শিরোনাম

প্রকাশিত : ০৯ আগস্ট, ২০২২, ০৫:১৩ সকাল
আপডেট : ০৯ আগস্ট, ২০২২, ০৫:১৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

তাপ সংবেদনশীলতার অতি উচ্চঝুঁকিতে ঢাকার ছয় থানা

ছবি: বণিক বার্তা

বণিক বার্তা: ঢাকার বাতাস ও ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। ২০০০ সাল থেকে পরের ২০ বছরে ঢাকার তাপমাত্রা যেকোনো গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ২ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। মূলত রাজধানীর জনসংখ্যার উচ্চঘনত্ব, কংক্রিটের আচ্ছাদন বেড়ে যাওয়া, জলাশয় ও সবুজায়ন কমে যাওয়াসহ বেশ কয়েকটি কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। জনবহুল এ নগরীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণার তথ্য বলছে, তাপ সংবেদনশীলতার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীর চকবাজার, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, লালবাগ, পল্লবী ও শ্যামপুর।

শহরের কোনো এলাকার তাপমাত্রা ও ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা পার্শ্ববর্তী গ্রাম্য এলাকার চেয়ে অতিরিক্ত হারে বেড়ে গেলে তখন সে অঞ্চলকে আরবান হিট আইল্যান্ড বা নগর দাবদাহ অঞ্চল বলে। রাজধানীর নগর দাবদাহ অঞ্চল এবং এর ঝুঁকির বিষয়গুলো নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি দল। গবেষণায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার ৪১টি থানাকে ঝুঁকি বিবেচনায় পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। এতে দেখা গিয়েছে, অতি উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে ছয়টি, উচ্চঝুঁকিতে ১১টি, মধ্যম ঝুঁকিতে ১১টি, নিম্নঝুঁকিতে পাঁচটি এবং অতি নিম্নঝুঁকিতে রয়েছে আটটি থানা। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার ৮৭ শতাংশই আরবান হিট আইল্যান্ড বা নগর দাবদাহ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে।

তাপ সংবেদনশীলতার ঝুঁকি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে হিট ভালনারেবিলিটি ইনডেক্স (এইচভিআই) ব্যবহার করা হয়েছে। গত তিন দশকের তথ্য নিয়ে ২৬টি মৌলিক উপাদানের ভিত্তিতে এ সূচক তৈরি করা হয়। এতে থানা পর্যায়ের জনসংখ্যা, আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত দিকগুলো বিবেচনায় নেয়া হয়। গবেষণায় তাপ সংবেদনশীলতার ঝুঁকির কারণ হিসেবে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জনসংখ্যার উচ্চঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণের প্রভাব, পানিস্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও দরিদ্রতাকে দায়ী করা হয়েছে। স্যাটেলাইট ছবি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়।

গবেষণায় বলা হয়েছে, তাপ সংবেদনশীলতার অতি উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে চকবাজার থানায় মাত্র দশমিক ৬০ শতাংশ গাছপালা রয়েছে। আর জলাশয় রয়েছে দশমিক ৪১ শতাংশ। নেই কোনো কৃষিজমি, যা তাপপ্রবাহের জন্য অতি উচ্চঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া যাত্রাবাড়ী, কদমতলী ও শ্যামপুরে গাছপালা রয়েছে ৫ শতাংশেরও কম। লালবাগ ও পল্লবী থানায় কৃষিজমি, জলাশয়, অব্যবহূত ভূমি ও গাছপালা অতিমাত্রায় কম রয়েছে। ফলে অতি উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে এসব থানাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এদিকে তাপ সংবেদনশীলতার উচ্চঝুঁকিতে থাকা ১১টি থানার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাছপালা রয়েছে শাহবাগ থানায়। প্রায় ৪০ শতাংশ গাছপালা থাকলেও জলাশয় রয়েছে ২ শতাংশেরও কম। তবে বংশাল, গেন্ডারিয়া, কামরাঙ্গীরচর ও সূত্রাপুর থানায় কৃষিজমি ও গাছপালার পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। এছাড়া আদাবর, দক্ষিণখান, ডেমরা, খিলগাঁও, মিরপুর, রামপুরা, শাহবাগের গাছপালার পরিমাণও ৮ শতাংশের নিচে। এসব এলাকায় জলাশয় ও কৃষিজমির পরিমাণও কম। ফলে এ থানাগুলোকে তাপ সংবেদনশীলতার উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে বাড্ডা, দারুসসালাম, হাজারীবাগ, কাফরুল, কলাবাগান, খিলক্ষেত, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল, রমনা, শাহ আলী ও উত্তরখান থানা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪১ দশমিক ৫২ শতাংশ গাছপালা রয়েছে শাহ আলী থানায়। হাজারীবাগ ও কলাবাগান থানায় ৫ শতাংশেরও কম গাছপালা রয়েছে। এছাড়া দারুসসালাম, রমনা, খিলক্ষেত ও বাড্ডা থানায় ৫ শতাংশ বা তার বেশি জলাশয় রয়েছে।

