শিরোনাম

প্রকাশিত : ০১ আগস্ট, ২০২২, ০৬:২৩ সকাল
আপডেট : ০১ আগস্ট, ২০২২, ০৯:১৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

শিল্প ও কৃষি বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে

কর্ণফুলীর মোহনায় প্রতি কেজি পলিতে ৫৯ মাইক্রোপ্লাস্টিক

ছবি: সংগৃহীত

বণিক বার্তা: পরিবেশে বাড়ছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি। সম্প্রতি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর মোহনায় উদ্বেগজনক পরিমাণে মিলেছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র এ কণা। নদীটির প্রতি কেজি শুকনো পলিতে সর্বনিম্ন ২২ দশমিক ২৯ থেকে সর্বোচ্চ ৫৯ দশমিক ৫ মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে, যা মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর দেহে মিশে মানুষের জন্য তৈরি করছে প্রবল ঝুঁকি। মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পরিবেশের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম ওয়াসা ও ওই এলাকার শিল্প-কারখানাগুলোই এ দূষণের জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী।

‘স্পেশাল ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড রিস্ক অ্যাসেসমেন্টস ডিউ টু দ্য মাইক্রোপ্লাস্টিকস পলিউশন ইন সেডিমেন্টস অব কর্ণফুলী রিভার এসচুয়ারি, বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। গত ২০ মে স্প্রিংগার নেচারের সায়েন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালে গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। গবেষকরা বলছেন, কর্ণফুলী নদীর মোহনার পলিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রাচুর্য, বিচরণ, ধরন ও ঝুঁকি নির্ণয়ের জন্য এটাই প্রথম গবেষণা।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রিফাত জাহান রাকিব ও অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বিল্ট এনভায়রনমেন্ট স্কুলের শিক্ষার্থী মো. বেলাল হোসাইন যৌথভাবে এ গবেষণাকর্মটি পরিচালনা করেন। এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও ব্রুনাই থেকে আরো ১০ জন গবেষক এতে অংশ নেন। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মে মাসে গবেষণাটি সম্পন্ন করা হয়।

প্রথমে নমুনা হিসেবে কর্ণফুলী নদীর পাড়ের ৩০টি জায়গা থেকে পলি সংগ্রহ করা হয়। পরে সেই নমুনা প্রক্রিয়াজাত করে ল্যাবে বিশ্লেষণ করেন গবেষকরা। নমুনা থেকে অত্যাধুনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংখ্যা গণনা করেছেন তারা। এছাড়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের ধরন নির্ধারণ করেছেন, যেখানে পলিইথিলিন টেরেফথালেট, পলিস্টাইরিন, পলিইথিলিন, সেলুলোজ এবং নাইলনের মতো পলিমারের উপস্থিতি পেয়েছেন তারা। আকার, আয়তন ও রঙের প্রাধান্যের দিক থেকে বলতে গেলে পলিতে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে ফিল্ম ৩৫ শতাংশ, হোয়াইট ১৯ শতাংশ এবং ১-৫ মিমি ৩০ দশমিক ৩৮ শতাংশ। সংগ্রহ করা নমুনা থেকে মোট ১ হাজার ১৭৭টি মাইক্রোপ্লাস্টিক পেয়েছেন তারা। পাশাপাশি মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিবেশগত ঝুঁকিও নির্ধারণ করেছেন।

পলিউশন রিস্ক ইনডেক্স, পলিমার রিস্ক ইনডেক্স, কনটামিনেশন ফ্যাক্টর ও পলিউশন লোড ইনডেক্স দিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকের যে পরিবেশগত ঝুঁকি গবেষকরা নির্ণয় করেছেন, সেখানে স্কোর ১৫০-এর নিচে থাকা জায়গাগুলো কম ঝুঁকিপূর্ণ। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, নমুনা সংগ্রহের ৩০টি জায়গার মধ্যে ২৯টিতেই স্কোর ১৫০-এর চেয়ে কম। তবে এক জায়গার পলিউশন রিস্ক ইনডেক্স স্কোর ৬০১ দশমিক ৫৩। ওই জায়গাটিকে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন গবেষকরা। সেখানে একটি নর্দমার মুখ রয়েছে এবং পাশের বেশির ভাগ জমিই কৃষিকাজে ব্যবহূত হয়। এছাড়া বাকিদের গড় স্কোর ৪৩ দশমিক ৫৫। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এখন ঝুঁকির পরিমাণ কিছুটা কম থাকলেও সব জায়গা মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে দূষিত হয়েছে।

নদীর পাড়ে শিল্প-কারখানার ময়লা, কৃষি বর্জ্য, গৃহস্থালি, মাছধরা ও চট্টগ্রাম শহরে বসবাসকারীদের কাছ থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক আসছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। নদীর পলিতে যে পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক পেয়েছেন, তাতে তারা মনে করছেন স্রোত প্রবাহের জায়গায় এ ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ আরো বেশি রয়েছে।

এ বিষয়ে হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, কর্ণফুলী নদীর এ দূষণের জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সম্পূর্ণভাবে দায়ী। চট্টগ্রাম ওয়াসার কোনো পয়োনিষ্কাশন পদ্ধতি নেই। চট্টগ্রাম ওয়াসার ৬০-৭০ লাখ মানুষের বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। দূষণমুক্ত করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেরও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু করা দরকার। অসংখ্য শিল্প-কারখানার বর্জ্যও চলে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। কর্ণফুলী নদীর পাশে যে শিল্প-কারখানা আছে সেগুলোকে ইটিপি ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য করা দরকার। এ ধরনের দূষণ বুড়িগঙ্গা নদীতে দেখা যায়, কিন্তু জোয়ার-ভাটা থাকায় কর্ণফুলী নদীতে দেখা যায় না। মাইক্রোপ্লাস্টিকের এ দূষণের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য এমনকি গভীর জলের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কর্ণফুলী নদীবিষয়ক গবেষক ইদ্রিস আলী  বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তাদের কোনো সুয়ারেজ ব্যবস্থা নেই। যার ফলে আমরা যে পলিথিন ব্যবহার করছি তা খাল ও নর্দমা হয়ে কর্ণফুলী নদীতে চলে আসছে। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরেই ১০০টিরও বেশি পলিথিন কারখানা রয়েছে। যারা পলিথিন উৎপাদন করছে এবং মানুষের ব্যবহার থেকেই এ পলিথিন প্রাণীর দেহে আসছে, যা আমাদের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। আমরা পলিথিন বন্ধে কাজ করেছি। দূষণ বন্ধে প্রশাসন থেকে উদ্যোগ নেয়া দরকার। কিন্তু তারা যে উদ্যোগ নিচ্ছে সেটা যথার্থ, ধারাবাহিক ও পরিপূর্ণ নয়। গবেষণাটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার পলিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অবস্থা নিয়ে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে, যা ভবিষ্যৎ গবেষণা, মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণ, দূষণ রোধ ও ব্যবস্থাপনায় ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে বলেই মনে করেন গবেষকরা।

মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণের বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম ওয়াসার কোনো ব্যবস্থা নেই। দূষণ দেখার জন্যও বিশেষজ্ঞ নেই আমাদের। ফলে আমাদের পক্ষে দূষণের বিষয়টি পর্যবেক্ষণের সুযোগ নেই। তবে দূষণ রোধে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যক্রম পরিচালনায় কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা প্রাথমিক আলোচনা করেছি। এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়