি টাকা করে বছরে বিদ্যুৎ বিল বাবদ খরচ ২৪ কোটি, ক্যামিকেল ৫ কোটি, স্টাফ খরচ সাড়ে ৩ কোটি ও মেন্টেনেইস খরচ ৫০ লাখ টাকা হিসেব করে বছরে খরচ করছে ৩৩ কোটি টাকা। বছরে নিট লাভ করছে ১৩২ কোটি টাকা।
এই প্রকল্প ২টি বাস্তবায়নে মোট খরচ হয়েছে ৪৯৩০ কোটি টাকা। এরমধ্যে জাইকা থেকে শুন্য দশমিক শুন্য ১ টাকা হারসুদে লোন বাবদ নেয়া হয়েছে ৩২০০ কোটি টাকা। যা বছরে সুদের পরিমান দাঁড়ায় ৩২ লাখ টাকা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম জানান, ’কর্ণফুলী পানিশোধনাগার প্রকল্পের আওতায় রাঙ্গুনীয়ায় স্থাপিত ফেইস ১ ও ফেইস ২ শোধনাগার ২টি ওয়াসার মেগা প্রকল্প। শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দুরে এগুলোর অবস্থান। কর্ণফুলী নদী থেকে পানি উত্তোলন করে পরিশোধনের পর পাইপ লাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদে রিজার্ভার এবং হালিশহরে এলিভেটেড ট্যাংকের মাধ্যমে গ্রাহকদের মধ্যে পানি সরবরাহ করা হয়।
এই ২টি প্রকল্প থেকে বর্তমানে দৈনিক ২৮ কোটি ৬০ লাখ লিটার পানি উৎপাদন করা হচ্ছে। এর জন্য কণ্যফুলী থেকে দৈনিক ৩০ কোটি লিটার পানি তোলা হচ্ছে। খরচ বাদ দিয়ে বছরে প্রায় ১৩২ কোটি টাকা লাভ হচ্ছে। আগে সিস্টেম লস ছিল ৩৩ শতাংশ বর্তমানে তা কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আমরা আশা করছি সিস্টেম লস আরো কমানোর জন্য। সিস্টেম লস কমাতে পারলে লাভের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। তবে ওয়াসা মূলত একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। আমাদের মূল কাজ হচ্ছে সেবা ঠিকমতো দিতে পারছি কিনা। তবে আমরা যথাযথ সেবা দিয়ে ভালো পরিমাণ লাভ করতে পেরেছি। যা থেকে খরচ মেটানোর পরও লোন পরিশোধ করে ওয়াসার ফান্ডে টাকা জমা হবে।
২০১৭ সালের ১২ মার্চ ফেইস ১ এবং ২০২২ সালের ১৬ মার্চ ফেইস ২ প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ’২০১৬ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসার উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ১২ কোটি লিটার। চাহিদার তুলনায় তা খুব কম। এই প্রকল্প চালু হওয়ার পর পানির সংকট ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।
নগরীতে বর্তমানে ওয়াসার পানির চাহিদা দৈনিক ৫৮ কোটি লিটার কিন্তু ওয়াসা সরবরাহ করতে পারছে ৪৭/৪৮ কোটি লিটার। বর্তমানে ওয়াসার গ্রাহক আছে ৯৭ হাজার, এরমধ্যে শিল্প কারখানায় ৯ শতাংশ বাকিগুলো আবাসিক গ্রাহক। গ্রাহকের চাহিদার কথা বিবেচনা করে আরো ২০ কোটি লিটার পানি উৎপাদনের জন্য ২০২২ সালে মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি জমা দেয়া আছে। যেগুলো বাস্তবায়নে কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক অর্থায়নের জন্য সম্মত আছে।
আপনার মতামত লিখুন :