ইউএনবি নিউজ: সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত একজন ব্যক্তি কোনো অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলেন না, ধূমপান করলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি রোগাক্রান্ত হলেন! কারণ আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে এক নীরব ঘাতক।
ধরাছোঁয়ার বাইরে, কিন্ত আমাদের শরীর ও মন কোনোকিছুই রেহাই পাচ্ছে না এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে। হৃদরোগ, টাইপ ২ ডায়াবেটিস, এমনকি মস্তিস্ক থেকে স্মৃতি হারিয়ে যাওয়ার মতো শারীরিক ক্ষতি করতে পারে এই ঘাতক।
এই নীরব ঘাতক কোনো অস্ত্র কিংবা বিষ নয় বরং এটি শব্দ দূষণ। এটি শুধু যে শ্রবণশক্তি কমিয়ে দেয় তা নয়, এটি মানবদেহে নানা ক্ষতি করে থাকে।
অবাক করার মতো বিষয় হলো আমাদের রাজধানী ঢাকা বিশ্বে শব্দ দূষণের শীর্ষে অবস্থান করছে। ঢাকা শহরে রাস্তায় নামলে মাঝে মাঝে মনে হয়, গাড়ি চালকেরা যেন হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কোনো কিছু সামনে পড়ে গেলেই কানফাটা শব্দে বেজে উঠছে হর্ন।-খবর বিবিসির
এছাড়া নানা উৎসব আয়োজনে উচ্চশব্দে গান বাজানো, নির্মাণ কাজ, গ্রিল-টাইলস কাটা, মেশিনে ইট ভাঙা, নানা প্রচারণায় মাইক বাজানো, জেনারেটরের শব্দে কানের অবস্থা নাজেহাল হয়ে যায়। এই শহরের মানুষ বাধ্য হয়েই এই শব্দের তাণ্ডবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। কিন্তু এই শব্দদূষণ কীভাবে আমাদের ক্ষতি করছে, তা আমরা সবাই জানি তো?
সেন্ট জর্জেসের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক শার্লট ক্লার্ক বলেছেন, ‘শব্দদূষণ এমন একটি জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা, প্রচুর মানুষ এই সমস্যায় পড়ে থাকেন। কিন্তু এমন একটি সমস্যা নিয়ে আমরা খুব কমই কথা বলি।’
শব্দদূষণ কখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে, সেটি কিভাবে মানুষের ক্ষতিসাধন করে, তা জানতে অনুসন্ধান চালিয়েছেন বিবিসির এক সাংবাদিক জেমস গ্যালাঘের। এ সময় তিনি কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন, এই ঘাতকের হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় আছে কিনা সে উত্তরও খুঁজে দেখেছেন।
প্রথমেই জেমস অধ্যাপক ক্লার্কের সঙ্গে একটি সম্পূর্ণ নিঃশব্দ ল্যাবরেটরিতে যান। সেখানে তিনি নানা পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান কোন ধরনের শব্দে মানবশরীর কেমন প্রতিক্রিয়া জানায়। এজন্য তাকে মোটা স্মার্টওয়াচের মতো যন্ত্র পড়ানো হয়।
সাধারণত এই কাজে হার্টরেট মনিটর (যা হৃদস্পন্দন পরিমাপ করে), গ্যালভানিক স্কিন রেসপন্স (ত্বকের ঘাম থেকে স্নায়বিক উত্তেজনা পরিমাপ করে), ইলেকট্রোএনসেফালোগ্রাফি (অ্যামিগডালার সক্রিয়তা পরিমাপ করে) ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
যন্ত্রটি জেমসকে পরানোর পরে তাকে ঢাকার যানজটের সময় রেকর্ড করা ভিন্ন পাঁচটি শব্দ শোনানো হয়। তিনি জানান, ‘তীব্র এক যানজটের মধ্যে রয়েছেন— এমন মনে হচ্ছিল তার। তার পরিহিত যন্ত্রের সেন্সরে এই শব্দের কারণে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার রেকর্ড হয়। শুধু তাই নয়, ঘামছিলেনও।’
