ডেস্ক রিপোর্ট : দোকানটিতে পাশাপাশি দুটি টি-শার্ট ঝুলিয়ে রাখা। কলারওয়ালা আর হাফহাতা টি-শার্ট দুটির একটিতে দাম লেখা ১ হাজার ৫০ টাকা, আরেকটিতে ৬৫০ টাকা। আরও রয়েছে নামী একটি ব্র্যান্ডের ট্যাগ। ঘেঁটেঘুঁটে দেখে একজন ক্রেতা টি-শার্ট দুটি পছন্দ করলেন। দোকানির কাছে জানতে চাইলেন, ‘দাম কি ফিক্সড?’ দোকানি ডানে-বাঁয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে জানালেন, না, দরদাম করা যাবে। ব্যাপক দরদামের পর ওই ক্রেতা টি-শার্ট দুটি কিনে নিলেন। প্রথমটির দাম পড়ল ৫৫০ টাকা। অন্যটি ৪০০ টাকা।
কেনাবেচার এই দৃশ্য দেখা গেল রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বর সেকশনের পল্লবী এ ব্লক এলাকার একটি মার্কেটে। এটা স্থানীয় লোকজনের কাছে ‘নান্নু মার্কেট’ নামে পরিচিত। মার্কেটের র্যাপিড ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে দোকানটির বিক্রয়কর্মী সিফাত রহমানের কাছে জানতে চাই, একদরে বিক্রি না করলে টি-শার্টের গায়ে দাম লেখা রয়েছে কেন?
জবাবে সিফাত বললেন, নামীদামি অনেক বিপণিবিতান বা বিক্রয়কেন্দ্রে (শোরুম) এসব টি-শার্ট একদরে বিক্রি হয়। তাই ওগুলোতে দাম উল্লেখ রয়েছে। কারখানা থেকেই সরাসরি এসব টি-শার্ট তাঁদের কাছে আসে। তাই তাঁরা কম দামে বিক্রি করতে পারেন।
শুধু মিরপুরের মানুষ নন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই কেনাকাটার জন্য নান্নু মার্কেটে আসেন। এমনকি ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে সময় করে এখানে আসেন, কেনাকাটা করেন। নান্নু মার্কেট মূলত বিদেশি ক্রেতাদের কাছে রপ্তানির জন্য দেশের বিভিন্ন কারখানায় তৈরি পোশাক সাশ্রয়ী দামে বিক্রির জন্য বেশ জনপ্রিয়। স্থানীয় বাজারের জন্য তৈরি পোশাকও এখন দোকানে দোকানে বিক্রি হয়। এখানে প্রায় ১৭০টি দোকান রয়েছে।
যেভাবে গোড়াপত্তন :
নাম নান্নু মার্কেট হলেও এই বিপণিবিতানের যাত্রা কোনো পরিকল্পিত বাণিজ্যিক প্রকল্প হিসেবে শুরু হয়নি। ধাপে ধাপে একটি উন্মুক্ত পার্কের জায়গায় এই মার্কেট গড়ে উঠেছে। জায়গাটি একসময় স্থানীয় শিশু-কিশোরদের খেলার জায়গা এবং খোলা স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরে ওই জায়গায় ছোটখাটো দোকান গড়ে উঠতে শুরু করে।
১৯৯৮ সালের দিকে এই জায়গায় ব্যবসায়ীরা অস্থায়ী দোকান বসাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে এটি একটি স্থায়ী মার্কেটে রূপ নেয়। মার্কেটটি নিয়ন্ত্রণ করতেন তৎকালীন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুর রউফ নান্নু। তাঁর নামেই ওই মার্কেট ‘নান্নু মার্কেট’ নামে পরিচিতি পায়। পরে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় লোকজনের অনেকে পার্ক দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও শেষ পর্যন্ত মার্কেটটি থেকে যায়। ক্রমেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম জমে ওঠে।
নান্নু মার্কেটে নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য জিনস ও গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, টি-শার্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি, পায়জামা, পালাজ্জো, টপস, লেগিংসসহ বিভিন্ন পোশাক পাওয়া যায়। গাজীপুর, আশুলিয়া বা সাভার এলাকায় বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানা থেকে এসব পোশাক আনা হয়।
এ ছাড়া খুবই সূক্ষ্ম ত্রুটির কারণে অনেক সময় পণ্যের সরবরাহ আদেশ বিদেশি ক্রেতারা বাতিল করে দেন। পরে সেসব পণ্য স্টক লটের ব্যবসায়ীরা কিনে বাইরে বিক্রি করেন। সেখান থেকে বাছাই করা কিছু পোশাক নান্নু মার্কেটের ব্যবসায়ীরা কিনে এনে বিক্রি করেন। স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য তৈরি পোশাকও এই মার্কেটে পাওয়া যায়।
নান্নু মার্কেটে নারী-পুরুষের জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জিনসের প্যান্ট পাওয়া যায়। গতকাল বুধবার মার্কেটের বিভিন্ন দোকান ঘুরে নামী ব্র্যান্ড লিভাইস, ডিজেল, কেলভিন ক্লেইন, গেস, জি-স্টার, আমেরিকান ইগল ব্র্যান্ডের জিনস প্যান্ট বিক্রি হতে দেখা গেল। মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, দরদামের পর তাঁরা পোশাক বিক্রি করেন। মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে জিনসের (ডেনিম) প্যান্ট মানভেদে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে কিছু প্যান্ট ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেল।
