শিমুল চৌধুরী ধ্রুব: কিছুদিন আগে অভিনয় শিল্পী সংঘের একটি অনুষ্ঠানে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিরো আলম প্রসঙ্গে নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়েছি। আর সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একজন মানুষের উত্থান হয়েছে।’ এ মন্তব্য ছড়িয়ে পড়তেই শোরগোল শুরু হয় নানা মাধ্যমে। ইতোমধ্যে অনেকে নানা কথা বলেছেন। কেউ হিরো আলমের পক্ষে, আবার কেউ মামুনুর রশীদের পক্ষে। সেসবের মধ্যে অধিকাংশই ছিল বর্ষীয়ান অভিনেতার মতের পক্ষ। তার করা মন্তব্য ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ ও ‘হিরো আলম’ প্রসঙ্গে এবার কথা বললেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন।
২৭ মার্চ (সোমবার) ফেসবুক ভেরিফায়েড প্রোফাইলে দেয়া পোস্টে তিনি লেখেন, ‘রুচির দুর্ভিক্ষ আচমকা আকাশ থেকে পড়ে না। প্রথমে খরায় বা বন্যায় রুচির উৎপাদন নষ্ট হয়। তারপর শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। খরা এবং বন্যা মূলত তৈরি করে তারাই, যারা রুচির চাষ করে। তাদের তখন যথেষ্ট সময় নেই রুচি উৎপাদনের জমিকে উর্বর রাখার, তারা ব্যক্তিগত গোলার ফসল নিয়েই বা সাফল্য নিয়েই তখন তৃপ্ত।’
এ লেখিকা লেখেন, ‘রুচিকৃষকদের যখন মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়, তখনই রুচির পতন শুরু হয় আর তখনই অরুচির উত্থান শুরু হয়। রুচির পতন আজ থেকে হচ্ছে না, অন্তত তিরিশ বছর ধরে তো হচ্ছেই। শহর নগর বন্দর আর গ্রাম গঞ্জের যাত্রা পালা, কবিগান, বাউলগান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মহল্লায় মহল্লায় রবীন্দ্র নজরুল সুকান্তের জন্ম জয়ন্তী পালন, ফ্রি সপ্তাহে নাচ গান আবৃত্তি আর নাটকের অনুষ্ঠান- সব কিছুকে বিদেয় করে যখন সামিয়ানা টাঙিয়ে কোরান তেলোয়াত, মিলাদ আর ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন শুরু হয়ে গেল দেশ জুড়ে, তখন রুচিকৃষকেরা মুখ বুজে ছিলেন, উর্বর জমি নীরবে পাচার করেছেন অরুচির ব্যবসায়ীদের কাছে। যে রুচিবান শিল্পীরা মশাল হাতে দাঁড়িয়েছিল, তাদের মশাল এক এক করে অরুচির ব্যবসায়ীরা নিভিয়ে দিয়েছে, তাদের খুন হয়ে যেতে দেখেছেন রুচিকৃষকেরা, তাদের নির্বাসন দণ্ড দেখেছেন। তারপরও নিজেদের ক্ষুদ্র সাফল্যে আত্মমগ্ন থেকেছেন।
তিনি লেখেন, ‘আজ অরুচি আর মিথ্যেয় ঠাসা সমাজে নোংরা নষ্ট ওয়াজিরা, যে কোনও শিল্পী সাহিত্যিকের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। অরুচি উৎপাদক হিরো আলম রুচিবান ওয়াহিদুল হক বা মিতা হকের চেয়ে জনপ্রিয়। এর দায়ভার অবশ্যই রুচিকৃষকদের। আসলে রুচি আর অরুচি চিরকালই পাশাপাশি বাস করেছে। সভ্য সমাজে অরুচির ভূমিকা নিতান্তই গৌণ বা নগন্য। কোনও একদিন রুচিকে ছাপিয়ে অরুচি যখন সর্বত্র বিরাজ করে তখনই কিছু লোক নড়ে চড়ে বসে। অরুচি তখনই সর্বত্র বিরাজ করে, যখন তাকে সর্বত্র বিরাজ করতে দেওয়া হয়।’
তসলিমা আরো লেখেন, ‘রুচির দুর্ভিক্ষ শুধু অন্তরে নয়, বাহিরেও। রুচির পোশাককেও গ্রাস করে নিয়েছে অরুচি। শাড়ির ওপর আটের দশকে মেয়েদের চাদর চাপাতে বাধ্য করা হয়েছিল, একে মেনে নিল রুচিকৃষকেরা, শাড়ির ওপর হিজাব চাপানো হলো, এরপর বোরখা চাপানো হলো, এরপর নিকাব চাপানো হলো, এই পদ্ধতিতে শাড়ি হারিয়ে গেল, প্রকট হয়ে উঠলো নারীবিরোধী অপসংস্কৃতি, আর ভয়াবহ রুচিহীনতা। মুখ বুজে থাকাই, ভীরুতাই, নীরবতাই, উদাসিনতাই, দূরদৃষ্টিহীনতাই রুচিকে অরুচির ভাগাড়ে নিক্ষেপ করে।’
এসসিডি/একে
আপনার মতামত লিখুন :