অধ্যাপক ক্লার্ক বলেন, ‘এই পরীক্ষা প্রমাণ করে শব্দ মানুষের হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে। কারণ উচ্চশব্দে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।’
জেমস জানান, ‘ঢাকার ওই পাঁচটি শব্দের মধ্যে বাচ্চাদের খেলা করার সময়ে আনন্দপূর্ণ কোলাহলের শব্দটি তার শরীরে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, বাকি কুকুরের ঘেউ ঘেউ কিংবা গভীর রাতে অন্য বাসায় উচ্চশব্দে গান বাজানোর শব্দে তার শরীরে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
কিন্তু একেক রকম শব্দে কেন শরীর ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া করে জানতে চাইলে ক্লার্ক বলেন, ‘আমাদের শরীর শব্দ সংবেদনশীল। রাগ, উত্তেজনা, ভয়ের মতো শব্দেও শরীর প্রতিক্রিয়া করে।’
ক্লার্ক জানান, ‘কানই প্রথমে যেকোনো শব্দ গ্রহণ করে। এরপর সেটি ককলিয়ার নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠায়। এরপর অ্যামিগডালা নামে মস্তিস্কের একটি অংশ এই শব্দ চিহ্নিত করে প্রতিক্রিয়া জানায়।’
যখনই কোনো উচ্চমাত্রার শব্দ মস্তিষ্কে পৌঁছায়, এরপর অ্যামিগডালা সেটি শনাক্ত করলে তা আমাদের নার্ভার্স সিস্টেমকে সক্রিয় করে তোলে। এতে শরীরে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়।
প্রথমদিকে এতে ক্ষতি না হলেও কয়েকবছর ধরে একইরকম শব্দ শুনতে থাকলে তা মানুষের রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের হার বৃদ্ধি করে। ফলে হার্ট অ্যাটাক, উচ্চরক্তচাপ, লেভেল ২ ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি সৃষ্টি করে বলে জানান অধ্যাপক ক্লার্ক। তাছাড়া এটি শ্রবণশক্তিও কমিয়ে দেয় বলে জানান তিনি।
আরও আশঙ্কার কথা হলো, আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখনও শব্দ ঠিক একইভাবে আমাদের ক্ষতি করে। ক্লার্ক বলেন, ‘মানুষের কান সদা জাগ্রত। তাই আমরা ঘুমিয়ে থাকলেও শব্দ শুনতেই থাকি। একারণে আশপাশে উচ্চশব্দ থাকলে তা ঘুমন্ত অবস্থাতেও ক্ষতি করে।’
আসলে শব্দদূষণ একটি অবাঞ্ছিত বিষয়। ধরুন, আপনার পাশের বাড়িতে কারো বিয়ে, তারা আনন্দ করতে গান বাজাচ্ছে। এই আনন্দ তাদের পাশাপাশি অন্যদেরও ক্ষতিসাধন করে চলে। আর এটি আমরা বুঝতেই পারি না, আবার নিজে বুঝলেও অন্যকে বুঝাতে পারি না।
বিবিসির প্রতিবেদনে শব্দদূষণে ক্ষতির শিকার কয়েকজন ভুক্তভোগীর কথা উঠে এসেছে। জেমসের কাছে দেওয়া সাক্ষাতকারে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন স্পেনের বার্সালোনার ভিলা দে গ্রাসিয়া এলাকারনিবাসী কোকো।
তিনি জানান, ‘ইতোমধ্যেই বুকের ব্যথা নিয়ে দুইবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তার বাসার আশপাশের উচ্চ শব্দের কারণেই এই সমস্যা হচ্ছে বলে কোকোর ধারণা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্য শব্দদূষণ সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনাকারী গবেষক ড. মারিয়া ফোরাস্টারের মতে, শুধু ট্র্যাফিক শব্দের কারণে বার্সেলোনায় প্রতি বছর আনুমানিক ৩০০টি হার্ট অ্যাটাক ও ৩০টি মৃত্যু ঘটে।