সিনতাহা ফ্যাশন নামে একটি দোকানে কিছু ক্রেতার ভিড় দেখা গেল। ক্রেতারা দোকানে জিনস-গ্যাবার্ডিন প্যান্ট আর শার্ট দেখছিলেন। তানভীর আলম নামের এক ক্রেতা বললেন, তিনি কয়েক সপ্তাহ আগে গ্যাবার্ডিন প্যান্ট কিনেছিলেন। আজ আবার এসেছেন। সঙ্গে দুজন বন্ধুও আছেন।
তানভীর ওই দোকান থেকে ৬০০ টাকায় একটি জিনসের প্যান্ট আর ১ হাজার টাকায় দুটি শার্ট কেনেন। তিনি বলেন, এই মার্কেটে এক্সপোর্ট কোয়ালিটির অনেক ভালো প্যান্ট-শার্টের পাশাপাশি নিম্নমানের জিনিসপত্রও আছে। দেখেশুনে কেনা লাগে। বাছাই করতে পারলে এই মার্কেটে কম দামে বেশ ভালো জিনিস কেনা যায়।
নান্নু মার্কেটের দোকানগুলোতে ১০০ টাকায়ও বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ছোট বাচ্চাদের হাফ ও ফুল প্যান্ট, টি-শার্ট, মেয়েদের টি-শার্ট, টপস। শিশুদের প্যান্ট-শার্ট পাওয়া যায় ২৫০ টাকার মধ্যে। এ ছাড়া কিছু ভালো মানের প্যান্ট ও শার্ট বিক্রেতারা ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি করেন।
ভাতিজা রাফসান ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রী মিতু আক্তারকে নিয়ে নান্নু মার্কেটে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছিলেন মেহেদী হাসান। মার্কেটের সামনেই দেখা হয় তাঁদের সঙ্গে। কেনাকাটা করে কয়েকটি ব্যাগ হাতে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা।
কী কিনলেন, জানতে চাইলে মেহেদী হাসান বলেন, ‘ছোট ভাইসহ কয়েকজন আত্মীয়ের জন্য পাঁচটি প্যান্ট কিনেছি। দাম পড়েছে ৩ হাজার ২০০ টাকা। তিনটি টি-শার্ট কিনেছি ৯০০ টাকা দিয়ে।’ নান্নু মার্কেটের দিনা ফ্যাশনওয়্যার নামে একটি দোকানে স্বজনের জন্য শার্ট পছন্দ করছিলেন গিয়াস উদ্দীন। তিন দশক তিনি কুয়েতে ছিলেন। এখন পরিবারের সঙ্গে মিরপুর-১৩ নম্বরে থাকছেন।
গিয়াস উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে দেশে এলে কেনাকাটার জন্য এই মার্কেটে আসতাম। এখানে ভালো মানের জিনিস তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যায়। এসব জিনিস দেশের বাইরের বিভিন্ন বিপণিবিতানে চড়া দামে বিক্রি হয়।’
দিনা ফ্যাশনে গিয়াস উদ্দীন যে শার্ট দেখছিলেন, সেটার মান ও দামের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল দোকানটির ব্যবস্থাপক জাস্টিন দেবনাথের কাছে। তিনি বলেন, শার্টটি ভালো মানের। এ ধরনের একেকটি শার্ট ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। সর্বনিম্ন ৬০০ টাকায়ও বিক্রি করা হয়। তবে বড় বিপণিবিতানে গেলে এই শার্ট দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকায় কিনতে হবে।
নান্নু মার্কেট থেকে শোরুমে :
নান্নু মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিছু ব্রোকার (দালাল) তাঁদের মার্কেটের দোকানে দোকানে ঘুরে দেখেন, কার দোকানে কী পণ্য আছে। সেগুলোর মান কেমন। এসব তথ্য সংগ্রহ করে তাঁরা ঢাকার বড় শোরুমগুলোকে দেন। পরে শোরুম কর্তৃপক্ষ রাজি হলে এখান থেকে পোশাক কিনে শোরুমে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ বিষয়ে নান্নু মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়েরের দাবি, ‘অনেক সময় আমাদের মার্কেট থেকে পোশাক কিনে নিয়ে গিয়ে বড় বড় শোরুমের ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন। বেছে বেছে আমাদের মার্কেট থেকে তাঁরা প্যান্ট-শার্ট নিয়ে যান।’
গত বছরের একটি উদাহরণ দিয়ে আবুল খায়ের বলেন, গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় আমেরিকান ইগল ব্র্যান্ডের ৪০ হাজার জিনস প্যান্ট বায়ার নেয়নি। এই প্যান্টগুলো মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে ব্যবসায়ীদের কাছে ছিল। সেগুলো সংগ্রহ করার পর বড় বড় মার্কেটে নিয়ে বিক্রি করা হয়েছে। নামীদামি ব্র্যান্ডের শোরুমেও নেওয়া হয়েছে।
আবুল খায়ের আরও বলেন, গত বছরের রোজার ঈদে নান্নু মার্কেটে প্রায় ২৫ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়েছিল।
প্রথম আলো থেকে নেয়া