বিনোদন ডেস্ক : প্রবাদ আছে- ‘নায়িকার ঘাঁটি খুলনার মাটি’। সত্যি তাই, চলচ্চিত্র ও নাটকে আসা বেশির ভাগ নায়িকাই দেশের এ দুই অঞ্চলের। সুচন্দা-ববিতা-চম্পা থেকে শুরু করে শাবনূর-মৌসুমী-পপি-কেয়া, এমনকি হালের পরীমণি-আঁচল-পূজা চেরী সবাই খুলনা অঞ্চলের। চলচ্চিত্রে খুলনার মেয়েরাই কেন বেশি?
ষাট-সত্তর-আশি ও নব্বই দশক মাতিয়ে রাখা অভিনেত্রী ববিতা বলেন, ‘আমরা খুব রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছি। তবে সংস্কৃতি আর শিক্ষাদীক্ষার দিক থেকে বাবা-চাচারা, বিশেষ করে আমার আম্মা ও চাচিরা ছিলেন উদার। ছোটবেলায় আমাদের কখনো বলা হয়নি যে নাটক বা সিনেমায় অভিনয় করতে হবে। যখন বড় হলাম, দেখলাম বাসায় সকাল বেলা গানের শিক্ষক, বিকাল বেলায় নাচের শিক্ষক আর সন্ধ্যায় আসেন ছবি আঁকার শিক্ষক। মনে আছে, এক দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেছি। আম্মা কয়েকবার ডাকার পরও যখন উঠিনি তখন চিকন একটা বেত নিয়ে আমাকে মারতে শুরু করলেন। কারণ কী, পরে জানলাম বাসায় গানের শিক্ষক এসেছেন। আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। পরিষ্কার করে বলতে গেলে আমাদের এলাকার মানুষ খুব সংস্কৃতিমনা। একটু খোঁজ নিলে দেখা যাবে এ অঞ্চলের মানুষ যত গরিবই হোক, বাসায় একটা হারমোনিয়াম বা ঢোল-তবলা আছে। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় খেলাধুলার পাশাপাশি একটা নাটক বা নাটিকা মঞ্চায়ন করা হয়। ছোটবেলায়ই এ অঞ্চলের মেয়েরা গান-বাজনা-অভিনয় শিখে ফেলে।’ চলচ্চিত্র নির্মাতা ছটকু আহমেদ বলেন, ‘নায়িকাদের যেমন চেহারা বা শারীরিক গঠন পছন্দ করে দর্শক সেটা খুলনার মেয়েদের সবচেয়ে বেশি আছে।
খুলনা থেকে আজ পর্যন্ত যত মেয়ে চলচ্চিত্রে এসেছে, অভিনয় প্রতিভার পাশাপাশি প্রত্যেকেরই চেহারা সুন্দর। কেউ কেউ বিখ্যাত তার হাসির জন্য, কেউ চঞ্চলতায়।’ এ নির্মাতার মতে, ভৌগোলিক কারণেই এখানকার মেয়েরা শুধু নয়, ছেলেরাও চলচ্চিত্রের জন্য পারফেক্ট। আমিন খান, শাকিল খান থেকে শুরু করে রিয়াজরাও খুলনার। এ এলাকা সমুদ্র উপকূলে হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েরা একটু ডানপিটে স্বভাবের হয়। যে কোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।’ ঢাকাই চলচ্চিত্রে আরও একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, সেটা হলো- ‘নায়িকা যদি খুলনার হয় তাহলে ছবি হিট!’ কেউ কেউ মজা করে বলেন, ‘খুলনার মাটি নায়িকার ঘাঁটি’। পরিসংখ্যানও সে কথাই বলে। যার সর্বশেষ প্রমাণ পরীমণি। প্রথম ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই ২৭টি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটা রেকর্ড। কী আছে পরীর মধ্যে? ‘অন্তর জ্বালা’র পরিচালক মালেক আফসারী বলেন, ‘পরী বলতে আমরা কল্পনায় যেমন নারীকে ভাবি, বাস্তবেও ঠিক তেমন দেখতে পরীমণি। সে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই আলাদা একটা রোশনাই চলে আসে। পর্দায় ওর মতো সুন্দরী নায়িকা দ্বিতীয়টি আর নেই। ওর হাসি, অভিনয়, চেহারা, তিনটি দিকই নজরকাড়া। আমার তো মনে হয় পরীকে এখনো সেভাবে কেউ কাজে লাগাতে পারেনি। আমার ছবিতে স্বল্প উপস্থিতিতেই সে প্রমাণ করেছিল কত বড়মাপের অভিনেত্রী।’ শাবনূরের কথা উঠলেই নির্মাতারা এক কথায় বলেন, ‘অসাধারণ অভিনেত্রী’।