এছাড়া গবেষণা বলছে, জনসংখ্যার উচ্চঘনত্ব, নগরায়ণের প্রভাব, পানিস্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও দরিদ্রতা থাকলেও শিক্ষার হার, বিদ্যুৎ, রাস্তা, স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান ও সবুজায়নের কারণে তাপ সংবেদনশীলতার ঝুঁকি কমে যায়। তাপ সংবেদনশীলতার নিম্নঝুঁকিতে রয়েছে ক্যান্টনমেন্ট, গুলশান, কোতোয়ালি, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও তুরাগ থানা। এর মধ্যে গুলশান ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় গাছপালা যথাক্রমে ২০ ও ২৫ শতাংশ। তুরাগ থানায় ২০ শতাংশ কৃষিজমি ও ১৬ শতাংশ জলাশয় রয়েছে।

আর অতি নিম্নঝুঁকিতে রয়েছে তেজগাঁও, উত্তরা, শেরেবাংলা নগর, সবুজবাগ, পল্টন, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি ও বিমানবন্দর থানা। এসব এলাকায় মূলত জলাশয়, গাছপালা, অব্যবহূত ভূমি ও কৃষিজমির পরিমাণ অন্যান্য এলাকার চেয়ে তুলনামূলক বেশি।

গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে শহরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া না হলে ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকার এসব এলাকা ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়বে। ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ২০ দশমিক ৫২ শতাংশ নগরায়ণ বেড়েছে। ফলে বাড়ছে ঢাকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও। এতে তৈরি হচ্ছে তাপ সংবেদনশীলতার ঝুঁকি। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যের ওপর। মানুষ হিট স্ট্রোক, নানা ধরনের সংক্রামক রোগ এবং বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সাময়িকী সাসটেইনেবল সিটিজ অ্যান্ড সোসাইটিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে রাজধানী ঢাকার দিনের তাপমাত্রা পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ২ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়।

‘অ্যাসাসিং দ্য স্পেশাল ম্যাপিং অব হিট ভালনারেবিলিটি আন্ডার আরবান আইল্যান্ড ইফেক্ট ইন দ্য ঢাকা মেট্রোপলিটন এরিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মাল্টিডিসিপ্লিনারি ডিজিটাল পাবলিশিং ইনস্টিটিউট (এমডিপিআই) জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

ঢাকার তাপ সংবেদনশীলতার ঝুঁকির পেছনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমি ভরাট ও গাছপালা কেটে ফেলাকে দায়ী করছেন গবেষকরা। গবেষণা দলের সদস্য ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. আবু রেজা মো. তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার তাপ সংবেদনশীলতার ঝুঁকি নিয়ে এটাই প্রথম গবেষণা। এতে মূলত ভবিষ্যতে কী হতে পারে তার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন তারা যেন এ এলাকাগুলোকে গ্রিন মডেল টাউন বা উপশহর হিসেবে তৈরি করার পরিকল্পনা করেন। তবে সেটা টেকসই হতে হবে। টেকসই পরিকল্পনার ঘাটতি যেসব স্থানে আছে সেগুলোকে কীভাবে উন্নতি করা যায় সে বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। মানুষের ঢাকামুখী প্রবণতার সরাসরি প্রভাব পড়ছে সবুজায়নের ওপর। ফলে আরবান হিট আইল্যান্ড তৈরি হচ্ছে।