ড. মারিয়া জানান, ইউরোপে প্রতিবছর ১২ হাজারের মতো অকাল মৃত্যু, নিদ্রাহীনতা ও নানা ধরনের মানসিক সম্যসার সঙ্গে শব্দদূষণ জড়িত। ৫৩ ডেসিবলের বেশি মাত্রার শব্দই হার্টের জন্য ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মারিয়া বার্সোলোনার একটি সড়ক ঘুরিয়ে দেখান জেমসকে, যেখানে শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবলের চেয়ে কম। তিনি জানান, এই এলাকার যানবাহনগুলো ধীরে চলার কারণে ও অতিরিক্ত হর্ণ না বাজানোর কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়াও সড়কের পাশ পথচারীদের হাঁটার জায়গা, ক্যাফে ও ফুলের বাগানের জন্য ফাঁকা জায়গা রয়েছে। কিছু শব্দ যে আমাদের জন্য ভালো তাতো জেমস তিনি ল্যাবরেটরিতে বুঝতে পেরেছিলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, ৬৫ ডেসিবেল (ডিবি) এর উপরে শব্দের মাত্রা দূষণ হিসাবে বিবেচিত হয়। যার মধ্যে ৭৫ ডিবি ক্ষতিকারক এবং ১২০ ডিবি সরাসরি যন্ত্রণাদায়ক। ২০১৮ সালে ডব্লিউএইচও স্বাস্থ্যগত কারণে ট্র্যাফিক শব্দকে ৫৩ ডিবিতে সীমাবদ্ধ করার সুপারিশ করেছিল।
বাংলাদেশে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, নীরব এলাকায় গ্রহণযোগ্য শব্দসীমা দিনের বেলায় ৫০ ডেসিবেল এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল। আবাসিক এলাকায় দিনের জন্য ৫৫ ডিবি এবং রাতের জন্য ৪৫ ডিবি। মিশ্র অঞ্চলে দিনের জন্য ৬০ ডিবি এবং রাতের জন্য ৫০ ডিবি। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনের জন্য ৭০ ডিবি এবং রাতের জন্য ৬০ ডিবি এবং শিল্পাঞ্চলে দিনের জন্য ৭৫ ডিবি এবং রাতের জন্য ৭০ ডিবি।
কিন্তু, ঢাকার বাসিন্দারা প্রতিদিন বাসাবাড়িতে, কর্মস্থলে, স্কুল এমনকি হাসপাতালগুলোতে বিপজ্জনক মাত্রার শব্দের সম্মুখীন হচ্ছেন। শব্দদূষণ কেন এত বৃদ্ধি পাচ্ছে— এই প্রশ্নের উত্তরে জেমসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, নগরায়নের ফলের শহরগুলোতে এই সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নিয়মিতই সম্প্রসারণ ঘটছে মেগাসিটি ঢাকার। এটি বিশ্বের অন্যতম বর্ধনশীল নগরী। যার ফলে যানবাহন বৃদ্ধি পাচ্ছে ঢাকায়। আর হর্ন বাজানো সম্ভবত ঢাকার গাড়ি চালকদের একটি বড় বদভ্যাস। ট্রাফিক সিগনাল ও জ্যামে আটকে থাকার সময় সামনে এগনো যাবে না জেনেও হর্ন বাজান তারা।
ঢাকার শহরের এই শব্দদূষণ প্রতিরোধ করতে আন্দোলন করে অনেকের নজর কেড়েছেন শিল্পী মোমিনুর রহমান রয়াল। তিনি ‘একাকী নায়ক’ নামে পরিচিত। তিনি প্রতিদিন ঢাকার কোনো এক ব্যস্ত সড়কে ১০ মিনিট একটি হলুদ প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রচণ্ড শব্দে হর্ণ বাজানো বন্ধ করতে তিনি এই কাজ করে থাকেন।
শুধু ঢাকাই নয়, তিনি সমগ্র বাংলাদেশ থেকেই এই উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো বন্ধ করতে চান। শব্দ দূষণের জন্য তিনি কেবল মানুষকেই দায়ী করেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, তিনি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর শব্দদূষণের প্রভাব নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, ‘দুয়েক বছরের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, তবে ঢাকার শব্দদূষণ অব্যশই কমিয়ে আনা সম্ভব। কম শব্দে মানুষ যখন ভালো অনুভব করবেন, তখন নিজেরাই তাদের অভ্যাস পরিবর্তন করবেন।’
তবে শব্দদূষণ দূর করা কঠিন, জটিল ও চ্যালেঞ্জপূর্ন বল মন্তব্য করেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা। এদিকে শব্দ দূষণকে ‘এক নীরব ঘাতক ও ধীরে কাজ করা বিষ’ বলে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের অধ্যাপক ড. মাসরুর আবদুল কাদের।