সেই শাবনূরের বাড়িও খুলনা অঞ্চলে। সালমান শাহ, রিয়াজ, শাকিল খান, ফেরদৌস, মান্না থেকে শুরু করে শাকিব খান, সবার সঙ্গে জুটি গড়ে তিনি সফল। শাবনূরের অভিনয়গুণ নিয়ে প্রশংসা করেন নায়করাই। শাবনূরকে নিয়ে শেষ পাঁচটি ছবি নির্মাণ করেছেন জাতীয় পুরস্কার পাওয়া পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান মানিক। তাঁর ‘দুই নয়নের আলো’ ছবি করেই প্রথমবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান এ অভিনেত্রী। মানিক বলেন, ‘বাংলাদেশে খুব কম নায়িকা আছেন যাদের ভেবে গল্প তৈরি করেন নির্মাতা। শাবানার পরে একমাত্র শাবনূরকে কেন্দ্র করেই ছবি তৈরি করেন প্রযোজক। শাবনূরকে একই সঙ্গে বলা হয় নায়ক ও নায়িকা। কারণ তাঁর ছবিতে তিনি একাই এক শ।’ খুলনা থেকে আরও এসেছেন- পপি, কেয়া, শাহনূর, আঁচল, মৌসুমী, মিষ্টি জান্নাত, পূজা চেরী, আফসানা মিমি, তমালিকা কর্মকার, নুসরাত ডায়না, নওরীন জেনী, জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া, পিয়া বিপাশাসহ অনেকে। খুলনার মেয়ে মৌসুমী বলেন, ‘খুলনার মেয়েদের মধ্যে চেষ্টাটা বেশি থাকে। ভালো কাজ করার ইচ্ছাটাও তাদের মধ্যে প্রবল। এ জন্যই চলচ্চিত্রে এসে সফল বেশির ভাগই খুলনার। প্রথম ছবি থেকে আজ পর্যন্ত যে ছবিগুলোতে আমি অভিনয় করেছি তার প্রতিটিই মনে রাখার মতো। কারণ পেশার সঙ্গে কখনো আপস করিনি। সেই শুরু থেকে সুচন্দা ম্যাডাম, ববিতা ম্যাডাম, চম্পা ম্যাডাম বা শাবনূর, প্রত্যেকের প্রোফাইল দেখলেই বোঝা যাবে তারাও ঠিক একই রকমভাবে ক্যারিয়ার ধরে রেখেছিলেন। ভালো গল্প, ভালো চরিত্র, ভালো পরিচালকদের ছবিতে অভিনয় করেছেন সবাই।’
চলচ্চিত্র ছাড়াও মিডিয়ার প্রতি বরাবরই খুলনার মেয়েদের আলাদা একটা টান, সেটা বোঝা যায় বিভিন্ন রিয়েলিটি শো দেখলে। এসব প্রতিযোগিতায় খুলনা অঞ্চলের মেয়েরাই সাড়া দেয় বেশি। এনটিভির আলোচিত রিয়েলিটি শো ‘সুপার হিরো সুপার হিরোইন’-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন খুলনার মেয়ে লামিয়া মিমো। তিনি ছবি করেছেন শাকিব খানের সঙ্গে। তবে পরে খুব একটা মেলে ধরতে পারেননি নিজেকে। মিমো না পারলেও পূজা চেরীর মধ্যে দারুণ সম্ভাবনা দেখছেন হালের নির্মাতারা। চিত্রপরিচালক অনন্য মামুন বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে পূজাই হতে পারে আগামী দিনের শাবনূর। তার মধ্যে সে চেষ্টাটা আছে।’ খুলনার ডুমুরিয়ার মেয়ে পূজা চেরী। ‘দহন’ খ্যাত এ অভিনেত্রী বলেন, ‘আমার পরিবার খুব সংস্কৃতিমনা। পরিবারের সবার আগ্রহ গান-বাজনা-অভিনয়ে। তাদের দেখেই আমার ভালো লাগার শুরু। শিশুশিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও আজ আমি দুই বাংলায় ছবি করছি। এটা অনেক ভাগ্যের। এখনো অনেক শেখার আছে। ভালো অভিনেত্রী হওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তার কোনো কমতি রাখতে চাই না। খুলনার নামকরা অন্য সব অভিনেত্রীর পাশে আমার নামটাও দেখতে চাই আগামী দিনে।’
এদিকে অনুসন্ধান করে দেখে গেছে- খুলনার পর ঢাকার মেয়েরাই চলচ্চিত্র ও নাটকে এসেছে বেশি। যেমন ঢাকা থেকে নায়িকা হওয়াদের তালিকায় রয়েছেন-বিপাশা হায়াত, সারা যাকের, রুম্মান রশীদ ঈশিতা, কেয়া পায়েল, অর্চিতা স্পর্শিয়া, শারলিন ফারজানা, ফারজানা মিলি, মুনমুন আহমেদ, ইফফাত তৃষা, জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি, মুনমুন মুন, জেরীন খান রত্না, আইশা খান, নাদিয়া অর্ষা, তাসনুভা তিশা, মনিরা মিঠু, শবনম ফেরদৌসী, সালহা নাদিয়া, শাহতাজ মুনিরা, সাবেরী আলম, মৌসুমী নাগ, আফসানা বিন্দু, রোজী সিদ্দিকী, শর্মীমালা, সায়লা সাবি, সুজানা, মিথিলা, ফারজানা ছবি, শায়লা আমিনসহ আরও অনেকে। চিত্রপরিচালক কাজী হায়াৎ বলেন, শোবিজ জগতে খুলনা ও ঢাকার মেয়েদের আসার মূল কারণ হলো- এ দুই অঞ্চলের মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠে এবং তাদের মন ও মননে সব সময় সংস্কৃতির প্রতি অদ্ভুত একটা টান থাকে।
সুত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন
আপনার মতামত লিখুন :