আরবান হিট আইল্যান্ডের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, এর প্রধান প্রভাব হচ্ছে এসব এলাকার মানুষের মধ্যে অস্বস্তি বাড়বে। ফলে হিট স্ট্রোক হতে পারে। এ অস্বস্তির কারণে যাদের সামর্থ্য আছে তারা তাপ থেকে বাঁচতে ভবন ও গাড়িতে এসি ব্যবহার করে। ফলে এসির নির্গত হাওয়া বাইরের অঞ্চলের তাপ আরো বাড়িয়ে দেবে। এর প্রভাব পড়বে শ্রমিক বা নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। এতে অসুস্থতা যেমন বাড়বে, মানুষের মৃত্যুও বাড়বে। পানির স্তর নেমে যাবে। পানির মান খারাপ হবে। ফলে সুপেয় পানির সংকট দেখা দেবে। অনিরাপদ পানি পানের কারণে কলেরা ও ডায়রিয়ার মতো রোগ বাড়বে। একটি শহরে ন্যূনতম ১৫-২৫ শতাংশ উন্মুক্ত জায়গা থাকতে হয়। ১০-১৫ শতাংশ যোগাযোগের জন্য সড়ক ব্যবস্থা থাকতে হয়। উন্মুক্ত বলতে পার্ক, খেলার মাঠ, চিড়িয়াখানাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ জায়গার পর্যাপ্ত ব্যবহার নিশ্চিত হবে। ঢাকায় যদি রমনা পার্কের মতো ১০টি পার্ক তৈরি করা যায় তাহলে এ ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে। প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করতে হবে। এগুলো নগর পরিকল্পনার অংশ। কিন্তু এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন আমাদের শহরে নেই।

তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটলে বিভিন্ন রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা বেড়ে যায় বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি  বলেন, যেকোনো স্থানে একটি বাস্তুসংস্থানতন্ত্র গড়ে ওঠে। তাপমাত্রা এর অন্যতম বড় প্রভাবক। তাপমাত্রার পরিবর্তন এ বাস্তুসংস্থানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। সাধারণত ক্ষতিকারক, অক্ষতিকারক ও সুবিধাভোগী তিন ধরনের রোগ-জীবাণু পরিবেশে বাস করে। সুবিধাভোগী রোগ-জীবাণু সাধারণ অবস্থায় কোনো রোগ তৈরি করে না। তবে যখনই পরিবেশের কোনো পরিবর্তন হয় তখন মানুষ বা প্রাণীর ওপর আক্রমণ করে। তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে মশার প্রজনন বেড়ে যেতে পারে। আমরা দেখছি, এরই মধ্যে ঢাকায় মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বায়ুদূষণ যেন না ঘটে এ ব্যাপারে সরকার ও মানুষকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে তাত্ক্ষণিক, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। তা না হলে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হবে।

এ সমস্যার সমাধানে উন্মুক্ত স্থান, জলাধার ও সবুজায়ন নিশ্চিত করা এবং এর পুনরুদ্ধারে পরিকল্পনা হাতে নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, জনসংখ্যার ঘনত্ব নিরসন একমাত্র সমাধান নয়। সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এখন ভাবতে হবে কীভাবে তাপ সংবেদনশীলতার ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। সরকারকে উন্মুক্ত স্থান, জলাধার ও সবুজায়ন রক্ষায় বরাদ্দ দিতে হবে। এ বিনিয়োগ হবে জনস্বাস্থ্যের বিনিয়োগ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) আমলাতান্ত্রিক সংগঠন থেকে সরিয়ে পেশাজীবী এবং নগর সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞদের সংগঠনে পরিণত করা যেতে পারে। তাহলে তারা এ বিষয়ে গবেষণার আলোকে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে পারবে। যতক্ষণ না এ বিষয়গুলো সংস্কার হবে ততদিন এ ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে না। বরং ঝুঁকি আরো বাড়বে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়