নোমান হাসান : খাদ্য সংকটে পড়েছে লকডাউনে থাকা চীন। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, চলতি মাসের মাঝামাঝি দেশটির বিভিন্ন শহরে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে জিরো সংক্রমণ নীতির কারণে দ্রুত কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, তারা পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ পাচ্ছেন না।
এমন পরিস্থিতিতে দেশটিতে চরম খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। চীন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মাও সেতুংয়ের আমলে যে মহাদুর্ভিক্ষ হয়েছিল, বর্তমান সময়ের খাদ্যসংকট চীনের সেই মহা দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালে দেশটিতে ৫ কোটি মানুষের দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারানোর সেই ভয়ঙ্কর আতঙ্কের দিনগুলির পদধ্বণি শুনতে পাচ্ছেন অনেকেই।
ভারতের নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অভাবে মাও-যুগে সঠিক তথ্য সরকারের কাছে পৌঁছাতোনা। বহু কৃষি খামার বা সমবায় খাদ্যশস্য উতপাদনে ব্যর্থ হলেও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতারা তা জানতেই পারেননি। আর তথ্যের অবাবই হয়ে দাঁড়ায় দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ।
শি জিনপিঙের আমলকে লোকে মনে রাখবেন ক্ষমতার অতি-কেন্দ্রীকরণ এবং এক হাতে সমস্ত ক্ষমতা অধিগ্রহণের জন্য। তিনিও তথ্যপ্রবাহের সমস্ত রাস্তা মাও-যুগের মতোই বন্ধ করে রেখেছেন। সামাজিক গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়ায় খাদ্য সঙ্কটের সঠিক চিত্র সরকারের পক্ষে জানাই সম্ভব হচ্ছেনা। কোভিড-১৯ এর লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় চলতি বছরের প্রথম দিকেই সাংহাইতে খাদ্য সঙ্কট তীব্র হয়। ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষের বাসভূমির সঙ্কট সহজেই মানুষের নজরে এলেও শিয়ান-সহ অন্যান্য বহু এলাকায় গ্রামাঞ্চলে চরম খাদ্য সঙ্কটের খবর অনেকের কাছেই পৌঁছায়নি।
সামাজিক গণমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, সাংহাইতে সাধারণ মানুষ খাবার সংগ্রহের জন্য বাইরে বার হতেই পারছেন না। ব্যালকনির থেকে স্থানীয়রা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন খাবারের দিকে। অথচ প্রশাসনিক কর্তারা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে। এই দৃশ্য ভাইরাল হতেই সামাজিক গণমাধ্যমের ওপর জারি হয়েছে কড়া বিধিনিষেধ।
খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাটাই এবারের লকডাউনে পুরোপুরি বিপর্যস্ত। ভিডিওতে ধরা পড়েছে খাবারের জন্য মানুষের হাহাকারের দৃশ্য। সুপার মার্কেটের বেশির ভাগ তাকই শূণ্য। অনলাইনে অর্ডার দিতে হলে সাংহাইয়ের মানুষকে মাঝরাতে উঠতে হচ্ছে। বহু মানুষ খিদের জ্বালা মেটাতে গিয়ে বিষাক্ত বস্তু খেয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। চীনের জনপ্রিয় সামাজিক গণমাধ্যম সিনা ওয়েবিও খাদ্য সঙ্কটের বাস্তব ছবি তুলে ধরতেই শুরু হয় নিষেধাজ্ঞা। মুছে ফেলা হয়েছে বহু পোস্ট। সঙ্কট মোকাবিলার বদলে প্রশাসন বেশি ব্যস্ত খবর ধামাচাপা দেয়ার কাজে।
চীনে এই খাদ্য সঙ্কটের আরেকটি বড় কারণ দুর্বল সরকারি ব্যবস্থাপনা। খাদ্য সরবরাহকারী গাড়িগুলিকে শহরে প্রবেশে বাধা দেয়া হচ্ছে। ফিনান্সিয়াল টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বহু গ্রামীণ এলাকাতেও এমন দানবিক কাজ চলছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের জিলিন, লিয়াওনিং এবং হেইলংজিয়াং-এর বহু গ্রামকে অতিমারি ঠেকাতে আবদ্ধ করে রাখায় তারা কৃষিকাজ ঠিকমতো করতেই পারেননি।
অথচ চীনের মোট ভুট্টা উতপাদনের ২০ শতাংশই হয় এই অঞ্চল থেকে। চাল আর ভুট্টার উতপাদন কম হওয়ায় আরও বেশি করে আমদানি নির্ভর হতে হয়েছে চীনকে।
কোভিড প্রতিরোধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বহু কৃষি ক্ষেত্র সার বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবে মারাত্মকভাবে মার খেয়েছে। জিলিনে স্বাভাবিকের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ শস্যও উতপাদিত হয়নি এবার। চীন সরকারের জনৈক উপদেষ্টার বরাত দিয়ে ফিনান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, সার ঠিকমতো না পৌঁছানোর কারণেই চীন খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে। কৌশলগত এবং আন্তর্জাতিক স্টাডিজ কেন্দ্রের বক্তব্য অনুযায়ী চীনে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। ২০০৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চীনের খাদ্য আমদানির পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৪ বিলিয়ন ৭০ মিলিয়ন ডলার। অথচ খাদ্য রপ্তানি বেড়েছে ২০.২ বিলিয়ন থেকে মাত্র ৫৯.৬ বিলিয়ন। অর্থাত বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে খাদ্য আমদানি-রপ্তানিতে।
কোভিডের বিধি নিষেধ ছাড়াও লাগামছাড়া শিল্পায়নও খাদ্য সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০৫৯ সাল থেকে অন্তত ২০ শতাংশ আবাদি জমি চীনে গ্রাস করেছেন কলকারখানা।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশের তুলনায় চীনের আবাদ যোগ্য জমির পরিমান মাত্র ১০ শতাংশ। আমেরিকার মাথাপিছু ১.১৬ একর আবাদি জমির বিপরীতে চীনে মাথা পিছু আবাদি জমি মাত্র ০.২১ একর। এছাড়াও দূষণের কারণে চীনের ১৫ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানী ব্যবহারের অনুপোযুক্ত। হেনান প্রদেশে ৮০ লাখ একর জমিতে ভূমিদূষণের কারণে কোনও চাষ হচ্ছেনা।
চীনে খাদ্য সঙ্কট এতোটাই গুরুতর যে ২০২০ সালের আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং 'অপারেশন ক্লিন প্লেট' চালু করতে বাধ্য হন। এই নির্দেশ বলে হোটেলে ক্রেতারা কোনও খাবার নষ্ট করতে পারবেনা। পাতে উচ্ছিস্ট থাকলে ক্রেতাদের জরিমানা করা হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে শোনা যাচ্ছে আর্জেন্টিনা ও কলম্বিয়ার জমিতে চাষাবাদ করে সেখান থেকে উতপাদিত ফসল দেশে নিয়ে আসার চিন্তাভাবনা করছে চীন।
অবশ্য খাদ্য সঙ্কট থাকুক বা না থাকুক শি জিনপিং স্থায়ী একনায়ক হিসাবে নিজের গদি আগলে রাখার সঙ্গে কোনও আপোষ করবেন না। টানা তিন বার ক্ষমতা দখলের পর এবারও তার একটাই চেষ্টা, নিজের একনায়কতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করে রাখা। তাই জিরো-কোভিন নীতিতে কোনও পরিবর্তন আসছেনা।
চলতি বছরের শুরুতেই জনগণকে বেশি করে খাদ্যসামগ্রী মজুদ রাখাতে বলা হয়। ফলে বিভ্রান্তি আরও বাড়ছে। অনেকের আশঙ্কা, তাইওয়ান নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে চীন। কারণ সেখানে সেনা ততপরতা বেড়েছে।
চীন বিষয়ক পর্যবেক্ষকদের মতে, সামগ্রিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ক্ষেত্রে শি জিনপিং মাও সেতুঙকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন। নির্ভরযোগ্যতা এবং আনুগত্য এখন শেষ কথা বলে চীনে। ফলে যোগ্যতা বা দক্ষতার কোনও দাম নেই। তাই কোভিড পরিস্থিতিতে লকডাউন ব্যবস্থপনায় এতো ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
শি জিনপিং এখন মাও সেতুঙের মতোই গোটা দুনিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। অতীতে মাও নিজের স্বপ্নকে স্বার্থক করতে গিয়ে দেশকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ উপহার দিয়েছেন। শি-ও একই পথে হাঁটছেন। সাবেক চীনা রাষ্ট্রপ্রধান দেং জিয়াওপিং, জিয়াং জেমিন এবং হু জিনতাও-দের আর্থিক নীতির বিপরীত পথে চলতে গিয়ে শি জিনপিং চীনের জন্য বিপদ ডেকে আনছেন বলে চীনা বিশেষজ্ঞরা একমত। তাঁদের সাফ কথা, একুশ শতকে দাঁড়িয়ে মাওয়ের চিন্তাভাবনাকে কার্যকর করার চেষ্টা বোকামিরই নামান্তর।
লেখক, সিনিয়র সাংবাদিক নোমান হাসান
আপনার মতামত লিখুন :